বিনোদন

ববিতার সেই অভিযোগের ভিত্তিতে নারী নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয় গুলশান থানায়

  প্রতিনিধি ১৭ ডিসেম্বর ২০২২ , ৯:১৫:৪৬ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।ভারতীয় সিনেমার চিরসবুজ নায়ক দেব আনন্দের ব্যাপারে বোম্বের (মুম্বাই) আদালতের একটি অদ্ভুত নির্দেশনা ছিল, তিনি কালো পোশাক পরে পথে বেরোতে পারবেন না। কারণ, কালো পোশাক পরলে তাঁকে দুর্দান্ত দেখাত। এমনিতেই স্মার্ট, সুপুরুষ তিনি। তার ওপর গায়ের উজ্জ্বল রং আরও ফুটত কালো রঙের বৈপরীত্যে। চোখের সামনে এ রকম ঝকঝকে চেহারা দেখে নারীকুল আকসার দুর্ঘটনা ঘটাত। নিজেকে সামলাতে না পেরে বাড়ির ছাদ অথবা বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিয়েছেন, এমন নজিরও ছিল। সেই জনপ্রিয়তার লহর ঠেকাতে শেষ পর্যন্ত আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল।

এ তো গেল ওপারে দেব আনন্দের গল্প।এপারে, বাংলাদেশে, এক নায়িকাকেও কম নাকাল হতে হয়নি।এক পাগল ভক্তের উপদ্রব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে কিছুদিন তিনি আড়ালে চলে যান,এরপর গোপনে চলাফেরা শুরু করেন।এতেও কাজ না হওয়ায় নিজের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে ওঠেন ভাড়া বাড়িতে। তারপরও নিস্তার নেই,শেষ পর্যন্ত সেই ভক্তের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে তাঁকে জেলে পাঠান।

আসলে তারকাখ্যাতির বিড়ম্বনাও অনেক।তাঁরা কোথায় যাচ্ছেন,কী করছেন,সেসব নিয়ে কোনো কোনো ভক্তের আগ্রহ সীমা ছাড়িয়ে যায়।তারকাদের ব্যক্তিগত জীবনের ছোট-বড় বহু ঘটনাও তখন চলে আসে সবার সামনে।যাঁকে নিয়ে এতক্ষণের এই অবতারণা,তিনি আর কেউ নন,এপারের কিংবদন্তি নায়িকা,সত্যজিৎ রায়ের অনঙ্গ বউ ববিতা।

আজকের গল্পটা শুরুর আগে ববিতার ঠিকুজিটা একটু ঝালাই করে নিই।তাঁর পুরো নাম ফরিদা আক্তার পপি।জন্ম ১৯৫৩ সালের ৩০ জুলাই,যশোরে।কিন্তু বড় হয়েছেন পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায়।বাবা নিজামুদ্দীন আতাউর ছিলেন সরকারি চাকুরে,মা বেগম জাহানারা চিকিৎসক।১৯৬৮ সালে পপির অভিনয়জীবনের শুরু।বড় বোন সুচন্দার স্বামী চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হানের উৎসাহে ‘সংসার’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অভিনয় জগতে নাম লেখানো।সেই ছবিতে নায়করাজ রাজ্জাক ছিলেন তাঁর বাবা আর বোন সুচন্দা অভিনয় করেন মায়ের ভূমিকায়। ‘সংসার’ ছবির পর জহির রায়হান ‘শেষ পর্যন্ত’ সিনেমায় নায়িকা করেন পপিকে।১৯৬৯ সালের ১৪ আগস্ট সিনেমাটি মুক্তি পায়।ওই দিনই পপির মা মারা যান। তখনো তিনি ববিতা হয়ে ওঠেননি, পরিচিতি পপি নামেই। ‘সংসার’-এর বছর দুয়েক পর জহির রায়হানের পরের সিনেমা ‘জ্বলতে সুরজ কি নিচে’-এর প্রযোজক আফজাল চৌধুরী আর তাঁর স্ত্রী মিলে সিনেমার নায়িকার নাম দেন ববিতা। এরপর দিনে দিনে তিনি হয়ে ওঠেন হার্টথ্রব নায়িকা, বাংলা সিনেমার প্রাণশক্তি।

জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকার সময় ববিতা চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী ইফতেখার আলমকে বিয়ে করেন।তাঁদের ঘর আলো করে আসে একমাত্র ছেলে অনিক।১৯৯৩ সালে অনিকের বয়স যখন ৩, তখনই স্বামী ইফতেখার আলম মারা যান।সেই থেকে ছেলে অনিককে ঘিরে পাক খায় ববিতার জীবন।অনিক এখন কানাডায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করে একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা।ববিতা বছরের বেশির ভাগ সময় কানাডায় কাটান,ছেলের সঙ্গে।

সেই ববিতা ২০০১ সালের ২৮ অক্টোবর রাতে গুলশান থানায় এলেন এক ভক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে।গুলশান থানার ওসি ছিলেন শরিফুল হক সিদ্দিকী।রাতের বেলা ববিতাকে থানায় দেখে তিনি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন।ববিতা একটি লিখিত অভিযোগ দিয়ে তাঁকে বললেন,এস এম জহিরুল আলম নামের এক ভক্ত তাঁর জীবন বিষিয়ে তুলেছেন।দিনে-রাতে লোকটি তাঁকে ফলো করছেন। বাড়ির আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকছেন,সময়-অসময়ে ফোন করে উল্টোপাল্টা কথা বলছেন।গৃহকর্মীদের ডেকে দামি উপহার পাঠাচ্ছেন।তাঁর অত্যাচারে বাসায় কোনো গৃহকর্মীও থাকতে পারছে না।

ববিতার সেই অভিযোগের একটি কপি পরদিন আমার হাতেও আসে।তাতে ববিতা বলেন,দুই বছর ধরে লোকটার সঙ্গে তাঁর পরিচয়।প্রথমে ভক্ত পরিচয় দিয়ে বাসায় ফোন করেন।শুরুতে ববিতা মনে করেছিলেন আর দশজন ভক্তের মতোই।কিন্তু ধীরে ধীরে লোকটি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।একদিন ফোন করে ববিতাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন।ববিতা তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর লোকটি ববিতার ছোট বোন চম্পার স্বামী সহিদুল ইসলাম জিন্নার সঙ্গে দেখা করেন।তাঁর কাছে গিয়েও বিয়ের প্রস্তাব দেন।এতেও কাজ হয়নি।একপর্যায়ে ববিতার ভাই পাইলট ইকবালের সঙ্গে দেখা করেন।পুরো পরিবারে এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে।এরপর লোকটি একটি দৈনিকে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেন,ববিতার সঙ্গে তাঁর বিয়ে পাকাপাকি হয়ে গেছে। তিনি ববিতার সঙ্গে কলকাতা বেড়াতে যাচ্ছেন।বিদেশে ঘোরাঘুরির খরচের জন্য ববিতাকে ১০ লাখ টাকাও দিয়েছেন তিনি।

ববিতা তাঁর অভিযোগে আরও বলেন,লোকটা এখন তাঁর বাসার পাশের রাস্তায় দিনরাত লোকজন নিয়ে বসে থাকছেন। বাড়ি থেকে বের হলেই তাঁকে ফলো করছেন।লোকটার অত্যাচারে তিনি নিজের বাসা ছেড়ে অন্য একটি ভাড়া বাসায় উঠেছেন। এরপর ববিতার নিজস্ব খালি বাসাটি ভাড়া নেওয়ার জন্য লোকটি নানা ফন্দি আঁটতে থাকেন।পরে ববিতা অনেক কৌশলে বাসাটি ইউএনডিপিকে ভাড়া দেন।তারপরও লোকটি পিছু ছাড়েননি।এমনকি আজ তিনি থানায় আসার সময় দেখেন,লোকটাও থানার একটু দূরে দাঁড়িয়ে।ববিতার সেই অভিযোগের ভিত্তিতে নারী নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয় গুলশান থানায়।

হাওয়ায় মিলিয়ে গেল মেয়েটিহাওয়ায় মিলিয়ে গেল মেয়েটি
মামলাটির তদন্ত করছিলেন গুলশান থানার সেকেন্ড অফিসার মকফুবার রহমান সুইট।তিনি এখন এসপিবিএনে গণভবনে কর্মরত। সুইট একদিন আমাকে বললেন,ববিতার ভক্ত এবং এই মামলার আসামি এস এম জহিরুল আলম সাধারণ কেউ নন,তিনি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের পরিচালক। এর আগে তিনি শিল্প ঋণ সংস্থায় বড় পদে ছিলেন।লোকটি তিন সন্তানের জনক,তাঁর অনেক সহায়সম্পদও আছে। আমার মনে খটকা লাগল, এ রকম একজন মানুষ কেন এই কাণ্ড করতে যাবেন!

