জাতীয়

বর্তমানে প্রশাসনে সবমিলিয়ে ওএসডি কর্মকর্তার সংখ্যা ৫ শতাধিক

  প্রতিনিধি ১৮ মার্চ ২০২৫ , ৪:৪২:২৭ প্রিন্ট সংস্করণ

0Shares

নিজস্ব প্রতিবেদক।।বর্তমানে প্রশাসনের শীর্ষ পদে রেকর্ড সংখ্যক কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন।একই সঙ্গে সর্বোচ্চ সংখ্যক সচিব ও সিনিয়র সচিব ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) রয়েছেন।চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে নিচের কর্মকর্তারা পদোন্নতি বঞ্চিত হচ্ছেন।অন্যদিকে বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তাকে ওএসডি করে রাখায় তাদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে।এতে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন,বর্তমান সরকার একটি বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছে।এটি স্বাভাবিক অবস্থা নয়।আওয়ামী লীগ সরকারের চরম দলীয়করণ ও নিয়ম-নীতিহীন পদায়ন-পদোন্নতির কারণে নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।এ পরিস্থিতির প্রয়োজনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।একই সঙ্গে গত সরকারের সময় শীর্ষ পদে থাকা বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তাকে ওএসডি থাকতে হচ্ছে।পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ কমে যাবে।

ওএসডি ব্যবস্থা গত আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের চরম উদাহরণ সৃষ্টি করে।ভিন্নমত কিংবা যারা অন্ধভাবে তাদের নির্দেশনা মানেননি-এমন কর্মকর্তাদের বছরের পর বছর ওএসডি করে রাখা হয়।অনেকেই ওই অবস্থায়ই নীরবে চোখের জল ফেলে চাকরি থেকে বিদায় নিয়েছেন।- জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলাদের মত

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। ওইদিনই বিলুপ্ত হয় মন্ত্রিসভা।পরদিন ৬ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি।এরপর গত ৮ আগস্ট শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী আমলাদের ওএসডি করা হয়,অনেককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।একই সঙ্গে গত সরকারের সময়ে বঞ্চিত আমলাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা হয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী,বর্তমানে সচিব, সিনিয়র সচিব ও সমমর্যাদার পদ রয়েছে ৮৪টি।এর মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব,প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিবসহ সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে ১৭ জন কর্মকর্তা চুক্তিতে রয়েছেন।এর আগে শীর্ষ পদে একসঙ্গে এত সংখ্যক কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাননি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

অন্যদিকে সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে মোট ওএসডি আছেন ১২ জন।তবে বর্তমানে প্রশাসনে সবমিলিয়ে ওএসডি কর্মকর্তার সংখ্যা ৫ শতাধিক।

বেশি চুক্তিতে নিয়োগ দিলে যারা নিচ থেকে উপরে উঠে আসার জন্য অপেক্ষা করছে,তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। তাই চুক্তি কমিয়ে আনতে হবে।আর ওএসডিতে থাকা কর্মকর্তাদের যারা অন্যায় কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, তাদের কাজে লাগানো যেতে পারে।সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী,প্রশাসনে মোট ওএসডি আছেন ৫১৬ জন,এর মধ্যে ১২ জন সিনিয়র সচিব ও সচিব।মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন,এর আগে কখনো এত বেশি সংখ্যক সচিবকে ওএসডি রাখা হয়নি।

এছাড়াও দুজন গ্রেড-১ কর্মকর্তা,৩৩ জন অতিরিক্ত সচিব, ৭৬ জন যুগ্মসচিব,১৩৬ জন উপসচিব,১৫৫ জন সিনিয়র সহকারী সচিব,৯৪ জন সহকারী সচিব এবং আটজন সিনিয়র সহকারী প্রধানকে ওএসডি করা হয়েছে।

গত ৫ আগস্টের পর প্রশাসনিক কারণে ১২১ জন কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে।বাকি কর্মকর্তারা পদোন্নতি,প্রশিক্ষণ, ছুটি এবং প্রেষণের মতো কারণে ওএসডিতে রয়েছেন বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে।

ওএসডি ব্যবস্থায় মূলত কোনো কাজ করানো ছাড়াই বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তাকে বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগসুবিধা দিতে হচ্ছে সরকারকে।এই পুরো টাকাই অপচয় বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা।

তারা বলছেন,ব্রিটিশ আমলে বিশেষ কাজ সম্পাদনের জন্য চালু করা ওএসডি ব্যবস্থা গত আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের চরম উদাহরণ সৃষ্টি করে।ভিন্নমত কিংবা যারা অন্ধভাবে তাদের নির্দেশনা মানেননি-এমন কর্মকর্তাদের বছরের পর বছর ওএসডি করে রাখা হয়। অনেকেই ওই অবস্থায়ই নীরবে চোখের জল ফেলে চাকরি থেকে বিদায় নিয়েছেন।

গত ৫ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কোনো কর্মকর্তাকে ওএসডি না করার জন্য সুপারিশ করা হলো।কোনো ওএসডি কর্মকর্তাকে কাজ না দিয়ে বেতন-ভাতা দেওয়ার পরিবর্তে তাদের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে শিক্ষকতা বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সাময়িকভাবে পদায়ন করা যেতে পারে।

প্রশাসনে শূন্য পদ ছাড়া পদোন্নতি বন্ধের সুপারিশ
বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চাকরির বয়স ৫৯ বছর।আর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়স ৬০ বছর। একজন প্রশাসন বিশেষজ্ঞ বলেন,বিশেষায়িত ও কারিগরি পদের ক্ষেত্রে যেখানে দক্ষ লোকের সংখ্যা খুবই কম সেখানে শুধু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।কিন্তু আওয়ামী লীগের গত ১৬ বছরের শাসনামলে দেখা গেছে,যাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তারা কেউই ওইসব পদে অপরিহার্য নন।মূলত কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। চাকরির মেয়াদ শেষে আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের পুরস্কার ছিল চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ।

