জাতীয়

রাত ১২টায় ঘুমাতে গেলেই বিদ্যুৎ চলে যায়-এক ঘণ্টা পর আসে!

  প্রতিনিধি ৪ জুন ২০২৩ , ১২:৪১:৫০ প্রিন্ট সংস্করণ

মাজহারুল ইসলাম।।গত কয়েক দিন সর্বোচ্চ লোডশেডিং হচ্ছে মধ্যরাতের পর।এই পরিস্থিতি সারা দেশে,বিশেষ করে ঢাকার বাইরে বেশি।রাত ১২টায় ঘুমাতে গেলেই বিদ্যুৎ চলে যায়-এক ঘণ্টা পর আসে!দেশজুড়ে চলমান তাপপ্রবাহের কারণে দিন ও রাতে গরমের অনুভূতি আলাদা করার উপায় নেই।গভীর রাত পর্যন্ত থাকছে গরমের তেজ।এতে মধ্যরাতের পরও বিদ্যুতের চাহিদা তেমন একটা কমছে না; কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন রাত ১০টার পর থেকে কিছুটা কমতে থাকে।

লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা লাইজু বেগম বলেন,রাত ১২টায় ঘুমাতে গেলেই বিদ্যুৎ চলে যায়।এক ঘণ্টা পর আসে।ঘুম কিছুটা গভীর হওয়ার আগে দুইটার দিকে আবার বিদ্যুৎ চলে যায়।এরপর আধা ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না।চার দিন ধরে এমন চলছে।ঘুমাতে পারছে না কেউ।বাচ্চাদের সকালে স্কুলে যেতে কষ্ট হচ্ছে।

রাজধানীর এই বাসিন্দার চেয়েও লোডশেডিংয়ে বেশি ভুগছেন গ্রামের মানুষ।স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেশি তাপমাত্রা থাকা রাজশাহী,নীলফামারী,দিনাজপুর ও চুয়াডাঙ্গায় লোডশেডিং ভোগান্তি তৈরি করেছে।রাজশাহী নগরের বুধপাড়া এলাকার রহিদুল ইসলাম বলেন,কয়েক দিন ধরে রাত ১২টার পর বিদ্যুৎ চলে যায়।এ গরমে বিদ্যুৎ চলে গেলে কষ্ট বাড়ে।

বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) বলছে,রাত ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ লোডশেডিং হচ্ছে।রাত ১০টার পর বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যায় গড়ে দুই হাজার মেগাওয়াট।স্বাভাবিক সময়ে রাতে বিদ্যুতের চাহিদা কমতে থাকে; কিন্তু কয়েক দিন ধরে এটি তেমন একটা কমছে না।জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনও বাড়ানো যাচ্ছে না,তাই লোডশেডিং বেড়ে গেছে।

রাত ১২টায় ঘুমাতে গেলেই বিদ্যুৎ চলে যায়।এক ঘণ্টা পর আসে।ঘুম কিছুটা গভীর হওয়ার আগে দুইটার দিকে আবার বিদ্যুৎ চলে যায়।এরপর আধা ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না।চার দিন ধরে এমন চলছে।ঘুমাতে পারছে না কেউ।বাচ্চাদের সকালে স্কুলে যেতে কষ্ট হচ্ছে।

পিজিসিবির তথ্য বলছে,সাধারণত সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ধরা হয়।এ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদনও বেশি করা হয়।২ জুন সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় রাত ৯টায়,১৪ হাজার ৩৭৭ মেগাওয়াট।এ সময় লোডশেডিং হয় মাত্র ৩৭৫ মেগাওয়াট।এরপর উৎপাদন কমতে থাকে আর লোডশেডিং বাড়তে থাকে।মধ্যরাতের পর উৎপাদন হয় ১১ থেকে সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট।ওই দিন দিবাগত রাত একটায় ১ হাজার ৯৯২ এবং রাত তিনটায় ১ হাজার ৭০৩ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়েছে।এর আগের তিন দিনও মধ্যরাতের পর লোডশেডিং পরিস্থিতি প্রায় এমন ছিল। গতকাল শনিবারও দুপুর ১২টায় সর্বোচ্চ লোডশেডিং হয়েছে ২ হাজার ২৪৭ মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য বলছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা এখন ২৩ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট।এর মধ্যে গড়ে প্রতিদিন জ্বালানির অভাবে সাড়ে ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না।এ ছাড়া নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আড়াই হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতা বন্ধ রাখতে হয়।বাকি ১৬ হাজার মেগাওয়াট থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে ১২ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট।

দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় গত ১৯ এপ্রিল, ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট।ওই সময় টানা কয়েক দিন ১৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।কিন্তু জ্বালানির অভাবে গত মাসে এটি কমতে থাকে।গ্যাস ছাড়াও কয়লার অভাবে ভুগছে বিদ্যুৎকেন্দ্র।ডলার–সংকটে পড়ে কয়লা আমদানি করতে না পারায় দুই দফায় বন্ধ হয়েছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র।এখন তা চালু থাকলেও বন্ধ হওয়ার পথে দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র,১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের পটুয়াখালীর পায়রা।এটি বন্ধ হলে লোডশেডিং আরও বাড়তে পারে।

বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন,দিনে কোনো কোনো ঘণ্টায় তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং করতে হচ্ছে।এমন ভয়াবহ গরমে গ্রাহকদের জন্য তাঁরা কিছুই করতে পারছেন না।চাহিদার তুলনায় কম সরবরাহ পাচ্ছেন প্রতি ঘণ্টায়।বৃষ্টি শুরু হলে স্বস্তি আসতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা।

কয়লা শেষ হয়ে আসায় পায়রা গতকাল থেকে পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার কথা ছিল।বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেছেন,৬৬০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট ২৫ মে থেকে বন্ধ। আরেকটি ইউনিট থেকে এখন ১৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন করা হচ্ছে।উৎপাদন কমিয়ে দুই দিন বাড়তি চালু রাখা হচ্ছে পায়রা।আগামীকাল সোমবার উৎপাদন বন্ধ হতে পারে। জুনের শেষ সপ্তাহে নতুন করে কয়লা এলে আবার উৎপাদন শুরু করা হবে।

পিডিবির দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন,জ্বালানি তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সব সময় চালানো যায় না।এগুলো রাখা হয় সর্বোচ্চ চাহিদার সময় চালানোর জন্য।এখন গরমে বাড়তি চাহিদা সামলাতে এগুলো বেশি হারে চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।গরমে টানা চালাতে গিয়ে যন্ত্রপাতিও নষ্ট হচ্ছে।চাইলেও রাত ১০টার পর এসব কেন্দ্র চালানো যাচ্ছে না।এগুলোর বিরতি দরকার হয়।

পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী বলেন,তাপমাত্রা বেড়ে চাহিদা বেড়ে গেছে।চাইলেও ফার্নেস তেলে চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র সব সময় চালানো যায় না।দিনে সর্বোচ্চ সাড়ে ১২ হাজার ও রাতে সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা করা হচ্ছে।দ্রুতই পরিস্থিতি সহনীয় হয়ে আসবে।

সকাল থেকে রাত তিনটা পর্যন্ত তাপমাত্রা বেশি থাকে।এতে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেছে।এর সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন না বাড়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে।এতে দফায় দফায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলোর। রাজধানী ঢাকায়ও বেশির ভাগ এলাকার মানুষ গড়ে তিন ঘণ্টার বেশি লোডশেডিংয়ে ভুগছে। ঢাকায় দিনের বেলায় বেশি হচ্ছে লোডশেডিং।

রাজধানীতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)।এ দুই সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন,দিনের বেলায় চাহিদা বেশি থাকে। সবচেয়ে বেশি হয় বেলা তিনটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত। সব অফিস বন্ধের পর সন্ধ্যা থেকে চাহিদা কিছুটা কমতে থাকে।গতকাল ছুটির দিনেও ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩১৭ মেগাওয়াট লোডশেডিং করেছে ডেসকো।আর ডিপিডিসি করেছে ৩২৫ মেগাওয়াট পর্যন্ত।মধ্যরাতের পর ডেসকো এলাকায় তেমন বেশি লোডশেডিং হয় না।তবে ডিপিডিসির বিতরণ এলাকায় গভীর রাতেও ২০০ মেগাওয়াটের ওপর লোডশেডিং থাকে।

