সারাদেশ

পাঁচলাইশের জাতিসংঘ পার্ক,আগ্রাবাদের ডেবার দীঘি ও চাক্তাই খাল এলাকার উন্নয়নের রূপরেখা প্রস্তাব

  প্রতিনিধি ৩ মে ২০২৩ , ৩:৩০:৫৩ প্রিন্ট সংস্করণ

মাজহারুল ইসলাম।।জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম শহরের ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম লালদীঘিতে দাঁড়িয়েই বাঙালির মুক্তির সনদ ‘ছয়দফা’ সম্পর্কে প্রথম আলোচনা করেছিলেন।এখনো লালদীঘির ময়দানে প্রবেশ করলে যেন বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের প্রতিধ্বনি শোনা যায়।অথচ বহু বছর ধরে সেই ময়দানের বড় অংশ পড়ে ছিল অবহেলা আর অযত্নে।এই ঐতিহাসিক স্থানের করুণ দশা দেখে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ আর্কিটেকচার অ্যান্ড আরবানিজম (সিআইএইউ) স্ব-প্রণোদিত হয়ে এর উন্নয়নে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়।২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়রের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিনা পারিশ্রমিকে পার্কটির পুনর্বিন্যাসের পরিকল্পনা করেন সিআইএইউ-এর স্থপতিরা। উন্নত ও আধুনিক গণপরিসর হিসেবে এতে যে সকল বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন,পরিকল্পনায় সবকিছুই যুক্ত করেছেন তারা। একইভাবে পাঁচলাইশের জাতিসংঘ পার্ক,আগ্রাবাদের ডেবার দীঘি ও চাক্তাই খাল এলাকার উন্নয়নের রূপরেখা প্রস্তাব করেছে সিআইএইউ।এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে বদলে যাবে চট্টগ্রামের গণপরিসরের চিত্র।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বিভিন্ন গবেষণাধর্মী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ আর্কিটেকচার অ্যান্ড আরবানিজম স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনার নানামুখী দিক নিয়ে কাজ করছে এবং গবেষণাভিত্তিক পরামর্শ প্রদান করছে। মানবিক ও সকলের অংশীদারিত্বভিত্তিক পরিকল্পনার পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব,সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং উদ্ভাবনী নানা চিন্তার মাধ্যমে স্থাপত্যচর্চা করছে প্রতিষ্ঠানটি।২০১৭ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের তৎকালীন চেয়ারপারসন প্রফেসর ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ নির্বাহী পরিচালক ও প্রধান স্থপতি হিসেবে সিআইএইউ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথাগত পাঠচর্চার বাইরে বাস্তবিক নগর সমস্যা সমাধানে স্থাপত্যের শিক্ষকদের সরাসরি সম্পৃক্ত করার মৌলিক উদ্দেশ্য নিয়ে সেন্টারটি গঠন করেন তিনি।ইতোমধ্যেই বেশকিছু গবেষণা প্রকল্প ও প্রস্তাবনা তৈরি করেছে সিআইএইউ,যার মধ্যে ‘চট্টগ্রাম উন্নয়ন প্রস্তাবনা’ অন্যতম।চট্টগ্রাম নগরের কয়েকটি গণপরিসরের নকশা প্রস্তাব করার আগে সিআইএইউ-এর স্থপতিরা নগরের ভৌগলিক চরিত্র,অর্থনীতির চালিকা শক্তি, সংস্কৃতি,ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে গভীরভাবে জানার চেষ্টা করেছেন।

আদনান জিল্লুর মোর্শেদের নেতৃত্বে দলটিতে কাজ করেছেন স্থপতি শাফায়েত মাহমুদ,তাহসিন রেজা আনিকা,ফয়সাল বিন শফি ও আরিজা রশিদ।তারা দেখতে পান,দেশের নগর-জনসংখ্যার প্রায় একুশ শতাংশ মানুষ বাস করে চট্টগ্রামে। জাতীয় আমদানি-রপ্তানির সিংহভাগই সংঘটিত হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। ভৌগলিক দিক বিবেচনায় পাহাড়,সমুদ্র ও নদীসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানে সমৃদ্ধ চট্টগ্রাম।অঞ্চলটির অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে রয়েছে বন্দর-সুবিধা,শিল্পায়ন, জাহাজ-নির্মাণ শিল্প,জাহাজ-ভাঙা শিল্প,মৎস্য শিল্প এবং পর্যটন।অন্যদিকে,আঞ্চলিক ভাষা,স্থানীয় গান,শিল্প-সাহিত্য, ঐতিহ্যবাহী খাবার এবং উপজাতীয় সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ চট্টগ্রাম। উল্লেখযোগ্য ও প্রাচীন অনেক স্থাপনাও সেখানে রয়েছে। এছাড়া পতেঙ্গা,বাটালি হিল,ফয়েজ লেক,সমুদ্র সৈকত ও পাহাড়ের কারণেও সেখানে ব্যাপক পর্যটকের সমাগম ঘটে। তবে যানজট,জলাবদ্ধতা,বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা,পাহাড় কাটা,ভূমি-দস্যুতা,সবুজ পরিসরের অভাব,গণপরিসরের অপর্যাপ্ততা,খেলার মাঠের সীমাবদ্ধতা চট্টগ্রামের প্রধান সমস্যা বলে মনে করেন স্থপতিরা।

