আরও অন্যান্য সংবাদ

সহকারী সার্জন হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত

  প্রতিনিধি ৪ অক্টোবর ২০২৫ , ৬:৩৮:৫১ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।একদিন ক্রিকেট খেলতে গিয়ে বাঁ কনুই ডিজলোকেটেড (জয়েন্ট নড়ে যাওয়া) হয়ে গেল।আমাকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া দরকার; কিন্তু নিয়ে যাওয়ার মতো কেউ নেই।আব্বা গেছেন পদ্মার চরে কাজ করতে।অনেক খুঁজেও কাউকে পাওয়া গেল না।নিরুপায় হয়ে মা–ই আমাকে কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটলেন হাসপাতালের দিকে। বাড়ি থেকে বেশ দূরেই উপজেলা সদর।আমাদের মা-ছেলের খুব অসহায় লাগছিল।হাসপাতালে গিয়ে মা একে-ওকে জিজ্ঞাসা করে অনেকক্ষণ পরে একজন চিকিৎসকের কাছে আমাকে নিয়ে যেতে পারলেন।চিকিৎসা হলো।

আমি তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি।সেদিন মনে হয়েছিল,বড় হয়ে আমি চিকিৎসকই হব।অসহায়দের সাধ্যমতো সেবা করার চেষ্টা করবো।

সে বছরই জীবনে আরেকটি শিক্ষা পাই।পিইসির (প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা) আগে মডেল টেস্ট দিতে হয়।সেই পরীক্ষা দিতে হয় নিজেদের স্কুল ছেড়ে উপজেলার অন্য কোনো স্কুলে।আমাদের পরীক্ষা পড়েছিল মীরগঞ্জে।এ জন্য সব বন্ধু নতুন জামা কেনে।পরীক্ষার দিন তারা নতুন জামা গায়ে দিয়ে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিল।আমার কোনো ভালো জামা ছিল না।তাদের দেখে আমিও জিদ করি,নতুন জামা ছাড়া পরীক্ষা দিতে যাব না।যাব না মানে যাবই না—ঘরে বসে কাঁদছিলাম। শেষমেশ আমার বড় ভাই জোর করে আমাকে ধরে নিয়ে পরীক্ষার হলে বসিয়ে দিয়ে আসেন।তখন পরীক্ষার ৪০ মিনিট পার হয়ে গেছে।

ক্লাসে আমি ফার্স্ট বয়;কিন্তু সেই পরীক্ষায় আমি তৃতীয় হয়ে গেলাম।ভীষণ মন খারাপ হলো।আস্তে আস্তে বুঝতে শিখলাম, যখন-তখন নতুন জামা কিনে দেওয়ার সামর্থ্য আমার পরিবারের নেই।মা বোঝালেন,নতুন জামা কিনতে হলে ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে।

বাঘার আলাইপুরে একেবারে পদ্মার তীরে আমাদের বাড়ি। পাঁচ কাঠা বাড়ির ভিটে ছাড়া আর কোনো জমি নেই। ছোটবেলা থেকে দেখেছি আব্বা (সুন্টু ইসলাম) কৃষিকাজ করেন।কাজের ফাঁকে এলাকায় ভ্যান চালান।আর মা (চিনুয়ারা বেগম) গৃহিণী।দুজন নিরক্ষর হলে কী হবে,তাঁদের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান আমাদের শিক্ষিত করে মানুষের মতো মানুষ করা।

আমরা তিন ভাই।মেজ ভাই আসাদুল ইসলাম পঞ্চম শ্রেণির পর পড়াশোনায় আর এগোতে পারেননি।দুই বছরের বড় ভাই জিনারুল ইসলাম ভালো ছাত্র।সে যখন এসএসসি পরীক্ষার্থী তখন আমি নবম শ্রেণিতে উঠেছি।সে সময় আমার খুব ঘুম পেত।তাই মাকে সে বলেছিল,রতন (আমার ডাক নাম) তো খালি ঘুমায় ও সায়েন্সে পড়তে পারবে না।’

আমার জিদ চেপে গেল।সায়েন্স নিয়ে রাতদিন পড়তে শুরু করলাম।প্রাইমারি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কোনো দিন প্রাইভেট পড়তে হয়নি।নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান আর গণিত বিষয়ে অনেক কিছুই বুঝি না,প্রাইভেট না পড়লে রেজাল্ট ভালো হবে না।ফার্স্ট বয় হিসেবে আমার শিক্ষকেরা ভালোবাসতেন।তারাই বিনা মূল্যে আমাকে পড়াতে শুরু করলেন। আমি এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করলাম।

এইচএসসিতে রাজশাহী নিউ গভর্নমেন্ট ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হলাম। শামসুদ্দিন হোস্টেলে উঠলাম।হোস্টেলে উঠতে দুই বছরের জন্য একসঙ্গে ২০ হাজার টাকা জমা দিতে হয়।এর বাইরে প্রতিদিন মিলের জন্য জমা দিতে হবে ৭০ টাকা। এদিকে আমার বড় ভাই এইচএসসি পাস করে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছেন।তারও টাকা দরকার।এই টাকার সংস্থান করতে গিয়ে আমার পরিবার চরম বেকায়দায় পড়ে গেল।বাবা একটু বেশি আয়ের আশায় তখন এলাকা ছেড়ে ঢাকায় চলে গেলেন রিকশা চালাতে।

