অপরাধ-আইন-আদালত

রপ্তানিমুখী কারখানার পোশাক চুরি-সেই পোশাক বিক্রি করে কোটিপতি হয়েছেন

  প্রতিনিধি ৭ জানুয়ারি ২০২৩ , ৯:৫৮:১৯ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।চোরদের কাছ থেকে পোশাক কিনে তা বিক্রি করতে করতে নিজেই হয়ে যান চোর।চক্র গড়ে শুরু করেন রপ্তানিমুখী কারখানার পোশাক চুরি।সেই পোশাক বিক্রি করে কোটিপতি হয়েছেন,ঢাকায় বাড়ি করেছেন,কিনেছেন দামি গাড়ি।যদিও শেষ রক্ষা হয়নি।ধরা পড়েছেন।

চোর চক্রের এই ‘প্রধানের’ নাম তাওহীদুল ইসলাম।গত ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার ডেমরার মীরপাড়া এলাকার একটি পরিত্যক্ত কারখানায় অভিযান চালিয়ে তাঁকেসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব।বাহিনীটির কর্মকর্তারা বলছেন,চোরের চক্রটি এতই আত্মবিশ্বাসী ছিল যে চুরির আগেই রপ্তানি পণ্য অসাধু পোশাক ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিত।অসাধু পোশাক ব্যবসায়ীরা আবার সেই পণ্য বিদেশে পাঠাতেন।

তৈরি পোশাক দেশের শীর্ষ রপ্তানিপণ্য।২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিল ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলার (৫২ বিলিয়ন)।এর মধ্যে পোশাক খাত থেকে এসেছিল প্রায় ৮২ শতাংশ।

মাঝারি কোনো পোশাক কারখানার পোশাক চুরি হলে তাদের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়।

মোহাম্মদ আবদুর রহমান, র‍্যাব-৪–এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রপ্তানিকারকেরা বলছেন,কারখানা থেকে কাভার্ড ভ্যানে পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে পাঠানোর সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চুরি হয়।চুরির কারণে তাদের আর্থিক ক্ষতি যেমন হয়,তেমনি দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হয়।কারণ চোরেরা পোশাক চুরি করে বাক্সের ভেতর টুকরা কাপড় (ঝুট),আবর্জনা ও অন্যান্য বস্তু ভরে রাখে,যা ওই অবস্থায় ইউরোপ-আমেরিকায় চলে যায়।

র‍্যাব-৪–এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ আবদুর রহমান বলেন,মাঝারি কোনো পোশাক কারখানার পোশাক চুরি হলে তাদের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়।

র‍্যাবের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন,চোরের চক্রটির প্রধান তাওহীদুল বছর দশেক আগে ফুটপাতে পাইকারি দরে পোশাক সরবরাহ করতেন।সেই পোশাক তিনি চোরদের কাছ থেকে কম দামে সংগ্রহ করতেন।বছর সাতেক আগে তিনি নামকাওয়াস্তে দুটি কারখানা খোলেন।সেখানে চোরাই পণ্য মজুত করে বিক্রি শুরু করেন।তিনি বলতেন,বিক্রি করা পোশাক তাঁর নিজের কারখানায় তৈরি।

তাওহীদুল একপর্যায়ে চুরির কৌশল শিখে নিজেই পণ্য চুরি করতে ১০ থেকে ১২ জনের একটি চক্র গঠন করেন বলে জানান র‍্যাবের কর্মকর্তারা।তাঁরা বলেন,এই চক্র তিন বছর ধরে রপ্তানির পণ্য চুরি করছিল।

তাওহীদুল ছাড়া র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন মো. নাজিম,মো. মাসুদ,মো. দুলাল,মিরাজ উদ্দিন,আবদুল আল মাসুদ ও সাইফুল ইসলাম।দুলাল ও নাজিম সহোদর।চক্রটির কাছ থেকে মোহাম্মদপুরের সেলিব্রেটি এক্সপোর্ট গার্মেন্টসের রপ্তানিযোগ্য ছয় কোটি টাকা মূল্যের পণ্য ও একটি কাভার্ড ভ্যান উদ্ধার করা হয়।

তাওহীদুল ছাড়া অন্যরা নিজেদের গাড়িচালক বলে পরিচয় দেন।সবার বাসা ডেমরা ও এর আশপাশে।র‍্যাব জানিয়েছে, এদের সবার বিরুদ্ধে চুরির মামলা রয়েছে।কারও কারও বিরুদ্ধে মামলা একাধিক।তাওহীদুলের বিরুদ্ধে গাজীপুর ও ঢাকায় চারটি পোশাক চুরির মামলা রয়েছে।

তালা না ভেঙেই চুরি
র‍্যাব-৪–এর বিশেষ দলের কোম্পানি কমান্ডার জাহিদুল ইসলাম বলেন,চোর দলের সদস্যরা প্রথমে রপ্তানিমুখী পণ্য পরিবহনকারী যানবাহনের চালকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এরপর তাঁকে টাকার লোভ দেখিয়ে চুরির পরিকল্পনায় জড়ান। চালকের কাজ হলো,চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে পোশাকবাহী কাভার্ড ভ্যানটিকে নির্ধারিত কোনো পরিত্যক্ত কারখানা বা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া।

জাহিদুল ইসলাম আরও বলেন,কারখানা থেকে বন্দরের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার আগে কাভার্ড ভ্যানে তালা লাগিয়ে সিলগালা করে দেওয়া হয়।চোর চক্রের সদস্যরা তালা না ভেঙে কাভার্ড ভ্যানের নাটবল্টু খুলে ফেলতেন।

এতে কাভার্ড ভ্যানের উপরিকাঠামোই খুলে যেত।এরপর মালামাল সরিয়ে নিতেন।এভাবে সিল ও তালা অক্ষতই থাকে। বন্দরে পণ্য নামানোর সময় চুরির বিষয়টি আর ধরা পড়ে না।

রপ্তানির পোশাক কাভার্ড ভ্যানে ওঠানোর সময় তা কাগজের বাক্সে (কার্টন) রাখা হয়।একটি বাক্সে অনেক পোশাক থাকে। র‍্যাবের কর্মকর্তারা বলেন,চোরেরা একেকটি বাক্স থেকে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পণ্য চুরি করেন।এরপর বাক্সে সমপরিমাণ ঝুট বা অন্য কিছু ভরে রাখা হয়।

চুরির ঘটনা কত
পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সূত্র জানায়, চুরির অভিযোগ তাদের কাছে মাঝেমধ্যে আসে।তবে ঠিক কতগুলো চুরির ঘটনা ঘটেছে,তার হিসাব নেই।২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ২০ থেকে ২৫টি ঘটনা ঘটেছে।

বিজিএমইএর নেতারা বলছেন,মহাসড়কে চুরির ঘটনা বেড়ে গেলে ২০২১ সালের জুলাইয়ে শিল্পমালিকদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বৈঠক করেন।

তখন চুরি ঠেকাতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এবং মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর কথাও বলা হয়। সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর কাজ শেষ হয়নি।

বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদউল্লাহ আজিম বলেন, পণ্য চুরি হলে কারখানামালিক ক্রেতার কাছ থেকে পণ্যের দাম পান না।আবার বাক্সে আজেবাজে জিনিস ভরে পাঠানো হয় বলে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়।সরকারের উচিত চুরি ঠেকাতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।

আরও খবর

Sponsered content