প্রতিনিধি ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫ , ২:৪৩:৪০ প্রিন্ট সংস্করণ
তারেক রহমান ও জিয়া পরিবারের মামলা, খালাস ও নির্বাচনযোগ্যতা: আইনি বিশ্লেষণ**

মাজহারুল ইসলাম।।আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের অন্যতম প্রভাবশালী সংবাদপত্র প্রথম আলো-এর সম্পাদকীয় অবস্থান নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।নির্বাচনের আগেই বিএনপিকে কার্যত ‘বিজয়ী’ হিসেবে উপস্থাপন করার প্রবণতা সামাজিক,রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে গভীর প্রশ্ন তুলেছে—এটি কি স্বাধীন বিশ্লেষণ,নাকি রাজনৈতিক পক্ষাবলম্বন?
এক সময় প্রথম আলো বিএনপির শাসনামলের দুর্নীতি, হাওয়া ভবনের অপশাসন,২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, জঙ্গিবাদের উত্থান ও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা নিয়ে দৃঢ় ও অনুসন্ধানী অবস্থান নিয়েছিল।তখন সংবাদমাধ্যম হিসেবে তাদের ভূমিকা ছিল তুলনামূলকভাবে নিরপেক্ষ,তথ্যভিত্তিক ও ক্ষমতার জবাবদিহিমূলক।কিন্তু বর্তমান অবস্থান সেই ধারাবাহিকতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেই মনে করছেন বহু পাঠক ও বিশ্লেষক।
সম্পাদকীয় পক্ষপাত নাকি রাজনৈতিক রূচির প্রতিফলন?
পর্যবেক্ষকদের মতে,সম্পাদক মতিউর রহমানের সাম্প্রতিক অবস্থান রাজনৈতিক বাস্তবতা বিশ্লেষণের চেয়ে বিএনপির বৈধতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার মতো প্রতীয়মান হচ্ছে।এতে প্রশ্ন উঠছে—সংবাদমাধ্যম কি ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ফলাফল নির্ধারণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে?
গণমাধ্যমের নৈতিক দায়িত্ব হলো—
তথ্যভিত্তিক সংবাদ পরিবেশন
সম্ভাবনা ও বাস্তবতার পার্থক্য স্পষ্ট করা
ভোটার ও জনগণকে বিভ্রান্ত না করা
কিন্তু আগাম বিজয় ঘোষণা জনমনে বিভ্রান্তি,অনাস্থা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি সন্দেহ সৃষ্টি করছে।
তারেক রহমান ও জিয়া পরিবারের মামলা: বাস্তবতা কী?
মামলা,সাজা ও খালাস—সংক্ষিপ্ত চিত্র
সরকারি নথি ও আদালতের রায় অনুযায়ী—
তারেক রহমান ও জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার সংখ্যা: প্রায় ৩৬টি
মামলার ধরন:
দুর্নীতি
মানি লন্ডারিং
অবৈধ সম্পদ অর্জন
ক্ষমতার অপব্যবহার
অনেক মামলায় নিম্ন আদালত ও উচ্চ আদালতে সাজা প্রদান করা হয়েছিল।পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে আপিল,পুনর্বিচার ও আইনি প্রক্রিয়ায় কিছু মামলায় খালাস বা দণ্ড স্থগিত হয়।
আইনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: খালাস মানেই কি নির্বাচনযোগ্যতা?
এখানেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রশ্নটি উঠে আসে।
প্রযোজ্য আইন
Representation of the People Order (RPO), 1972
দণ্ডবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধি
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন
আইনের ভাষ্য অনুযায়ী
> কোনো ব্যক্তি সাজাপ্রাপ্ত হলে,
সাজা বাতিল বা খালাস পাওয়ার পর কমপক্ষে ৫ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তিনি সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্য নন
যদি না আদালত স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক অধিকার পুনর্বহালের নির্দেশ দেন।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে—
খালাসের তারিখ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
সব মামলায় একই সময়ে খালাস হয়নি
কিছু মামলায় সাজা স্থগিত থাকলেও রাজনৈতিক অধিকার পুনর্বহাল সংক্রান্ত স্পষ্ট আদেশ নেই
অতএব,তারেক রহমানের নির্বাচনযোগ্যতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিশ্চিত হয়েছে—এমন দাবি আইনি দৃষ্টিতে প্রশ্নবিদ্ধ।
২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও মিডিয়ার ভূমিকা
২০০৭–২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের ভূমিকা আজকের প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচিত হচ্ছে।সে সময় অনেক রাজনৈতিক পক্ষ অভিযোগ করেছিল—
মিডিয়া কিছু নির্দিষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রতি নরম অবস্থান নিয়েছিল
ড. ইউনূস সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক উদ্যোগে নীরব সমর্থন ছিল
এই অতীত অভিজ্ঞতা বর্তমান সম্পাদকীয় অবস্থানকে আরও বিতর্কিত করে তুলছে।
মিডিয়ার ওপর রাজনৈতিক ও আদর্শিক প্রভাবের অভিযোগ
প্রথম আলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে—
বিএনপি–জামাতপন্থি কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও মিডিয়া নেটওয়ার্কের চাপ রয়েছে
মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু সম্পাদক ও পত্রিকার প্রত্যক্ষ–পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে
এমনকি কিছু ক্ষেত্রে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের ওপর হামলার ঘটনাও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার ইঙ্গিত দেয়—যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য উদ্বেগজনক।
জনমনে প্রশ্ন ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ
এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করছে—
সংবাদমাধ্যম কি সত্যিই জনগণের তথ্যের নিরপেক্ষ স্রোত?
নাকি রাজনৈতিক পক্ষপাত গণমাধ্যমকে বিশ্বাসযোগ্যতা সংকটে ফেলছে?
গণমাধ্যমের প্রতি আস্থা নষ্ট হলে—
সুষ্ঠু নির্বাচন
রাজনৈতিক স্বচ্ছতা
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি
সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
উপসংহার: দায়িত্বে ফেরার সময় এখন
প্রথম আলোর সাম্প্রতিক অবস্থান কেবল একটি পত্রিকার বিষয় নয়—এটি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের নৈতিকতা, স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতার বড় পরীক্ষা।
এখন সময় এসেছে—
সংবাদমাধ্যমকে সত্য,আইন ও তথ্যের ওপর দাঁড় করানোর
আগাম রাজনৈতিক রায় নয়,বাস্তব বিশ্লেষণ তুলে ধরার
জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার
কারণ গণতন্ত্র টিকে থাকে কেবল ভোটে নয়—
নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম ও সচেতন জনমতের ওপর।

