সিআইএইউ-এর স্থপতিরা মনে করেন,চট্টগ্রামের এ সকল সমস্যা সমাধানে পৃথকভাবে স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন,জলাবদ্ধতা নিরসন, পাহাড় ও খাল রক্ষণাবেক্ষণ,বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে থাকবে খেলার মাঠ ও খোলা জায়গা পুনরুদ্ধার,জলাধার উদ্ধার ও সংরক্ষণ,সবুজের আচ্ছাদন বৃদ্ধি ও রক্ষণাবেক্ষণ,গণপরিসর পুনর্বিন্যাস, ফ্লাইওভারগুলোর ব্যবহার ও সংযোগকে পুনর্বিবেচনা এবং ফুটপাতের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে পথচারী-পদচারীবান্ধব নগর তৈরি করা।প্রাথমিকভাবে তাদের প্রস্তাবনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে অন্তত ১০টি খেলার মাঠ সংরক্ষণের ভাবনা,কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী উন্নয়ন,সদরঘাটের আধুনিকায়ন এবং চট্টগ্রামের ফ্লাইওভারগুলোর নিচের পরিত্যক্ত স্থানকে কার্যকর উপায়ে ব্যবহারের ধারণা।

লালদীঘি পার্ক ও ময়দান:-
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দপ্তর ‘লালকুঠি’ ও জেলখানা ‘লালঘর’-এর সন্নিকটে অবস্থিত একটি পুকুরকে ইংরেজ আমলের প্রথম দিকে দীঘিতে রূপান্তর করা হয়। এরপর পুকুরটির নাম হয় লালদীঘি।মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তরের পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পশ্চিমে পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত সমগ্র সমতল এলাকা একসময় মিউনিসিপ্যাল ময়দান নামে খ্যাত ছিল।উনিশ শতকের শেষদিকে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর একটি রাস্তা তৈরি হওয়ার পর মাঠটি বিভক্ত হয়।পূর্ব দিকের অংশ পরিণত হয় খেলার মাঠে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জহুর আহমেদ চৌধুরী ও আবুল ফজলের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনের এক গণমিছিল অগ্রসর হয়েছিল লালদীঘি ময়দানের দিকে।এখানেই ছয়দফা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।১৯০৯ সালে আব্দুল জব্বার নামের এক ব্যবসায়ী এই ময়দানে বলী খেলার প্রচলন শুরু করেন।জব্বারের বলী খেলা’ নামে এখনো তা প্রতিবছরের চৈত্র,বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য মাসে আয়োজন করা হয়। পাশাপাশি গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী নানা পণ্যের পসরা নিয়ে মেলা বসে।লালদীঘিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক কেন্দ্র, ফলে সেখানকার ব্যাংক,অফিস-আদালত, হোটেলসহ বেশকিছু স্থাপনায় ব্যাপকসংখ্যক মানুষের সমাগম ঘটে প্রতিনিয়ত।

তবে খেয়াল করলে দেখা যায়,লালদীঘির চারপাশে নিরবিচ্ছিন্ন ফুটপাতের অভাব।কিছু স্থানে সীমানা দেয়াল ও মূল সড়কের মধ্যবর্তী অংশে বাড়তি জায়গা নেই,দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে একেবারে সড়ক ঘেষে; তাই পথচারীদের রাস্তার ওপর হাঁটতে হয়।এছাড়া ড্রেনেজ সমস্যার ফলে বর্জ্য নিষ্কাশনে দীর্ঘ সময় লাগে। কয়েকটি স্থানে ড্রেনেজের সংযোগও বিচ্ছিন্ন।পার্ক ও মাঠ নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা না থাকায় অনেক জায়গা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল।