কষ্টেসৃষ্টে আমি কলেজে ভর্তি হলাম। হোস্টেলের খাবারের খরচ বাঁচানোর জন্য বেছে নিলাম প্রতিদিনের মিল কাটার কাজ আর সপ্তাহে তিন দিন বাজার করে দেওয়া। মিল কাটা মানে ১৮০ জন শিক্ষার্থী হোস্টেলে থাকেন,তাঁদের তরকারির বাটিটা একে একে দিতে হতো সিরিয়াল করে।এ জন্য খাতায় হিসাব করতে হতো।এ কাজ করতে অনেক সময় লেগে যেত।আমি সময় খরচ করে মিল কাটতাম।পড়াশোনার ক্ষতি হতো। বাজার করার সময়ও ক্লাস কামাই হয়ে যেত।কিন্তু আমার থাকা– খাওয়ার খরচ প্রায় অর্ধেক কমে গেল।এর পরেও টাকার অভাবে অনেক দিন না খেয়ে পার করতে হয়েছে।

মেসে থাকা হলো না

এইচএসসি পাস করার পর হল ছাড়তে হলো।রেজাল্ট মনের মতোই হলো,জিপিএ-৫।আমার লক্ষ্য মেডিকেল।ভর্তি পরীক্ষার আগে সবাই কোচিং করছেন,আমাকে কোচিং করতে হলে মেসে উঠতে হবে।রাজশাহীর সাহেববাজার এলাকায় একটি মেসে ২ হাজার ৫০০ টাকা অগ্রিম দিই; কিন্তু উঠতে গিয়ে দেখি,আরেকজনকে তুলে ফেলেছে।আমাকে আর টাকাও ফেরত দিল না।আমি এখন কী করি। বাধ্য হয়ে বাড়িতেই চলে আসি।সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় থেকেই ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।বাড়িতে বসে রাতদিন পড়তে থাকলাম। ২০১৯ সালে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেলাম বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে।ভর্তির পরই কিছু টিউশনি জোগাড় করি।এ ছাড়া সরকারি বৃত্তিসহ ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের বৃত্তি পাই।এতে আমার পড়াশোনায় দারুণ সুবিধা হয়।আমার ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েও ভর্তি হয়নি।পরের বছর ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। আমাদের দুই ভাইয়ের কথা ভেবে তখনো ঢাকায় চলে যান বাবা।

এমবিবিএস পরীক্ষার রেজাল্ট হয় ৯ জুলাই।তার ৯ দিন পরই ছিল ৪৮তম বিসিএস প্রিলিমিনারি।মাঝখানে প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পেলাম মাত্র সাত দিন।আমাদের ব্যাচের অনেকে ইন্টার্নশিপ শুরু করে।আমি বিসিএসের জন্য ছুটি নিই। প্রিলিমিনারির পর লিখিত পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হই।এরপর ভাইভা হলো গত ৪ সেপ্টেম্বর। তিনজন স্যার বোর্ডে ছিলেন। মনে হলো,আমি তাঁদের সন্তুষ্ট করতে পেরেছি।তাঁরাও তখনই বলে ফেললেন,আমাকে সুপারিশ করবেন।

পরীক্ষা দিয়ে নিচে নামলাম।আমার মামা অপেক্ষায় ছিলেন। নেমেই বাড়িতে মাকে ফোন করে জানালাম,পরীক্ষা ভালো হয়েছে।আর ঢাকায় আব্বাকে ফোন করে বললাম, ‘আজ থেকে আর রিকশা চালাতে হবে না।’সেদিনও রিকশা চালাচ্ছিলেন আব্বা।আমার কথা শুনে ব্যাগ গুছিয়ে বাসে উঠলেন।আমার আর মামার যেহেতু ট্রেনের ফিরতি টিকিট কাটা ছিল,আমরা ট্রেনে রওনা দিলাম। আব্বা বাসে করে রাজশাহীর পুঠিয়ার বানেশ্বরে নেমে আমাদের আগেই বাড়ি পৌঁছে গেছেন।বাড়িতে ফিরে মনে হলো জান্নাতে পৌঁছলাম।

১১ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়।আমি সহকারী সার্জন হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি।এর মধ্যে ইন্টার্নশিপও শুরু করেছি।শেষ হলেই সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে পারব।

চিকিৎসক হিসেবে আমার জীবনের ব্রত হবে মানুষের সেবা করা।আমার চারপাশে যাঁরা রয়েছেন বা ভবিষ্যতে যাঁদের পাব,তাঁদের স্বাস্থ্যবিষয়ক যেকোনো সমস্যায় তাঁদের পাশে থাকব। মানুষের অসহায়ত্ব কতটা বেদনাদায়ক সেটি আমি জীবন দিয়ে অনুভব করেছি।তাই আমার সাধ্যমতো সহযোগিতা করার চেষ্টা করব।

আরও খবর

Sponsered content