সুইটের কাছ থেকে আসামির হদিস জানার পর গেলাম সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে।সেখানকার কর্মকর্তারা বললেন,জহিরুল তিন দিন ধরে অফিসে আসছেন না।তাঁর পিয়নের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে গেলাম লালমাটিয়ায়, জহিরুল আলমের বাসায়। তিনি বাসাতেই ছিলেন।পরিচয় পেয়ে কথাও বললেন।নিজের পড়াশোনা,পেশা,পরিবার নিয়ে কথা বললেন।জহিরুল আলমের বাড়ি শরীয়তপুরের গোসাইরহাটে। ঢাকায় বেশ কয়েকটি বাড়ির মালিক।তিন মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন লালমাটিয়ায় নিজের বাড়িতে।তিনি এমনভাবে কথা বলছেন,যেন কোনো কিছুই হয়নি।আমাকে বারবার বললেন,ববিতাকে বিয়ে করার ব্যাপারে তাঁর প্রথম স্ত্রী অনুমতি দিয়েছেন।সেটা কাগজে লেখাও আছে।আমি বললাম, এটা নিয়ে ববিতার সঙ্গে আপনার আদৌ কোনো কথা হয়েছে?তিনি বললেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর ববিতা একাই থাকতে চেয়েছিলেন।কিন্তু আমার ভালোবাসার কাছে হেরে গিয়ে বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন।চার বছর ধরে তাঁদের পরিচয়,কমপক্ষে ২০ বার দেখাও করেছেন।এর মধ্যে এক সপ্তাহ আগে লোক পাঠিয়ে ১০ লাখ টাকাও নিয়েছেন ববিতা। জহিরুল আলম এমনভাবে বলছেন যে সত্য-মিথ্যার ফারাক বোঝা কঠিন।

যাহোক,৩ নভেম্বর (২০০১) জহিরুল আলমকে গুলশান থানা-পুলিশ গ্রেপ্তার করে।তাঁকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়। আমাকে তিনি যা বলেছিলেন,রিমান্ডে এসে সেই একই কথা বলেন।রিমান্ডে থাকার সময় একবার আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম।দেখলাম,তিনি খুব স্বাভাবিক,তাঁর কথায় কোনো নড়চড় নেই।

জহিরুলকে কারাগারে পাঠানো হলো।কিছুদিন পর তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়।সেই মামলার তদন্তকারী সুইটের সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার কথা হলো,সুইট বললেন,জহিরুলের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল।কিন্তু বাদী ববিতা কোনো দিন আদালতে যাননি।বাদীর অনুপস্থিতিতে মামলা থেকে অব্যাহতি পান জহিরুল। এরপর জহিরুলের আর কোনো খোঁজ জানেন না সুইট।লোকটা কত দিন জেলে ছিলেন, তা-ও আর বলতে পারলেন না।

সেই ঘটনার রিপোর্ট করতে গিয়ে আমি দুবার ববিতার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। বৃহস্পতিবার আবার যোগাযোগের চেষ্টা করে শুনলাম,তিনি কানাডায় ছেলের কাছে আছেন।

অনেক দিন পর সেই ঘটনা নিয়ে লিখতে গিয়ে একটা মজার অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল।সেদিন লোকটার সঙ্গে কথা বলে লালমাটিয়ার বাসা থেকে বেরিয়ে আসার সময় তিনি আমার হাত ধরে খুব কাকুতি-মিনতি করে বললেন,‘ভাই, আমি সত্যিই ববিতাকে খুব ভালোবাসি।এর জন্য জেল হলেও সেটা মেনে নেব।’

জহিরুল আলমকে আমার খুব অদ্ভুত মনে হয়েছিল,কিছুটা বেয়াড়াও।আজ এত বছর পর মনে হলো,মানুষের মন বড় বিচিত্র,বড়ই নিয়ন্ত্রণহীন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা ভাঙে আবার জোড়া লাগে। সেই মন কখন,কোন দিকে বাঁক নেয়,তা বোধ হয় সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউই জানেন না।

আরও খবর

Sponsered content