এসকল বিষয় মাথায় রেখে সিআইএইউ-এর স্থপতিরা লালদীঘির ময়দান ও ছয় দফা ঘোষণার স্থান সংরক্ষণ, চট্টগ্রামবাসীর জন্য সার্বজনীন গণপরিসর তৈরি করা এবং হাঁটার সুব্যবস্থার ওপর বিশেষ জোর দেন।মাঠের প্রবেশদ্বারের নকশায় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সালগুলো অক্ষর আকারে যুক্ত করেছেন তারা।মাঠের এক পাশে সুলতানি আমলের মসজিদ ও হিন্দুদের মন্দিরের স্থাপত্যরীতির অনুপ্রেরণার আদলে একটি মঞ্চের নকশা করা হয়েছে,যেটি বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান আয়োজনে ব্যবহার করা যাবে।

প্রস্তাবিত নকশায় দীঘি পার্কের ওয়াকওয়ে দুই স্তরে ভিন্ন উচ্চতায় বিভক্ত রাখা হয়। সীমানা দেয়ালকে বদ্ধ না রেখে এতে জালি ব্যবহারের মাধ্যমে স্বচ্ছ করা হয়েছে,যেন রাস্তা থেকে দীঘি পার্কের গাছপালা ও মাঠের সবুজ আচ্ছাদন দেখতে পাওয়া যায়। চারপাশের এলাকার সঙ্গে পার্ক ও মাঠ আরও বেশি সংযুক্ত হবে স্বচ্ছ দেয়ালের মাধ্যমে।ফুটপাতে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন গাছ রোপণ করা হবে।বিভিন্ন দেয়ালে দেয়ালচিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হবে চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। টাইলসও ডিজাইন করা হয়েছে চট্টগ্রামের মানচিত্রের আদলে।

সম্প্রতি সরকারের শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর লালদীঘি ময়দানে নিজেদের নকশায় ছয় দফা মঞ্চ নির্মাণ,বেশকিছু ম্যুরাল স্থাপন,সবুজায়ন,বসার পাকা চেয়ার নির্মাণ,কিডস্ জোন নির্মাণ,ফটক নির্মাণ ও দেয়ালে শিশুতোষ ছবি আঁকার কাজ সম্পন্ন করেছে।তবে এই পরিকল্পনায় চট্টগ্রামের ঐতিহ্য সম্পূর্ণ রূপে প্রতিফলিত হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে আলোচনার অবকাশ রয়েছে।

জাতিসংঘ পার্ক:-
১৯৬৪ সালে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে গণপূর্ত বিভাগের উদ্যোগে এক একর জায়গায় একটি পার্ক গড়ে তোলা হয়।২০০২ সালে এটিকে ‘জাতিসংঘ পার্ক’ হিসেবে নামকরণ করা হয়। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে পার্কের একাংশে দুটি সুইমিং পুল এবং একটি জিমনেশিয়াম নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং তা শেষ হয় ২০১৫ সালে।কিন্তু পরিচর্যার অভাবে পড়ে থেকে এগুলো এখন ব্যবহারের অনুপযোগী।পার্কের ভেতরে বিভিন্ন অংশে দীর্ঘদিন ধরে মাটির স্তূপ জমে আছে।ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকার পাশাপাশি জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে পড়েছে সীমানা দেয়াল।ভেতরে হাঁটার পথেও পানি জমে থাকে।গেটও বন্ধ।ফলে সবমিলিয়ে পার্কটি এখন একটি পরিত্যক্ত স্থান।সম্প্রতি এই পার্কের জন্য নতুন করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

চট্টগ্রাম নগরীর জনসংখ্যার তুলনায় বিনোদনের সুযোগ-সুবিধা অপ্রতুল,তাই সাধারণ মানুষ মনে করেন এ ধরনের পার্ক সংস্কার করে তা দ্রুত সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া প্রয়োজন।জাতিসংঘ পার্ক পরিদর্শন করে সিআইএইউ-এর স্থপতিরা সেখানকার ড্রেনেজ সমস্যা চিহ্নিত করেন।পার্কের ভেতরে পানি জমে থাকার সমস্যা দূর করতে জমিটি অন্তত চারফুট উঁচু করার প্রস্তাব দেন।পার্কে চারদিক থেকে প্রবেশাধিকার ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সংযোগ ঘটানোর বিষয়টিতেও জোর দেন।তারা লক্ষ্য করেন,স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই পাশের এলাকায় যেতে পার্কটিকে ‘শর্টকাট’ হিসেবে ব্যবহারে অভ্যস্ত,ফলে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে একপ্রকার বাঁধা তৈরি হচ্ছে।এই সমস্যার সমাধান হিসেবে প্রস্তাবিত নকশায় ওয়াকওয়ে তৈরি করা হয়েছে আঁকাবাঁকা করে। এটি নদীমাতৃক বাংলাদেশকেও প্রতিফলিত করছে। এছাড়া বাচ্চাদের জন্য আলাদা ‘প্লে জোন’ রাখা হয়েছে।

