ব্যবসা ও বাণিজ্য সংবাদ

বিশ্বের ৭৬ দেশে রপ্তানি হচ্ছে কচুরিপানা,হোগলা,তাল ও খেজুরপাতা দিয়ে তৈরি পন্য

  প্রতিনিধি ১৯ মার্চ ২০২৩ , ২:৪৮:০০ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।কচুরিপানা,হোগলা,তাল ও খেজুরপাতা দিয়ে তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব বাহারি সব পণ্য।এসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ৭৬ দেশে।এতে বছরে আসছে প্রায় একশ কোটি বৈদশিক মুদ্রা।পাবনার দাশুড়িয়ার পাশে মুনশিদপুর গ্রামে ‘বিডি ক্রিয়েশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে তৈরি হচ্ছে এসব পণ্য।প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করছেন ২০ গ্রামের আট শতাধিক নারী-পুরুষ।এছাড়া আশপাশের অনেক মানুষ বাড়িতে বসে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে এখানে সরবরাহ করেন।

সরেজমিন দেখা গেছে,কারখানাটির কাঁচামালের সবই বলতে গেলে অবহেলিত।যেগুলোর অধিকাংশই জ্বালানি বা গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।কচুরিপানা তো মাঠ ও জলাশয়ের জন্য রীতিমতো ক্ষতিকর।অথচ অনাদর অবহেলার এসব দ্রব্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে চমৎকার সব পণ্য।

এসব পণ্য তৈরিতে এলাকাজুড়ে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। কারখানার আশপাশ থেকে আসছে কচুরিপানা,তালপাতা ও বেত। শন সংগ্রহ করা হয় কুষ্টিয়া থেকে। খেজুরপাতা আসে যশোর থেকে। ভোলা থেকে আসে হোগলা পাতা।সেসব পাতা এনে শুকিয়ে প্রসেসিং করা হয়।হোগলা পাতার সুতা তাদের অন্য একটি শাখায় তৈরি করা হয়।সুতা প্রসেসিংয়ের জন্য হ্যান্ডলুম সেকশনও রয়েছে।

হোগলা পাতার সুতা,বেত,কচুরিপানা,খেজুরপাতা দিয়ে প্রশিক্ষিত নারীরা টব,পাটি,ফুলঝুড়ি,ডিম রাখার পাত্র, ডাইনিং টেবিলের ম্যাট,ঝুড়ি,লন্ড্রি বাস্কেট (কাপড় রাখার ঝুড়ি),ডগ হাউজ (কুকুরের ঘর),ক্যাট হাউজ (বিড়ালের ঘর),ট্রি-প্ল্যান্টার (গাছ লাগানোর পাত্র),ল্যাম্প,পাপোশ ও ফ্লোর ম্যাটসহ বাহারি সব পণ্য তৈরি করেন।একেকটি সেকশনে একেক রকম পণ্য তৈরি হচ্ছে।যে কর্মীরা যে পণ্য তৈরিতে পারদর্শী তারা সেই পণ্য তৈরি করেন।

বিডি ক্রিয়েশন নামের এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছেন ঈশ্বরদীর বাসিন্দা মুস্তফা আহম্মেদ (৪৫)।তিনি দেড় দশক আগে কর্মসংস্থানের জন্য দেশের বাইরে গিয়েছিলেন।সেখানে তিনি দেখতে পান সেখানকার মানুষ পরিবেশ সচেতন।তারা পরিবেশের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর প্লাস্টিক বর্জন করছে।তার পরিবর্তে পাট বা অন্য পচনশীল দ্রব্য দিয়ে তৈরি নিত্যপণ্য ব্যবহার করছে।সেগুলোর চাহিদাও তুঙ্গে।তিনি তখন ভাবেন দেশে কতই না ফেলনা দ্রব্য রয়েছে!যেগুলোর সর্বশেষ গন্তব্য মাটির চুলা।সেটা কাঁচামাল হিসেবে গ্রহণ করেন তিনি।আর গ্রামের নারীদের বানান শ্রমিক।

এরপর দেশে ফিরে যশোরের বেলাল হোসেনকে (৫৬) সঙ্গে নিয়ে যৌথ পুঁজি দিয়ে গড়ে তোলেন ‘বিডি ক্রিয়েশন’ নামের কারখানাটি।১২ বছর আগে ২০১১ সালে ঢাকার গাজীপুর থেকে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।এখন পাবনা ও যশোরসহ মোট ৯টি কারখানায় বিভিন্ন পণ্য তৈরি হচ্ছে।প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান হয়েছে অন্তত ২০ হাজার মানুষের।

কারখানায় কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,কারখানাটি চালুর আগে তারা বেকার ছিলেন।এ কারখানায় কাজ পেয়ে সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়েছেন।কেউ স্বামীর হাতে কিছু বাড়তি টাকা দিয়ে সহযোগিতা করছেন, কেউ সন্তানদের পড়াশোনার খরচ জোগাচ্ছেন।

