আবহাওয়া বার্তা

২০ বছরে সর্বোচ্চ ভূমিকম্পের মাত্রা ৫:৫ রিখটার স্কেল

  প্রতিনিধি ১৬ আগস্ট ২০২৩ , ২:১৫:০৩ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।ঢাকায় সোমবার রাতে যে ভূমিকম্প হয়েছে,রিখটার স্কেলে সেটির মাত্রা ছিল সাড়ে ৫।দেশের ভেতরে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে এই মাত্রা ২০ বছরে সর্বোচ্চ।

ভূমিকম্পটিতে কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।তবে অনেকটা সময় ধরে কম্পনে নগরের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন,এবারের ভূমিকম্পটি হয়েছে বাংলাদেশের ভূগর্ভের ডাউকি চ্যুতি নামে পরিচিত চ্যুতিরেখা বা ফাটল বরাবর।গত কয়েক বছরে এই চ্যুতিরেখায় বেশ কিছু ভূমিকম্প হয়েছে।এটা বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা জাগাচ্ছে।

দেশে সোমবার রাত ৮টা ৪৯ মিনিটে ভূমিকম্পটি অনুভূত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) জানায়,এর উৎস ছিল ঢাকা থেকে ২২৮ কিলোমিটার দূরে সিলেটের কানাইঘাট ও ভারতের আসাম সীমান্তের কাছে।ভূগর্ভের ১০ কিলোমিটার গভীরে এর উৎপত্তি।ভূমিকম্পটির কম্পন রাজধানীসহ সারা দেশে ভালোই অনুভূত হয়েছে।

ঢাকার শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা উম্মে সালমা আক্তার বলেন,তিনি যে ভবনে বাস করেন,সেটিতে মিনিটখানেকের বেশি সময় কম্পন হয়েছে বলে তাঁর মনে হয়েছে।এতে তিনি আতঙ্কিত হয়ে সন্তানসহ ভবন থেকে নেমে যান।তিনি বলেন, ‘ভূমিকম্পে বিল্ডিং এতটা কাঁপতে কখনো দেখিনি।’

ডাউকি চ্যুতি চিন্তার কারণ:-
কোনো ভূমিকম্পের মাত্রা ৫–এর ওপরে গেলে তাকে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প বলা হয়।এর নিচে হলে তাকে মৃদু কম্পন হিসেবে গণ্য করা হয়।

ইউএসজিএসের তথ্য অনুযায়ী,সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পের মধ্যে বেশি মাত্রা ছিল ২০০৩ সালের ২৬ জুলাইয়ে সৃষ্টি হওয়া একটি ভূমিকম্পের। সেটি চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়িতে অনুভূত হয়।মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬।

বাংলাদেশে গত এক বছরে তিনটি ৫ মাত্রার বেশি ক্ষমতার ভূমিকম্প হয়েছে।সোমবারেরটির বাইরে বাকি দুটি হলো ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট ৫ দশমিক ১ মাত্রা এবং গত ২৩ জানুয়ারি ৫ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প।সবমিলিয়ে গত এক বছরে বাংলাদেশে ১৭টি ভূমিকম্প হয়েছে।বেশির ভাগের মাত্রা ছিল ৪ থেকে ৫–এর মধ্যে।১০টির উৎস ছিল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায়।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান রুবায়েত কবির বলেন,সাধারণত দেশের ভেতরের উৎস থেকে যেসব ভূমিকম্প হয়,তা চার থেকে পাঁচ মাত্রার হয়ে থাকে।এতে মৃদু কম্পন ও কিছুটা আতঙ্ক তৈরি হওয়া ছাড়া তেমন ক্ষয়ক্ষতি হতে দেখা যায় না।তিনি বলেন, গত ২০ বছরে সাড়ে ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হতে আমরা দেখিনি।সোমবারের ভূমিকম্পের উৎসস্থলটি ডাউকি চ্যুতি বরাবর।সেখানে ভূমিকম্প বাড়ছে।এটা ওই এলাকায় বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন,বাংলাদেশের সিলেট ও ভারতের আসাম মিলিয়ে ডাউকি চ্যুতি পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় তিন শ কিলোমিটার বিস্তৃত।১৮৯৭ সালে ‘ডাউকি ফল্টে’ ৮ দশমিক ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল।

