প্রতিনিধি ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ৫:০১:১১ প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক।।বাজার নিয়ন্ত্রণে উৎপাদক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে সোনালি ও ব্রয়লার মুরগি এবং ডিমের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর।তবে ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা বলছেন,এ দাম যৌক্তিক নয়; এতে এগুলোর বাজার আরও চড়তে পারে।

নিত্যপণ্যের বাজারে এগুলোর দাম গত কয়েক মাস ধরেই ঊর্ধ্বমুখী।মুরগির দাম কিছুটা ওঠানামা করলেও ডিমের দাম নামেনি ১৫০ টাকার (প্রতি ডজন) নিচে।এর দাম নিয়ন্ত্রণে ভারত থেকে আমদানিও করেছে সরকার; তবে তাতে লাভ হয়নি।
এ পরিস্থিতিতে রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হকের সই করা এক চিঠিতে জানানো হয়,ডিমের মূল্য উৎপাদক পর্যায়ে ১০ টাকা ৫৮ পয়সা,পাইকারি পর্যায়ে ১১ টাকা ০১ পয়সা এবং খুচরা পর্যায়ে ১১ টাকা ৮৭ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।কৃষি বিপণন অধিদফতর,প্রাণিসম্পদ অধিদফতর এবং পোলট্রি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের নেতাদের সমন্বয়ে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠিত হয়েছে।
এছাড়া,কেজিপ্রতি সোনালি মুরগি উৎপাদক পর্যায়ে ২৬০ টাকা ৭৮ পয়সা,পাইকারি পর্যায়ে ২৬৪ টাকা ৫৭ পয়সা এবং খুচরা পর্যায়ে ২৬৯ টাকা ৬৪ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।আর কেজিপ্রতি ব্রয়লার মুরগি উৎপাদক পর্যায়ে ১৬৮ টাকা ৯১ পয়সা,পাইকারি পর্যায়ে ১৭২ টাকা ৬১ পয়সা এবং খুচরা পর্যায়ে ১৭৯ টাকা ৫৯ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।
গ্রুপের মতামতের ভিত্তিতে কৃষি বিপণন অধিদফতর ২০২৪ সালের মুরগি (সোনালি ও ব্রয়লার) ও ডিমের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করেছে জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, কৃষি মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে মুরগি (সোনালি ও ব্রয়লার) ও ডিমের দাম নির্ধারণের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানায়।এর পরিপ্রেক্ষিতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্ধারণ করা যৌক্তিক মূল্য সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তবে সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) কেরানীগঞ্জের জিনজিরা ও আগানগর এবং রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও নিউ মার্কেটসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়,বাজারভেদে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৭০-১৮০ টাকা এবং সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৪০-২৬০ টাকা পর্যন্ত।এগুলো সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম।
ক্রেতারা বলছেন,বাজারে এমনিতেই ডিম ও মুরগির দাম বেশি।তার ওপর সরকার বেশি দাম বেঁধে দেয়ায় বাজার আরও অস্থির হওয়ার উপক্রম হয়েছে।নাইম নামে এক ক্রেতা বলেন,বাজারে সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়। আর সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে ২৬৯ টাকা।এতে ব্যবসায়ীদের দাম বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে।
এদিকে,বাজারে অনেক ব্যবসায়ীই জানেন না নতুন নির্ধারিত দামের কথা।তবে যারা জানেন,তারা এ দামকে অযৌক্তিক বলে দাবি করছেন।রাজধানীর নিউমার্কেট কাঁচাবাজারের মুরগি ব্যবসায়ী মির হোসেন বলেন,এ দাম সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। বাজার নির্ভর করে চাহিদা আর যোগানের ভিত্তিতে।এখানে দাম ওঠানামা করবে।এভাবে দাম বেঁধে কখনোই বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না।এর জন্য অসাধু সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে।
