সারাদেশ

পার্কগুলো নাগরিকদের কাছে এখন অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে!

  প্রতিনিধি ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ , ৩:২৭:১০ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।ঢাকা যতই বড় হচ্ছে ততই কমে আসছে দুদণ্ড স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার জায়গা।আকাশচুম্বি দালান-কোঠার ভিড়ে এই মেগাসিটিতে তবুও রয়েছে কিছু পার্ক বা উদ্যান।সময় পেলেই নগরবাসী আকাশের নিচে বসে খানিক স্বস্তির সময় কাটাতে ছুটে যান সেসব পার্কে।

রাজধানীর পার্কগুলোর মধ্যে রমনা পার্ক,সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও পান্থকুঞ্জ সরেজমিনে নানা ধরনের চিত্র উঠে এসেছে।নাগরিকদের কাছে এখন অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে এই পার্কগুলো।

সরেজমিনে দেখা গেছে,অযত্ন অবহেলায় এই পার্কগুলোর অবস্থা বেহাল।যত্রতত্র ময়লার ভাগাড়, ছিনতাইকারী, হকার এবং টোকাইদের দৌরাত্ম্য,অসামাজিক কার্যকলাপ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশসহ অপরাধীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে পার্কগুলো।

রমনা পার্ক:-রবিবার দুপুর ১২টা। মিন্টো রোডে প্রবেশের বিপরীতে রমনা পার্কের গেট। দেখা গেল গেট বন্ধ। নেই কোনো কেয়ারটেকার। ডান হাতের রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে হেয়ার রোডের গেটের দিকে এগোতেই দেখা গেল পার্কের গাছগুলোর নিচে শুয়ে আছে বেশ কিছু ছিন্নমূল মানুষ।

গেট দিয়ে পার্কে প্রবেশ করতে গেলে প্রবেশে বাধা দিল সেখানে দায়িত্বে থাকা গেটম্যান আবদুল হান্নান।জানাল, ‘সকাল ১১টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত পার্কের অভ্যন্তরে জনসাধারণ প্রবেশ নিষেধ।সাংবাদিক পরিচয় দিলে,তিনি বলেই ফেললেন ‘আপনারা ভাই লোক সুবিধার না’।কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন,করোনার পরবর্তীতে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে বিধিনিষেধ অনুযায়ী সকাল ৯টা থেকে ১১টা এবং দুপুর ২.৩০ থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত পার্কে অতিথি প্রবেশ করার নিয়ম করে দিয়েছে৷কিন্তু এই মাঝের বিরতির সময়টাতে অনেকে পার্কে প্রবেশ করার অনুরোধ করে।তাদের কাছ থেকে ১০-২০ টাকা নিয়ে প্রবেশের অনুমতি সংবাদ প্রকাশ হওয়ার কারণে বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় তাকে৷পরে অবশ্য এই গেটম্যান ঢাকা টাইমস প্রতিবেদককে পার্কে প্রবেশের অনুমতি দিল।

ঢাকা শহরের ফুসফুস হিসেবে পরিচিত এই পার্ক অনেকটা প্রাণহীন হয়ে পড়েছে।এদিন দেখা গেল,ফাল্গুনের বাতাসে পার্কের অধিকাংশ গাছের পাতা ঝরে পড়ছে অনবরত। পাতাগুলো পরিষ্কার করতে নিয়োজিত রয়েছে বেশকিছু কর্মী। কিছু কিছু গাছে আবার দেখা গেল নানা রঙের দৃষ্টিনন্দন ফুলে সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে।ভেসে আসছে কোকিলের কুহু ডাক।

এ পার্কের প্রধান আকর্ষণ রমনার বটমূল।রমনার বটমূলে রয়েছে পাথরের ওপরে বসার স্থান।যে কেউ এখানে একান্তে সময় কাটাতে পারেন।এই সময়টাতে বিধিনিষেধ থাকার পরেও দুজন এক যুগলকে চোখে পড়ল এদিন।

পাশে থাকা পার্কের পরিচ্ছনতার দায়িত্বে থাকা এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হলে তিনি ঢাকা টাইমসকে জানান,পার্কের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করছে পার্ক কর্তৃপক্ষ।পার্কের কোনো সম্পদ যেন ক্ষতি না হয় সেজন্য রয়েছে তাদের কড়া নজরদারি৷

তিনি জানান,পার্কে সাধারণত সকাল ১০টার পর থেকেই লোক সমাগম বেশি হয়।কিন্তু ১১টায় পার্কে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞার কারণে তেমন লোক হয় না।দুপুর আড়াইটায় আবার গেট চালু হয়।এসময় সাধারণত লোকজন আসে না তেমন।বিকালের পর আশেপাশের বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তারা হাটাহাটির জন্য পার্কে আসেন।

পার্কের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে নব-নির্মিত ওয়াকওয়েতে এসে চোখ জুড়াল। মনে হলো এই পার্কটির সবথেকে দৃষ্টিনন্দন জায়গা বোধহয় এটিই।

ওয়াকওয়ে দিয়ে কাকরাইল মসজিদ গেটের দিকে এগিয়ে দেখা গেল,সেগুনতলার মাঠ বিছিয়ে আছে সেগুন গাছের পাতায়।মাঠের কোনায় চোখ মেলতেই দেখা গেল শিশু উদ্যান। ঘড়ির কাটা তখন ১টা ছুঁই ছুই।এই সময়টাতে পার্কে প্রবেশে নিষেধ থাকার কারণে শিশুদের কলরবে মুখরিত থাকা এই জায়গাটাও অনেকটা প্রাণহীন মনে হলো।