ডাউকি চ্যুতি ছাড়াও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকার ভূগর্ভে থাকা একটি চ্যুতিও সক্রিয়।বাংলাদেশের মার্টির নিচে চ্যুতি আছে মোট ১৩টি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায়,১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পটির কেন্দ্র ছিল ঢাকা থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে।ওই সময় ঢাকায় মাত্র ১০০টি পাকা দালান ছিল,অধিবাসী ছিল ৯০ হাজার।ওই ভূমিকম্পে আহসান মঞ্জিলসহ ১০টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ডাউকি চ্যুতি ছাড়াও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকার ভূগর্ভে থাকা একটি চ্যুতিও সক্রিয়।বাংলাদেশের মার্টির নিচে চ্যুতি আছে মোট ১৩টি।

সাধারণত ভূগর্ভের ৫ থেকে ১৫ কিলোমিটার গভীরে কোনো ভূমিকম্প হলে তাতে কম্পন বেশি অনুভূত হয়।এ ধরনের কম্পনে কংক্রিটের অবকাঠামোর ক্ষতি বেশি হয়।তবে বাংলাদেশের সিলেট থেকে শুরু করে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার ভূমি মূলত নরম মাটির।ফলে সেখানে কম্পন বেশি হলেও তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি কম হয়।

অবশ্য এ ক্ষেত্রে ভিন্ন রকম এক বিপদের আশঙ্কার কথা বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া বলেন,বাংলাদেশের মাটি নরম।এটি একদিকে ভূমিকম্পের বেশি ক্ষয়ক্ষতি থেকে আমাদের বাঁচিয়ে দেবে।তবে নরম মাটির এলাকায় ভূমিকম্পের প্রবণতা বা ফ্রিকোয়েন্সি বেশি থাকলে তা দীর্ঘমেয়াদি দুলুনি বা কম্পন সৃষ্টি করে বড় ক্ষয়ক্ষতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।

আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া আরও বলেন,এমন পরিস্থিতিতে পাহাড়ি এলাকার মাটি আলগা হয়ে যায়।আর বর্ষাকালে বৃষ্টি বেশি হলে ওই মাটি ধসে পড়ে।

ঢাকায় ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা:-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের হিসাবে,গত ৪৮৫ বছরে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ভেতরে ও ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৫২টি মৃদু,মাঝারি ও তীব্র মাত্রায় ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়।এর মধ্যে মাত্র ছয়টি ভূমিকম্প হয়েছিল ঢাকা ও এর আশপাশে।গত এক যুগে ঢাকার আশপাশে মোট আটটি ভূমিকম্প হয়েছে।এসব ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল নারায়ণগঞ্জ,ময়মনসিংহ,মানিকগঞ্জ,নরসিংদী ও দোহারে।এর আগের ভূমিকম্পের বেশির ভাগ কেন্দ্রস্থল ছিল সিলেট ও চট্টগ্রাম এলাকায়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের হিসাবে,সবচেয়ে তীব্র ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা ও সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকা।

ঢাকার পাশে টাঙ্গাইলের মধুপুর অঞ্চলের নিচেও একটি চ্যুতি রয়েছে,সেটির নাম মধুপুর চ্যুতি।এই চ্যুতিরেখায় ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়বে বলে উঠে এসেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এক সমীক্ষায়।আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের’ রাজউক অংশের আওতায় ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল সময়ে করা সমীক্ষাটিতে বলা হয়,দিনের বেলায় ওই মাত্রার ভূমিকম্প হলে মারা যাবেন ২ লাখ ১০ হাজার মানুষ।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন,চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে রাজধানীর ভবনগুলোকে ভূমিকম্পন–সহনশীলভাবে তৈরি করা এবং সচেতনতামূলক প্রস্তুতি বাড়াতে হবে।

আরও খবর

Sponsered content