জাতীয়

ভূমিহীন এক কৃষক পরিবারের ছেলে পিরু মোল্লা ৪০তম বিসিএস ক্যাডার হয়েছে

  প্রতিনিধি ৮ অক্টোবর ২০২৩ , ১২:৩৯:১৮ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।ফরিদপুর জেলার সোহানপুর ভূমিহীন এক কৃষক পরিবারের ছেলে পিরু মোল্লা ৪০তম বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন।এই অবস্থানে আসতে তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে নানান বাধা-বিপত্তি।একসময় বাবা-ভাইদের সঙ্গে অন্যের জমিতে সেচ দেওয়া,চুক্তিতে ধান-পাট কাটা,ক্ষেত নিড়ানি দেওয়াই ছিল তার পরিবারের প্রধান আয়ের উৎস।ঝড়-বৃষ্টির রাতে ছনের ঘরের চালা উড়ে যাওয়ার ভয়ে ঘুম হতো না তার।সেই অবস্থান থেকে আজ তিনি সহকারী মহাহিসাবরক্ষক, সংযুক্ত আছেন ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাডেমিতে (ফিমা)।তার এই গল্প শুনেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ডেকে নিয়ে কথা বলেছেন তার সঙ্গে।

রবিবার (৮ অক্টোবর) সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বিসিএস কর্মকর্তাদের ৭৫তম বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সের সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে স্বপ্নবাজ এই তরুণের গল্প শোনেন প্রধানমন্ত্রী।

অনুষ্ঠানে চার জন বিসিএস ক্যাডার তাদের অনুভূতির কথা ব্যক্ত করেন।এদের মধ্যে পিরু মোল্লাও একজন।তিনি বলেন,আজ আমি স্বপ্নপূরণ ও ভাগ্য বদলের গল্প বলতে এসেছি।এই স্বপ্নপূরণ আমার মতো হাজারও চাকরিপ্রত্যাশী তরুণের।এই ভাগ্যবদল চিরায়ত বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোটি প্রাণের।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে পিরু মোল্লা বলেন, ‘আমার ইচ্ছা ছিল প্রকৌশলী হওয়ার।কিন্তু বিজ্ঞান বিভাগের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যেতে পারবো কিনা,সেই আশঙ্কা ছিল।আমার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার স্বপ্নটা প্রায় শেষই হতে যাচ্ছিল,যদি না রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান ও ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার সুযোগ পেতাম। কেননা,অর্থের অভাবে কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোথাও আমি ভর্তি পরীক্ষার ফরম তুলতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবর্ষে পড়ার সময় মাঝে-মধ্যেই আমার ভাইয়ের সঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজে যেতে হতো।টিউশনি না পাওয়া পর্যন্ত প্রথমবর্ষে বেশিরভাগ সময় আমি সকালে নাস্তাও করতে পারিনি।হলে ১৫ টাকায় দুপুরের খাবার,আর ১২ টাকায় রাতের খাবার; এই মোট ২৭ টাকায় দুবেলা খাবারের খরচ মিটতো।রাতের খাবার থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত প্রায় ১৮ ঘণ্টা না খেয়ে থেকে… আমার মনে আছে,ল্যাব থেকে আসার সময় ক্ষুধায় বাঁকা হয়ে যেতাম আমি।’

এমন একটা অনিশ্চিত জীবনে থেকে উঠে এসে আজকে প্রধানমন্ত্রীর সামনে কথা বলার সুযোগ পেয়ে আল্লাহর নিকট শুকরিয়া জানান পিরু মোল্লা।তিনি আরও বলেন,বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অসংখ্য তরুণের মতো আমারও স্বপ্ন ছিল সিভিল সার্ভিসের চাকরি।মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,সরকারি চাকরি প্রাপ্তিতে আপনি মেধাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নিরপেক্ষতা,স্বচ্ছতা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন নিশ্চিত করেছেন।ফলে ৪০তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে জনগণের সেবায় নিয়োজিত হতে পেরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।’

কিন্তু পিরু মোল্লার গল্পটা তখনও শেষ হয়নি।তিনি বলেন, ‘২০২০ সালের আগস্ট মাসের ৩ তারিখে আমার প্রথম চাকরিতে যোগদানের দিনই বাবার ফুসফুসের ক্যানসার ধরা পড়ে।এর দুই মাস আগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমার ভগ্নিপতি মারা যান।সন্তানসম্ভবা বোন ও তার দুই সন্তানের ঠাঁই হয়েছিল আমাদের পরিবারে।চরম আর্থিক সংকটে যখন আব্বার চিকিৎসা প্রায় বন্ধ,তখন সরাসরি আপনার কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম।আশা ছিল হয়তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাড়া পাবো।কিন্তু এত দ্রুত সাড়া পাবো,এটা ছিল কল্পনাতীত। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক আমার বাবাকে ফোন করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য প্রদানের খবরটি জানান।কিন্তু চিকিৎসা শুরুর মাত্র ১৫ মাস পরেই আমার আব্বা মারা যান।এর কিছু দিন পর মেজো ভাই ও বিধবা বোনের শরীরেও ক্যানসার শনাক্ত হয়।পরিবারের মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনিই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।আমাদের বিপদে সাহায্যকারী হিসেবে বারবার আবির্ভূত হওয়ায় মমতাময়ী প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগ পেয়ে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি।’

দেশের উন্নয়নে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে বিশ্বের দরবারে নতুন রূপে পরিচিত করেছেন বলেও উল্লেখ করেন তরুণ এই কর্মকর্তা।তিনি বলেন,পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দক্ষিণবঙ্গের মানুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছেন।আমি গ্রামে যাই পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে ফেরিতে পদ্মা পাড়ি দিয়ে ঢাকায় আসার পথে বলতাম,আব্বা,আর কয়টা দিন কষ্ট করেন। ইনশাআল্লাহ,কেমো থেরাপির এই ধকল নিয়ে আপনাকে আর ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।সেই প্রমত্ত পদ্মা এখন চোখের পলকে পাড় হয়ে যাওয়ার সময় অনুভব করতে পারি,আপনি কীভাবে এ দেশের মানুষের চিরায়ত দুঃখের গল্পগুলোকে আনন্দের আখ্যানে পরিণত করেছেন।’

পিরু মোল্লা বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে এ দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ তথা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরের যে নিরন্তর প্রচেষ্টায় আপনি আত্মনিয়োগ করেছেন,আপনাকে আমরা কথা দিতে চাই,আমরা হবো সেই স্বপ্নরথের সারথি। অজপাড়াগাঁয়ের ভূমিহীন কৃষকের যে ছেলেটি আজ প্রজাতন্ত্রের নবীন কর্মচারী,জাতির ঋণ পরিশোধের সামান্য সুযোগও সে হাতছাড়া করবে না,ইনশাআল্লাহ।’

পরে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনাদের প্রশিক্ষণকে দেশের মানুষের জন্য ব্যবহার করতে হবে।কারণ,আমরা যে টাকায় চলি,সেটা কৃষকদের পরিশ্রমের কারণেই আসে।রোদে পুড়ে,বৃষ্টিতে ভিজে তারা আমাদের জন্য পরিশ্রম করেন।সুতরাং তাদের সেই পরিশ্রমকে মাথায় রাখতে হবে।’

আরও খবর

Sponsered content