ব্যবসা ও বাণিজ্য সংবাদ

দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা–সংক্রান্ত টাস্কফোর্স’–এর বৈঠক

  প্রতিনিধি ১২ জুন ২০২৩ , ৩:৫২:০১ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।বিশ্ববাজারে কিছু কিছু নিত্যপণ্যের দাম যে হারে বেড়েছে,দেশের বাজারে বেড়েছে তার চেয়ে বেশি। আবার বিশ্ববাজারে কিছু পণ্যের দাম যে হারে কমেছে, দেশের বাজারে সে হারে কমেনি।দু-একটি পণ্যের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশে বাড়তি।

সচিবালয়ে গতকাল রোববার বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ‘দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা–সংক্রান্ত টাস্কফোর্স’–এর বৈঠকে আটটি পণ্যের বিষয়ে এমন পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে।তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ জন্য দায়ী মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলার–সংকট।

বৈঠকে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,স্থানীয় শিল্প সুরক্ষায় চিনি আমদানিতে উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। যদিও দেশে পণ্যটির উৎপাদন চাহিদার মাত্র ১ শতাংশ।আর দেশের পেঁয়াজচাষিদের সুরক্ষা দিতে কৃষি মন্ত্রণালয় পণ্যটি আমদানির অনুমতিপত্র (আইপি) দিতে দেরি করেছে,যার সুযোগ নিয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীরা।দেশে পণ্য বাজার ব্যবস্থাপনার কাঠামোগত ও নীতিগত দুর্বলতা রয়েছে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।

‘এ দফায় ভোজ্যতেলের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী ঈদের আগে তা আবার কমতে পারে।’
তপন কান্তি ঘোষ, বাণিজ্যসচিব।

বৈঠকে গম (আটা),চিনি,সয়াবিন তেল,পাম তেল,মসুর ডাল,পেঁয়াজ,রসুন এবং আদার উৎপাদন,দাম, সরবরাহব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। প্রতিবেদনে এক বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বৈঠকে সরকারি সংস্থা ও ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

প্রতিবেদনে উঠে এসেছে,আন্তর্জাতিক বাজারে এক বছরে গমের দাম কমেছে প্রতি টনে ৩৫ শতাংশ।অথচ দেশের বাজারে প্রতি কেজি প্যাকেটজাত আটার দাম ২৫ শতাংশ এবং খোলা আটার দাম ১৩ শতাংশ বেড়েছে।পেঁয়াজের ক্ষেত্রে চিত্রটি একই।মসুর ডালের দাম বিশ্ববাজারের চেয়ে কম হারে কমেছে দেশে।

অপরিশোধিত চিনির দাম বিশ্ববাজারে বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। কিন্তু দেশের বাজারে বাড়ার হার দ্বিগুণের কাছাকাছি—৫৮ শতাংশ।আদার দাম বিশ্ববাজারে ১৭২ শতাংশ বাড়লেও দেশের বাজারে বেড়েছে ২২২ থেকে ২৪৫ শতাংশ পর্যন্ত।

ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে।বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ৪৪ শতাংশ কমলেও দেশের বাজারে খোলা তেলের দর কমেছে ২ শতাংশ।আর পাম তেলের দাম বিশ্ববাজারে ৪৯ শতাংশ কমার বিপরীতে দেশে কমেছে ২০ শতাংশ।যদিও গতকালই বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১০ টাকা ও পাম তেলের দাম ২ টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত জানানো হয়।এখন থেকে প্রতি লিটার সয়াবিন ১৮৯ ও পাম তেল ১৩৩ টাকা দরে বেচাকেনা হবে।

বৈঠক শেষে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘এ দফায় ভোজ্যতেলের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।আগামী ঈদের আগে তা আবার কমতে পারে।’ বিটিটিসির প্রতিবেদন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হবে বলেও জানান বাণিজ্যসচিব।

‘মূল সমস্যা ডলারের দাম। ১১৬ টাকা দরে ডলার কিনতে হচ্ছে।এটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে নিত্যপণ্যের বাজারের জন্য তা খারাপ খবরই হবে।’
মোস্তফা আজাদ চৌধুরী, এফবিসিসিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি।

সরকারি-বেসরকারি ব্যর্থতাগুলো’;-?
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,দেশে পণ্য বাজার ব্যবস্থাপনার কাঠামোগত ও নীতিগত দুর্বলতা রয়েছে।ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজার তদারকিতে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করলেও জনবলের ঘাটতি থাকায় দেশব্যাপী তদারক কার্যক্রম করা যাচ্ছে না।আর বিভিন্ন পর্যায়ে কেনাবেচার কোনো নথি (রেকর্ড) সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। বাজারে রয়েছে যথাযথ প্রতিযোগিতার ঘাটতি।এ ছাড়া বাজার কমিটি ও ব্যবসায়ীদের সমিতির আরও কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে।

আরও বলা হয়েছে,নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ভর্তুকি মূল্যে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) যে তেল, চিনি ও মসুর ডাল বিক্রি করছে,তা আন্তর্জাতিক উৎসের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেও সংগ্রহ করা হচ্ছে।এটা মোট মজুতে ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে না।এ কার্যক্রম সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ভূমিকা রাখলেও তা প্রভাব তৈরি করতে পারছে না বাজারে।বাণিজ্যিক সংস্থা হিসেবে টিসিবির সক্ষমতারও ঘাটতি রয়েছে।