বসার জায়গা,বাগান,এবং জিমনেশিয়ামের আধুনিকায়ন সহ বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে পরিকল্পনায়।পর্যাপ্ত পরিমাণে আলোকসজ্জায় সাজানো থাকবে পার্কটি,ফলে রাতেও এতে নিরাপদে সময় কাটানো যাবে।প্রস্তাবিত নকশায় সুইমিং পুলের পরিবর্তে থাকবে জলাধার।এটি বৃষ্টির পানি ধারণা করে জলাবদ্ধতা ঠেকাবে।পার্কের বিভিন্ন অংশে থাকবে বসে আড্ডা দেওয়ার ব্যবস্থা।চারদিকে রোপণ করা হবে চট্টগ্রামের স্থানীয় গাছপালা,যেমন-আকাশমণি,মেহগনি,কড়ই,কাঠবাদাম, জারুল ইত্যাদি।

ডেবার দীঘি:-
ব্রিটিশ আমলে খনন করা হয় ডেবার দীঘি। এর আয়তন প্রায় ১৪ একর।বর্তমানে স্থানটি আগ্রাবাদের শেখ মুজিব রোড হিসেবে পরিচিত।পানি সরবরাহের জন্য ব্রিটিশ আমলে এই দীঘি খনন করা হয়েছিল,যার সঙ্গে একটি পাম্প হাউজও রয়েছে।দেবার উত্তরে আবাসিক এলাকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রেলের কর্মচারীদের আবাসন।প্রতিবছর এই দীঘিতে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।তবে দীঘিটির দক্ষিণাংশে কিছু অবৈধ বসতি গড়ে উঠেছে।ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় এসব জায়গার প্রায়ই পানি জমে থাকে ও মশামাছি তৈরি হয়। বাসাবাড়ির বর্জ্যের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনা না থাকায় অনেকেই সরাসরি দীঘির কিনারায় ময়লা ফেলছে, ফলে পানিও দূষিত হচ্ছে।

বর্তমানে ডেবার দীঘির চারপাশে ১০-১২ ফুট চওড়া রাস্তা রয়েছে।এছাড়া ঢাকনাবিহীন খোলা ড্রেনের কারণে সেটি অপরিচ্ছন্ন হয়ে থাকে। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত পাম্প হাউজটিও এখন পরিত্যক্ত।সিআইএইউ-এর স্থপতিদের নকশায় পুরো দীঘির চারপাশের ড্রেনেজ নেটওয়ার্কের কার্যকারিতার উন্নয়নের পাশাপাশি ঘাট নির্মাণ এবং গণপরিসর তৈরির প্রস্তাব রাখা হয়েছে।এছাড়াও ব্রিটিশ আমলের বেশকিছু স্থাপনা ও পুরনো ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার কথা বলেছেন তারা। দীঘির চারপাশে থাকবে ওয়াকওয়ে,ছোটবড় গাছপালা,এবং নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর বসার জায়গা।আবাসিক এলাকার পাশের রাস্তায় সবুজ লতাপাতার দেয়াল তৈরি করে দীঘির পরিসর আলাদা করা হবে। দেবার পাড়ে পথনাটক বা ছোটখাট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জায়গা থাকবে।এছাড়া রেস্টুরেন্ট বা ফুডকোর্ট তৈরি হলে এলাকাটি আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে।

চাক্তাই খাল:-
চট্টগ্রাম নগরের পানি নিষ্কাশনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল চাক্তাই খাল।খালটি বহদ্দারহাট মোড় থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার পথ ঘুরে নগরের চাক্তাই এলাকায় কর্ণফুলী নদীতে মিশেছে।এক সময় এই খালে নৌকা চলাচল করতো। ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে নৌকায় মালামাল পৌঁছে দেয়া হতো খাতুনগঞ্জ থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত।এখন এই খালটি ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। খালের তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ভবন ও বস্তি। ড্রেজিং না হওয়ায় খালটি মৃতপ্রায়।এখন এটিই চট্টগ্রাম নগরীর বড় অংশের জলাবদ্ধতার কারণ।