হাজারিপাড়া গ্রামের রুনা আকতার একজন দক্ষ কর্মী। কারখানা থেকে তিন-চার কিলোমিটার দূরে তার বাড়ি।এক ছেলে ও এক মেয়ে।চার বছর তিন মাস হলো তিনি এখানে কাজ করছেন।

তিনি জানান,সংসারে এখন অনেক উন্নতি হয়েছে।মেয়ে এসএসসি পাস করেছে।ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে।তাদের পড়াশোনায় সাহায্য করতে পারছেন।মাস শেষে স্বামীর হাতে কিছু টাকাও তুলে দিতে পারছেন।শুধু তিনি নন,তার আশপাশের বাড়ির অনেক নারীও কাজ করছেন।

হ্যান্ডলুম সেকশনের দক্ষ কর্মী বিলকিস নাহার।পাঁচ বছর ধরে কাজ করছেন।তিনি দাশুড়িয়ার পাশে নওদাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা।তার চার মেয়ে। তিন মেয়ে লেখাপড়া করছে। স্বামীকেও সহযোগিতা করতে পারছেন বলে জানান।

নাটোরের মেহেদী হাসান রানা (২৪)।তিনি কাজ করছেন পাঁচ বছর ধরে।এখন হ্যান্ডলুম সেকশনের সুপারভাইজার হিসেবে রয়েছেন।

হ্যান্ডলুম সেকশনের ইনচার্জ আব্দুল হাকিম জানান,এখানে যেসব সামগ্রী তৈরি হয় তার সবই বিদেশে যায়। তার সেকশনে পাট দিয়ে পাপোশ তৈরি হয়।এর শতভাগ সুতা। এখানে কাজ পেয়ে বেকারত্ব দূর করেছেন তিনি।

কারখানার সহকারী ব্যবস্থাপক এনামুল হাসান জানান, সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু সমস্যাও রয়েছে এখানে।মূল সমস্যা হলো প্রশিক্ষিত শ্রমিক সংকট।এখানে যত দক্ষ শ্রমিক রয়েছে তাদের সবাই এ প্রতিষ্ঠান থেকেই হাতে কলমে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।তাদের গড়ে তুলতে ও উদ্বুদ্ধ করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।

তিনি জানান,শুধু স্থানীয় লোকজন নয়,কারখানার সঙ্গে আশপাশের বিভিন্ন জেলার মানুষ জড়িত।শন,হোগলা পাতা, খেজুরপাতা,কচুরিপানা সংগ্রহ ও সরবরাহ করে বহু মানুষ উপকৃত হয়েছেন।

তিনি জানান,স্থানীয়ভাবে ৮০ টাকা মণ দরে কচুরিপানা সংগ্রহ করা হচ্ছে।গ্রামের বহু লোক কচুরিপানা সরবরাহ করছেন। এগুলো সংগ্রহের পর শুকিয়ে পণ্য তৈরির উপযোগী করা হচ্ছে।পরে তা দিয়েই তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ঝুড়ি।এতে একদিকে ফসলের মাঠ,খাল-বিল ক্ষতিকর কচুরিপানামুক্ত হচ্ছে,অন্যদিকে মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে।এ এলাকার কেউ কোনো দিন কল্পনাও করেননি কচুরিপানাও মণ দরে বিক্রি করে আয় করা যাবে।

বিডি ক্রিয়েশনের উদ্যোক্তা মুস্তফা আহম্মেদ বলেন,উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।ফেলনা দ্রব্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণকারী পণ্য।যেগুলো দেখতে সুন্দর আবার পরিবেশবান্ধব।এসব হস্তশিল্প যুক্তরাষ্ট্র,অস্ট্রেলিয়া,জাপানসহ ৭৬ দেশে রপ্তানি হচ্ছে।প্রতি বছর শত কোটি বৈদেশিক মুদ্রা আসছে।তিনি জানান,দেশে এসব পণ্য বিক্রি হয় না।পুরোটাই যাচ্ছে দেশের বাইরে।তাই যা আয় হচ্ছে তার সবটাই বিদেশি মুদ্রা।

পাবনা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের শিল্প নগরী কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ বলেন,পরিবেশবান্ধব এবং জ্বালানিযোগ্য দ্রব্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ঘর গৃহস্থালির জিনিসপত্র তৈরি করছে।এতে বহু লোকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। দেশের মধ্যে পণ্যগুলো বিক্রি হচ্ছে না।বিক্রি হচ্ছে দেশের বাইরে।তাই বৈদশিক মুদ্রা দেশে আসছে।এমন উদ্যোক্তার সংখ্যা কীভাবে আরও বাড়ানো যায় সেটি তারা খতিয়ে দেখছেন।

আরও খবর

Sponsered content