জাতীয়

পদ্মার ওপারে বিভিন্ন এলাকায় আরও কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ চলছে

  প্রতিনিধি ১৯ ডিসেম্বর ২০২২ , ১১:৪৪:৩৯ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে পদ্মা নদীতে সাতটি টাওয়ার বসাতে চায় বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ঢাকায় নিয়ে আসতে কোম্পানিটি এই টাওয়ার বসাতে চায়। তবে সাতটির মধ্যে মূল নদীতে প্রস্তাবিত তিনটি টাওয়ার বসানো নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ–পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।

টাওয়ার বসাতে বিআইডব্লিউটিএ অনাপত্তি দিচ্ছে না। এ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে বিসিপিসিএল ও বিআইডব্লিউটিএ। জটিলতা নিরসনে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।

টাওয়ার বসাতে আপত্তির পেছনে বিআইডব্লিউটিএ বেশ কয়েকটি যুক্তি তুলে ধরেছে। তারা বলছে, একই কাজে সঞ্চালন লাইন নির্মাণে পদ্মা সেতুর ভাটিতে দুই কিলোমিটারের মধ্যে ইতিমধ্যে সাতটি টাওয়ার বসিয়েছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)।

পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে ঢাকায় আনতে তারা টাওয়ার বসিয়েছে।নতুন করে উজানে সাতটি টাওয়ার বসাতে চায় বিসিপিসিএল। সেতুর উজান ও ভাটি—দুই পাশে টাওয়ার স্থাপনের কারণে ভবিষ্যতে এই নৌপথে চ্যানেল পরিবর্তন হয়ে যাবে।এই চ্যানেলে পলি পড়ে নাব্য–সংকট দেখা দেবে। এতে বছরে প্রায় ১০ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং করতে হবে।

বিআইডব্লিউটিএর আরও যুক্তি হলো, মূল নদীতে টাওয়ার বসানো হলে বর্ষাকালে উজান থেকে ভাটিতে যাওয়ার সময় নৌযান তীব্র স্রোত ও ঘূর্ণায়নের কারণে দুর্ঘটনায় পড়তে পারে।তীব্র স্রোতের কারণে নৌযান নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে। এতে পদ্মা সেতুর পিলারের সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে পারে।

বিআইডব্লিউটিএ বলছে,মাওয়া এলাকায় পদ্মার নৌপথটি প্রথম শ্রেণির।এই নৌপথ দিয়ে সমুদ্রবন্দর থেকে পশ্চিম ও উত্তরবঙ্গের মালামাল নিয়ে নিয়মিত মালবাহী নৌযান চলাচল করে। তা ছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী যন্ত্রপাতি এই চ্যানেল দিয়ে পরিবহন করা হয়।ফলে চ্যানেলটি নিরাপদ রাখা জরুরি।

বিআইডব্লিউটিএর অতিরিক্ত পরিচালক (নৌপথ) আবদুল মতিন সরকার বলেন, ‘আমরা বিসিপিসিএলকে মূল নদীর মাঝখানে টাওয়ার না বসাতে শর্ত দিয়েছিলাম।কিন্তু তারা মূল নদীর মাঝখানে তিনটি টাওয়ার বসাতে চায়। তারা যদি নদীর মাঝখানে টাওয়ার বসায়,সে ক্ষেত্রে পুরো চ্যানেলটি অকার্যকর হয়ে যাবে। নদীতে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাবে।এ জন্য আমরা এখনো অনাপত্তি দিইনি।সঞ্চালন লাইন নির্মাণের জন্য টাওয়ার বসানো জরুরি।আমরাও চাই টাওয়ার বসুক। তবে তা কিছুতেই পদ্মা নদীর মাঝখানে নয়।’

অন্যদিকে বিসিপিসিএলের যুক্তি হলো, পটুয়াখালীর পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র ইতিমধ্যে উৎপাদনে এসেছে।তবে সঞ্চালন লাইন না থাকায় কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ ঢাকায় আনা যাচ্ছে না।বাগেরহাটের রামপালের ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করেছে।কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট থেকে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে,যা গত শনিবার রাত থেকে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে।দ্বিতীয় ইউনিটের ৬৬০ মেগাওয়াটের কাজ দ্রুত শেষ হবে।

পাবনার রূপপুরে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ২০২৫ সালের মধ্যে পুরো মাত্রায় উৎপাদনে আসার কথা।পদ্মার ওপারে বিভিন্ন এলাকায় আরও কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ চলছে।এসব কেন্দ্রের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে।নদীর ওপার থেকে এপারে বিদ্যুৎ আনতে হলে পদ্মায় টাওয়ার বসানোর বিকল্প নেই।