শীর্ষ পদে চুক্তিতে আছেন যারা
প্রশাসনে চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন- মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশিদ,প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া,স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমুল গনি,পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সিনিয়র সচিব) এম এ আকমল হোসেন আজাদ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান,মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ,সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হক,নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ,প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. নেয়ামত উল্লাহ ভূইয়া,ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদ,মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের,নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ,তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী।

এছাড়া ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান (সচিব) এ জে এম সালাহউদ্দিন নাগরী,পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) কাইয়ুম আরা বেগম,বিশ্বব্যাংকে বিকল্প নির্বাহী পরিচালক শরীফা খান,সচিব মর্যাদায় পর্তুগালে বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত মো. মাহফুজুল হক চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন।এরা সবাই গত বছরের ৫ আগস্টের পর নিয়োগ পেয়েছেন।

ওএসডি সচিব ১২ জন
৮৪ জন সিনিয়র সচিব,সচিব ও সমমর্যাদার কর্মকর্তার মধ্যে ১২ জন ওএসডি সচিব রয়েছেন।ওএসডি সিনিয়র সচিবদের মধ্যে রয়েছেন- মো. মোস্তফা কামাল,মো. মশিউর রহমান, মো. মনজুর হোসেন।

এছাড়া ওএসডি সচিব মো. সামসুল আরেফিন,মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন,মো. আজিজুর রহমান,মো. নুরুল আলম, মো. খায়রুল আলম শেখ,ফরিদ উদ্দিন আহমদ,রেহানা পারভীন, শফিউল আজিম, এ কে এম মতিউর রহমান।

ভোটের দায়িত্বে থাকা ডিসিদের ওএসডি
আওয়ামী লীগের সময়ে ২০১৪,২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারদের (এসপি) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।

প্রাথমিকভাবে ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন ৩৩ জন কর্মকর্তাকে গত ১৯ জানুয়ারি ওএসডি করা হয়েছে।এরা যুগ্ম সচিব হিসেবে বিভিন্ন দপ্তরে দায়িত্ব পালন করছিলেন। একই কারণে এর আগে ১২ জন কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়।তবে বিতর্কিত নির্বাচনে ডিসি ও এসপি থাকা কর্মকর্তাদের যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছর বা এর বেশি হয়েছে তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।সেই অনুযায়ী ২০ জানুয়ারি ২২ জন সাবেক ডিসিকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।

কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসর,ওএসডি না করার সুপারিশ
সর্বশেষ ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা ডিসিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

এ বিষয়ে সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন,এখন তো একটা ক্রান্তিকাল।আগের সরকার দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকা এবং ওই সময়ে নিয়মকানুন না মানা; পদায়ন ও পদোন্নতি যদি জ্যেষ্ঠতা,সততা,দক্ষতা, সুনাম এগুলোর ভিত্তিতে করতো, তবে এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে,সেটা হতো না।ঝড় যখন আসে মন্দের সঙ্গে কিছু ভালোও কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়।কারণ তখন যাচাই-বাছাই করার সময় পাওয়া যায় না।সেই কারণে হয়তো ওএসডির সংখ্যাটা বেড়ে গেছে।’

তিনি বলেন,সরকার যে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করবে-কাকে কাজে রাখা দরকার,কাকে দরকার নেই,এ সরকারের সেই সময়ের অভাব আছে।কিন্তু কাজ করতে হলে তাদের লোকও দরকার।সেই কারণে চুক্তিতে নিয়োগের সংখ্যাও বেড়েছে।’

‘মূলত একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কারণে প্রশাসনে এ অবস্থাটা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।এটা এড়ানো কঠিন।তবে ধীরে ধীরে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করা উচিত।চুক্তিটা কমিয়ে দিয়ে ওএসডি কর্মকর্তাদের যাচাই-বাছাই করা উচিত।’

সাবেক এ সচিব আরও বলেন,বেশি চুক্তিতে নিয়োগ দিলে যারা নিচ থেকে উপরে উঠে আসার জন্য অপেক্ষা করছে, তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়।তাই চুক্তি কমিয়ে আনতে হবে। আর ওএসডিতে থাকা কর্মকর্তাদের যারা অন্যায় কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না,তাদের কাজে লাগানো যেতে পারে।’

আবদুল আউয়াল মজুমদার আরও বলেন,এ মুহূর্তে প্রশাসনের পরিবর্তনটা আমূল।সেখানে একটা বিরাট অনাস্থা তৈরি হয়ে আছে।আগের সরকারে যারা কাজ করেছেন,এই সরকার তাদের আস্থায় নিতে পারছে না।যাচাই-বাছাই করে এটাকে সেইপে (কাঠামো) আনতে সময় লাগবে।’

তিনি বলেন,আমাদের দেশে যেরকম ওএসডি ব্যবস্থা,সেটি পৃথিবীর কোনো দেশে নেই।আর ওএসডি সরকারের একটি মহা অপচয়।সিস্টেমে হতাশা তৈরি হয়,বিরূপ প্রভাব পড়ে। এটা আর্থিক,নৈতিক সবদিক থেকেই নেতিবাচক।এটার কোনো ইতিবাচক দিক নেই।তাই এটি বন্ধ করতে হবে।’

0Shares

আরও খবর

Sponsered content

0 Shares