দেশের প্রায় সব গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)।দেশের সবচেয়ে বড় এই বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা বলছে,গতকাল সন্ধ্যা ছয়টার দিকে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করেছে তারা।মধ্যরাতে সরবরাহ কমে যায়,কিন্তু চাহিদা কমে না।তাই বাধ্য হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হয় তাদের।

রাজশাহীতে গত বৃহস্পতিবার থেকে চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে লোডশেডিং।এক সপ্তাহ ধরে রাজশাহীতে গ্রাম ও শহরে লোডশেডিং বেড়েছে।রাজশাহী আবহাওয়া অফিস বলছে,রাজশাহীতে সর্বশেষ বৃষ্টি হয়েছে ১০ দিন আগে। এরপর থেকে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে।শুক্রবার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকাল ছিল ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

দিনাজপুরে গত কয়েক দিনে অসহনীয় রোদ আর গরম বাতাসে অস্থির হয়ে পড়েছে জনজীবন।রাতে ভ্যাপসা গরম। এর মধ্যে দিনে পাঁচ থেকে ছয়বার লোডশেডিং হচ্ছে। প্রতিবার অন্তত এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না।গত এক সপ্তাহে জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।গতকাল ছিল ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

দিনাজপুর শহরের বিতরণ সংস্থা নেসকো বলছে,চাহিদা ৩৭ মেগাওয়াট,সরবরাহ হচ্ছে ২৫ মেগাওয়াট।আর জেলার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি বলছে,বিদ্যুতের চাহিদা ১১০ মেগাওয়াট, সরবরাহ হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ মেগাওয়াট।

টানা তাপপ্রবাহে চুয়াডাঙ্গার বাসিন্দারাও লোডশেডিংয়ে ভুগছে। একই পরিস্থিতি নীলফামারীতেও।শহরের বাবুপাড়া নিবাসী স্কুলশিক্ষক লিনা দে (৪৫) বলেন, ‘এমনিতেই গরমে টেকা মুশকিল হয়ে পড়েছে;তার ওপর বিদ্যুতের আসা–যাওয়ায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি।’

ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে নেসকো নীলফামারী কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আলিমুল ইসলাম বলেন,চাহিদার তুলনায় অর্ধেক সরবরাহ পাওয়ার কারণে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।

ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠান শেষে লোডশেডিং নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে গতকাল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, এ মুহূর্তে কিছুটা লোডশেডিং চলছে।এটা কিছুদিন যাবে। গড়ে দেড় হাজার মেগাওয়াটের ওপর।কয়লার অভাব দেখা গেছে। এটা (কয়লা) আসতে ২০ থেকে ২৫ দিন লেগে যাবে। কয়লার ঋণপত্র খুলতে দেরি হয়েছে।তাই একটা বড় অংশের বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না জাতীয় গ্রিডে।কিছুটা জনদুর্ভোগ হচ্ছে।

তবে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন,দিনে কোনো কোনো ঘণ্টায় তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং করতে হচ্ছে।এমন ভয়াবহ গরমে গ্রাহকদের জন্য তাঁরা কিছুই করতে পারছেন না।চাহিদার তুলনায় কম সরবরাহ পাচ্ছেন প্রতি ঘণ্টায়।বৃষ্টি শুরু হলে স্বস্তি আসতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা।

সক্ষমতা থাকলেও চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারার জন্য ভুল পরিকল্পনা ও অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে আসছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।সংগঠনটি বলছে,যে উৎপাদন ক্ষমতা কাজে লাগছে না,তার দায় কেন ভোক্তা নেবে।গত অর্থবছরেও ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র ভাড়া দিতে হয়েছে।এর জন্য দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ছে।

ক্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও বিদ্যুৎ খাত বিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলম বলেন,খরচ কমিয়ে,ডলার বাঁচিয়ে,জ্বালানি তেল সাশ্রয় করে উৎপাদন কমানো হচ্ছে।এটা তো পরিকল্পিত লোডশেডিং।দুই হাজার মেগাওয়াটের কথা বলা হচ্ছে,আসলে লোডশেডিং আরও বেশি হচ্ছে।না হলে তো মধ্যরাতে লোডশেডিং হওয়ার কথা নয়।আর এতে বেশি ভুগছে গ্রামের মানুষ,এটা অবিচার।

আরও খবর

Sponsered content