আর কারওয়ান বাজারের মুরগি ব্যবসায়ী দিদার বলেন, বাজারে মনিটরিং না করে,শুধুমাত্র দাম বেঁধে দিলে হবে না। এছাড়া,বাজারে যে দামে মুরগি বিক্রি হচ্ছে,তার চেয়ে বেশি দাম নির্ধারণ করেছে সরকার। এতে সুযোগ নেবে অসাধুরা।
তবে প্রাণিসম্পদ এবং কৃষি বিপণন অধিদফতরকে দায়ী করে বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন,ডিম ও মুরগির অযৌক্তিক দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এ মূল্য নির্ধারণে বাজার আরও অস্থির হয়ে ওঠবে।এটি করপোরেট গ্রুপগুলোকে সহযোগিতা করে আঙুল ফুলে কলাগাছ বানানোর কৌশল।
সরকারের দফতরগুলো করপোরেট গ্রুপগুলোকে সুযোগ করে দেয় উল্লেখ করে সুমন বলেন,যেখানেই মিটিং হোক না কেন, সেখানে বড় করপোরেট কোম্পানিগুলোকেই ডাকা হয়।প্রান্তিক খামারিদের ডাকা হয় না।অথচ করপোরেট কোম্পানিগুলো দেশের মোট চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ উৎপাদন করে।দাম কমাতে সরকারকে প্রান্তিক খামারিদের দিকে নজর দিতে হবে। তাদের কথা শুনতে হবে।দাম নির্ধারণে খামারি,ভোক্তা, ব্যবসায়ী ও প্রশাসন সব পক্ষকে রাখতে হবে।
এছাড়া,১৬৮.৯১ টাকা ও ২৬০.৭৮ টাকায় যথাক্রমে যে ব্রয়লার ও সোনালি মুরগি বিক্রি করবেন,খামারি তা কয়েক হাত বদল হয়ে খুচরা বিক্রেতা কীভাবে ১৭৯.৫৯ টাকা ও ২৬৯.৬৪ টাকায় বিক্রি করবেন বলেও প্রশ্ন তোলেন বিপিএ সভাপতি।তিনি আরও বলেন,সবাই মুরগি ও ডিমের দাম কমাতে চায়; কিন্তু উৎপাদন খরচ নয়।যার মাশুল গুনতে হয় ভোক্তাকে।তাই সিন্ডিকেট ভাঙতে শুধু বাজার মনিটরিং না করে উৎপাদন খরচ কমাতে হবে।কারণ খরচ কমলে উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হবেন খামারিরা। এতে বাজারে সরবরাহ বাড়লে দামও কমবে।
কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন,সরকার দাম নির্ধারণের সময় বাজার থেকে পর্যাপ্ত তথ্য নেয় না।ফলে দাম নির্ধারণ কোনো কাজেই আসে না।এটি বিগত সরকারের আমলে বহুবার দেখা গেছে।এবারও তাই হয়েছে।কারণ সরকার পরিবর্তন হলেও কর্তা-আমলা কিন্তু পরিবর্তন হয়নি।ফলে দাম নির্ধারণের ট্রেডিশনাল পদ্ধতিটা থেকেই গেছে।বাজার ভালোমতো বিশ্লেষণ করে এরপর দাম নির্ধারণ করতে হবে।
এছাড়া,শুধুমাত্র বাজারে দাম নির্ধারণ করে দিলেই হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, বাজার নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। না হলে উৎপাদক,ব্যবসায়ী বা ভোক্তা কারোরই কোনো লাভ হবে না।
এদিকে,অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবির বলেন,বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে স্বস্তি ফেরাতে দাম বেঁধে দেয় সরকার। কিন্তু এখন যখন মুরগির দাম কিছুটা কমতির দিকে ছিল, তখন দাম বেঁধে দেয়াটা যুক্তিসঙ্গত নয়।দাম বেঁধে দেয়ার এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।কারণ,দাম বেঁধে দিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পণ্যের বাজার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।ডিম ও মুরগির দাম বেঁধে দেয়া বাজারে সমস্যা তৈরি করতে পারে।কারণ অসাধু ব্যবসায়ীরা বাড়তি এ দামের সুযোগ নেবে।
তবে এটি সমস্যা নাও হতে পারে বলে জানান এ অর্থনীতিবিদ।তিনি বলেন,যদি বাজারে সরবরাহ বেড়ে যায়, তাহলে আর সুযোগ নিতে পারবে না অসাধু সিন্ডিকেট। এছাড়া,সরকারকে কঠোর মনিটরিংয়ে রাখতে হবে বাজার।

