এদিন পার্কে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো,সুস্থ শরীরের জন্য হাঁটার কোনো বিকল্প নেই।আর রাজধানীতে হাটাহাটি করার জন্য অন্যতম সুবিধাজনক স্থান এই পার্কটিই।গাছগাছালি, ফুল-পাখির সান্নির্ধ,বুকভরে বিশুদ্ধ নিঃশ্বাস,নির্মল হাওয়ায় সব মিলিয়ে হাঁটাহাটিঁর জন্য রমনা পার্কই উপযুক্ত জায়গা।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান:-কাকরাইল মসজিদের পাশে থাকা গেট ধরে বের হয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন৷ পাশেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশের গেট।করোনা পরবর্তীকালে রমনা পার্কে অবস্থানের সময় বেঁধে দেয়া থাকলেও এখানে প্রবেশে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।গেটে কিছু সময় দাঁড়িয়ে দেখা গেল হরদম লোকজন প্রবেশ ও বের হচ্ছে।এদের মধ্যে অধিকাংশই রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে আগত শিক্ষার্থী।

পার্কে ঢুকতেই চোখ পড়ল সাদা,সবুজ,নেভী, ব্লু রঙের শত শত তরুণ-তরুণীর জোড়া জোড়া দৃশ্য।কেউ কারও কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। কেউ সঙ্গীর সঙ্গে মোবাইলে ক্যামেরাবন্দি করছে নিজেদের একান্ত সময়।

উদ্যান ঘুরে এমন দৃশ্যই মিলল বেশিরভাগ।এর মধ্যে আবার দেখে গেল বিভিন্ন দলগত আড্ডাও।তারাও শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে অনেকেই মোবাইলে লুডো গেম খেলছে।আবার কোনো দল গিটারের সুরে সুরে বন্ধু-বান্ধবী মিলে গান ধরেছে।

কিছুটা এগিয়ে গেটের সামনে চোখে পড়ল ভিন্ন চিত্র।এখানে আসতেই নাকে আসল গাঁজা পোড়া গন্ধ।বসার জন্য নির্মিত ছোট ছোট স্থায়ী বেঞ্চগুলোতে চলছে দলবদ্ধভাবে মাদক সেবন।

তাদের একজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাঝ বয়সি ওই ব্যক্তি ঢাকা টাইমস প্রতিবেদককে বলেন,মাঝেমধ্যে তিনি মাদক সেবন করেন। এখানে মাদক সেবনে কারও কোনো কৈফিয়ত দেয়া লাগে না। এজন্য তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মাদক সেবন করতে আসেন।

এরপর টিএসসির বিপরীত গেটের দিকে এগিয়ে রাস্তার ডান পাশ দিয়ে দেখা গেল বেশকিছু ময়লার স্তুপ,আর দুর্গন্ধ। উদ্যানের দেয়াল ঘেঁষে এই সমস্ত ময়লার ভাগাড়ের বাসস্থান হিসেবে বেচে নিয়েছেন অর্ধশতাধিক ছিন্নমূল পরিবার।

এসব পরিবারের নারী,পুরুষ শিশু অধিকাংশরাই সকাল হলেই হাতে ফুল ও বালতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।আর দিনভর বেচাবিক্রি শেষে এই স্থানগুলোতে রাত্রিযাপন করে তারা।

এখানে অবস্থানরত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল,এখানে তাদের থাকতে কোন বাধা নেই।তবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কোনো অনুষ্ঠান হলে এই স্থানে অল্পদিনের জন্য ত্যাগ করতে হয় তাদের।

এদিন উদ্যান থেকে বের হয়ে মনে হলো,এই জায়গায় একাংশ বেশ পরিপাটি হলেও অন্য পাশের চিত্র পুরোপুরি বিপরীত।আর পরিপাটি অংশেও যে কেউ পরিবার নিয়ে ঘুরতে গেলে তরুণ-তরুণীদের ভিড়ে পড়তে হবে বিড়ম্বনায়।

পান্থকুঞ্জ পার্ক: বাংলামোটর মোড় থেকে কারওয়ান বাজার যেতে হাতের বা পাশে অবস্তিত পান্থকুঞ্জ পার্ক। তবে এটিকে আদৌ পার্ক বলা যাবে কি না সেই প্রশ্নও আছে। ঘুরে দেখা গেল, যত্রতত্র ময়লার ভাগাড়।

পুরোপুরি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। প্রকাশ্যে চলছে মাদক সেবন। সব মিলিয়ে যেন অসহনীয় এক পরিবেশ। পার্কে মাদক সেবন করছে এমন কজনের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, পার্ক থেকেই তারা মাদক কিনেছেন। ঘুরে দেখা গেল, ইশারাতেই বিক্রি চলছে মাদকের।

সরেজমিনে দেখা গেছে, যথেষ্ঠ জায়গা ও সবুজে ঘেরা নানা রকমের গাছগাছালি থাকার পরও যত্নের অভাব পান্থকুঞ্জ পার্কে। অথচ কর্তৃপক্ষে চাইলেই এই জাগয়াটা হতে পারে নগরবাসীর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার দারুণ জায়গা।

আরও খবর

Sponsered content