চাক্তাই খালের পাড়ের বেশ বড় অংশ দখল করে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট দোকানপাট।এসব দোকানের নিচে খালের পানিতে জমছে ময়লা-আবর্জনা।এছাড়া খালের গভীরতা ও প্রশস্ততা কমে যাওয়ায় পানি নিষ্কাশন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিবছরের বর্ষা মৌসুমে খালের পানি উপচে দুই পাড়ের এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।

চাক্তাই খাল সংস্কারের প্রস্তাবে সিআইএইউ-এর স্থপতিরা বলেছেন,এর দুই পাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে খালকে আগের মতো প্রশস্ত করতে হবে।খননের মাধ্যমে এর গভীরতা বাড়াতে হবে।খালের কিনারা ঘেষে ওয়াকওয়ে ও ঘাট নির্মাণ করা যেতে পারে,যা সৌন্দর্যবর্ধনের পাশাপাশি নতুন করে গণপরিসর তৈরি করবে।ভেনিস বা আমস্টারডার্মের উদাহরণ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।

বামদিকের ছবিটি চাক্তাই খালের বর্তমান অবস্থার।ডানের ছবিতে সিআইএইউ-এর স্থপতিদের কল্পনা তুলে ধরা হয়েছে
বামদিকের ছবিটি চাক্তাই খালের বর্তমান অবস্থার।ডানের ছবিতে সিআইএইউ-এর স্থপতিদের কল্পনা তুলে ধরা হয়েছে
জানা গেছে,খাল সংস্কার ও জোয়ারের পানি থেকে রক্ষা একে করতে দুই হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।এর আওতায় চাক্তাই, রাজাখালী খালসহ বিভিন্ন খালের মুখে ১২টি স্লুইস গেট, পাম্প হাউস নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। দশটির অবকাঠামোগত নির্মাণকাজ শেষ হলেও এবং এখনো বাকি দুটির কাজ।চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের স্লুইস গেট এখনো চালু না হওয়ায় সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময় জলোচ্ছ্বাসে চাক্তাই বাজার,খাতুনগঞ্জ ও আসাদগঞ্জের বড় অংশ তলিয়ে গিয়েছিল।এছাড়া প্রতিবছর বর্ষায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতার সমস্যা নিরসন না হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা।তারা এর থেকে উত্তরণে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আশা করছেন।সিআইএইউ-এর স্থপতিরা প্রত্যাশা করেন,দখল উচ্ছেদ ও সংস্কারের মাধ্যমে চাক্তাই খাল আবারও আগের মতো করে প্রাণ ফিরে পাবে,দূর করবে চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা।

২০১৯ সালের জুন মাসে চট্টগ্রামের তৎকালীন মেয়র ও নগর-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় এ সকল পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ আর্কিটেকচার অ্যান্ড আরবানিজমের নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ ও প্রকল্প স্থপতি শাফায়েত মাহমুদ।এ বিষয়ে স্থপতি শাফায়েত মাহমুদ বলেন,চারটি স্থানের পরিকল্পনার ব্যাপারে আমরা সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করি।এরপর ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রামের মেয়র,চট্টগ্রাম পোর্ট অথরিটির চেয়ারম্যান,সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ,রেলপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী সহ নগর-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের সামনে আমরা আমাদের পরিকল্পনাগুলো উপস্থাপন করি।

ড. আদনান মোর্শেদ বলেন,বাসযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নগর গড়ে তুলতে প্রচলিত ধারণার পাশাপাশি ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন।নগর ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ঐতিহ্য খুবই শক্তিশালী প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।স্থাপত্য ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী সমাধান প্রদানে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি শিক্ষাবিদ,নীতিনির্ধারক ও উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে সিআইএইউ।ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে,যার প্রতিটিতেই পরিবেশ ও প্রতিবেশের স্বকীয়তা বজায় রাখা হয়েছে।চট্টগ্রাম উন্নয়ন প্রস্তাবনা’য় আমরা নগরটির সমস্যা-সম্ভাবনার কথা বিশদভাবে ভেবেছি।ইতিবাচক চিন্তা ও সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে মানবিক ও পরিবেশবান্ধব চট্টগ্রাম নগর গড়তে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

আরও খবর

Sponsered content