সরকারের নীতি হচ্ছে ব্যবসায়ীদের নীতি সহায়তা দেওয়া। দিচ্ছেও।কিন্তু মুষ্টিমেয় লোকের হাতে নিত্যপণ্যের বাজার।তাঁরা বাজারকে কুক্ষিগত করার ক্ষমতা অর্জন করেছেন।
গোলাম রহমান,ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি

আরও যত সমস্যা:-আমদানিকারকদের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়,ঋণপত্র (এলসি) খোলার সময় তাঁরা চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাননি।আবার সংকটের কারণে সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে।ফলে বেড়ে যাচ্ছে তাঁদের উৎপাদন ব্যয়।শতভাগ এলসি মার্জিনের (ঋণপত্র খোলার সময় টাকা জমার হার) কারণেও ব্যবসার খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

জাহাজ থেকে যথাসময়ে পণ্য খালাস করতে না পারা এবং খালাস দেরিতে হওয়ার কারণে পণ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়াকেও দায়ী করা হয়েছে প্রতিবেদনে।এতে আরও বলা হয়,বিশ্ববাজারে দাম কমলেও শুল্ক কর্তৃপক্ষ শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে সেটা বিবেচনায় নিচ্ছে না।বরং প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি দরে শুল্কায়ন করছে।এতে আমদানিকারকদের ক্ষতি হচ্ছে।ব্যবসায়ীরা বলছেন,এক বছরে আমদানি ব্যয় পরিশোধে বৈদেশিক মুদ্রার দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ।এ ছাড়া গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পরিবহন ব্যয় বেড়েছে।

এফবিসিসিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘মূল সমস্যা ডলারের দাম। ১১৬ টাকা দরে ডলার কিনতে হচ্ছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে নিত্যপণ্যের বাজারের জন্য তা খারাপ খবরই হবে।’

তিন পণ্যের ঘাটতি,উপায় কী?
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে ২০২২ সালের জুলাই থেকে গত মে পর্যন্ত ১১ মাসে আট পণ্যের চাহিদা,উৎপাদন,আমদানি এবং উদ্বৃত্ত বা ঘাটতির তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।এর মধ্যে ভোজ্যতেল,রসুন,মসুর ডাল ও পেঁয়াজের সরবরাহ চাহিদার চেয়ে বেশি।ঘাটতি রয়েছে চিনি,আদা ও গমের।তবে গম ছাড়া অন্য দুই পণ্যের ঘাটতির পরিমাণ বেশি নয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়,গমের বার্ষিক চাহিদা ৭০ লাখ টন ধরে ১১ মাসের চাহিদা দাঁড়ায় ৬৪ লাখ ১৬ হাজার টন।এ সময়ে ১০ লাখ টন গম উৎপাদিত হয়েছে দেশে।আর আমদানি হয়েছে ৩০ লাখ টন।ফলে সরবরাহ হয়েছে ৪০ লাখ টন। আর ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৪ লাখ ১১ হাজার টন।আদার ঘাটতি ৭৭ হাজার টন।চীন আদা রপ্তানি বন্ধ রেখেছে।চিনি আমদানি কম হয়েছে ৭২ হাজার টনের মতো।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে,এখন মিয়ানমার থেকে আদা আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হবে।চিনির এলসি খোলাও বাড়বে। তবে গমের ব্যাপারে আলোচনায় ভালো কোনো সুপারিশ আসেনি।

ভোজ্যতেলের দাম কমল,শুল্কহার কি বেশি?প্রতিবেদনে আট নিত্যপণ্যেরই শুল্কহারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।বলা হয়েছে, গম ও মসুর ডাল আমদানিতে কোনো শুল্ক নেই।তবে পরিশোধিত চিনি আমদানিতে শুল্ক-করভার ৬৭ শতাংশ, অপরিশোধিত চিনিতে তা ৬২ শতাংশ।অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেল আমদানির শুল্ক-করভার ১৫ শতাংশ।পেঁয়াজ আমদানিতে ৫ শতাংশ এবং রসুন ও আদা আমদানিতে ১০ শতাংশ করে শুল্ক রয়েছে।

বলা হয়েছে,মূল্যবৃদ্ধি বিবেচনায় ভোজ্যতেল ও চিনি আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়া হলেও সম্প্রতি তা প্রত্যাহার করা হয়েছে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরকারের নীতি হচ্ছে ব্যবসায়ীদের নীতি সহায়তা দেওয়া। দিচ্ছেও।কিন্তু মুষ্টিমেয় লোকের হাতে নিত্যপণ্যের বাজার।তাঁরা বাজারকে কুক্ষিগত করার ক্ষমতা অর্জন করেছেন।তিনি বলেন,বাজারে প্রতিযোগিতার কোনো পরিবেশ তৈরি হয়নি। দরকার হচ্ছে মিশ্র অর্থনৈতিক মডেলে নিত্যপণ্যের বাজারের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা সরকারের হাতে নেওয়া।এ ছাড়া নিত্যপণ্যের বাজার ভোক্তাদের পক্ষে আসা দুরূহ।

আরও খবর

Sponsered content