বিসিপিসিএলের কর্মকর্তারা বলছেন,তারা ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংকে (আইডব্লিউএম) দিয়ে একটি সমীক্ষা করিয়েছেন।সমীক্ষায় উঠে এসেছে, পদ্মা নদীতে টাওয়ার বসালে তার প্রভাব হবে নগণ্য।এমন বাস্তবতায় জাতীয় গ্রিডে নির্বিঘ্নে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য বিসিপিসিএলকে মূল নদীতে টাওয়ার স্থাপন করতে দ্রুত অনাপত্তি দিতে বিআইডব্লিউটিএকে চিঠি দেওয়া হয়।

বিসিপিসিএলের বক্তব্য হলো,মূল নদীর যে প্রশস্ততা,তাতে বৈদ্যুতিক টাওয়ার স্থাপন না করে অতিক্রম করা সম্ভব নয়। পদ্মা নদীর মধ্যে ন্যূনতম সংখ্যক বৈদ্যুতিক টাওয়ার স্থাপনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে। এই সংখ্যা মাত্র তিনটি।

জানতে চাইলে নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক হারুনুর রশীদ বলেন, ‘পদ্মা সেতুর উজানে বৈদ্যুতিক টাওয়ার বসানোর অনুমতি না দিলে সঞ্চালন লাইন হবে কীভাবে?ওপার থেকে এপারে বিদ্যুৎ আসবে কীভাবে?টাওয়ার বসানোর বিকল্প নেই। তা ছাড়া পদ্মা সেতুর নকশায় সঞ্চালন লাইনের জন্য টাওয়ার বসানোর বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছিল।জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করে বিআইডব্লিউটিএর উচিত হবে দ্রুত সময়ে ছাড়পত্র দেওয়া।’

হারুনুর রশীদ আরও বলেন,সঞ্চালন লাইনের জন্য টাওয়ার বসানোর সিদ্ধান্ত অনেক আগের। এত দিন বিআইডব্লিউটিএ কিছু বলেনি। কিন্তু এখন তারা কেন ছাড়পত্র দিচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়।

বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, পদ্মা সেতুর ভাটিতে মূল নদীর মাঝখানে তিনটি টাওয়ার বসিয়েছে পিজিসিবি।এ কারণে নতুন নতুন ডুবোচর তৈরি হয়ে নাব্যতা সংকট তৈরি হয়েছে।নদীর মাঝখানে টাওয়ার নির্মাণ করায় এখন ব্যাপক ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হবে।

কিন্তু সরকারের কাছ থেকে এত টাকা পাওয়া যাবে না।এখন নতুন করে উজানে মূল নদীতে তিনটি টাওয়ার বসলে নদী ভরাট হয়ে নতুন নতুন ডুবোচর তৈরি হবে।এতে পুরো চ্যানেলটি পরিবর্তন হয়ে যাবে। ফলে নৌযান চলাচল ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।

বিআইডব্লিউটিএর অতিরিক্ত পরিচালক (নৌ-পথ) আবদুল মতিন সরকার বলেন,‘বিষয়টি সুরাহা করতে আমরা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি।এখন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় আন্তমন্ত্রণালয় সভা করবে।সেখানে যা সিদ্ধান্ত হবে,সেটাই কার্যকর হবে।’

সঞ্চালনের একই কাজ কেন সরকারের দুটি সংস্থা করছে,এ বিষয়ে কথা হয় বিসিপিসিএলের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে। তাঁরা জানান,দক্ষিণাঞ্চলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ঢাকায় আনতে ২০১৬ সালে আমিনবাজার-মাওয়া-মোংলা ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন প্রকল্প গ্রহণ করে পিজিসিবি।

কিন্তু কয়েক দফা মেয়াদ বাড়িয়েও এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারেনি পিজিসিবি।প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১ হাজার কোটি টাকার ব্যয় গিয়ে ঠেকেছে ২ হাজার ৫০৫ কোটি টাকায়।মূলত পিজিসিবির ব্যর্থতার কারণেই নতুন সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজটি বিসিপিসিএলকে দেওয়া হয়।

নতুন প্রকল্পের নাম পায়রা-গোপালগঞ্জ-আমিনবাজার ৪০০ কেভি ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন (দ্বিতীয় পর্যায়)।প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বিসিপিসিএল।প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হবে ৪ হাজার কোটি টাকা।

পদ্মা সেতুর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য আইনুন নিশাত বলেন,পদ্মা সেতু বানাতে গিয়ে নদীতে ৪২টি পিলার বসানো হয়েছে।বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণের জন্য পদ্মা নদীর ভাটিতে পিজিসিবি সাতটি টাওয়ার বসিয়েছে।এখন আবার নতুন করে সাতটি বসানোর প্রস্তাব এসেছে।

এতগুলো টাওয়ার নদীকে তো প্রভাবিত করবেই।তবে পদ্মা নদীর ওপর নতুন করে সাতটি টাওয়ার বসানোর আগে একটি বিস্তারিত সমীক্ষা করা দরকার।জানা দরকার,টাওয়ার বসলে কতটা প্রভাব পড়তে পারে।

আরও খবর

Sponsered content