আন্তর্জাতিক

তালেবানে অভিভাবক (মাহরাম) ছাড়া অন্য পুরুষের সঙ্গে কথা বলার শাস্তি হিসেবে দোররা মারার সিদ্ধান্ত!!!

  প্রতিনিধি ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ , ১২:৫৬:০৭ প্রিন্ট সংস্করণ

অনলাইন ডেস্ক রিপোর্ট।।গত মাসের শুরুর দিকে সাদাফ (ছদ্মনাম) নামের ২২ বছর বয়সী এক তরুণীকে ‘নৈতিক অপরাধে’দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল,তিনি পুরুষ অভিভাবক (মাহরাম) ছাড়া এক পুরুষের সঙ্গে কথা বলেছেন।শাস্তি হিসেবে তাঁকে দোররা মারার সিদ্ধান্ত হয়।

শাস্তি কার্যকরের আগের রাতে সাদাফ পরিবারের সবার কাছে থেকে বিদায় নেন।বাবাকে বলেন,তার কিছু হলে যেন ভেঙে না পড়েন এবং এই প্রদেশ ছেড়ে যান।পরের দিন তাঁকে অভিযোগকারী প্রতিবেশী ব্যক্তিসহ তালেবান নেতাদের উপস্থিতিতে দোররা মারা হয়।

সাদাফ বলেন,তারা আমাকে ঘিরে ছিল।আমার হাত বাঁধা হয়। বলা হয়,চিৎকার করা যাবে না।কারণ,পুরুষদের কানে যেন বাইরের কোনো নারীর কণ্ঠস্বর না পৌঁছায়।তারপর তারা আমাকে দোররা মারতে শুরু করে।আমার বাবা আমার সামনে দাঁড়িয়ে ওই ব্যক্তিকে আমাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।আমি যে অপরাধ করিনি,তার জন্য বাবা তাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন।’

সাদাফ বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাওয়ার আগে প্রায় ৩০ বার তাঁকে দোররা মারা হয়েছিল।সাদাফের বিরুদ্ধে এই মিথ্যা অভিযোগ কেন আনা হয়েছে এর কারণ হিসেবে তিনি আল-জাজিরাকে বলেন,অভিযোগকারী ব্যক্তির ছেলেকে বিয়েতে রাজি না হওয়ায় ক্ষোভ থেকে এমনটা করা হয়েছে।সাদাফ বলেছিলেন, ‘আমি তাঁকে বলেছি,ইসলামে একজন নারীর অধিকার কী, তা আমি জানি।তাই আমি যদি আপনার ছেলেকে বিয়ে করতে না চাই,তাহলে কেউ আমাকে জোর করতে পারে না। এ কথাতেই তিনি বেশ রেগে যান এবং আমাকে আজেবাজে কথা বলতে শুরু করেন।’

তালেবান দোররা মারার মতো শাস্তি প্রকাশ্যে দেখাতে জনসমাগম হয় এমন স্থান এবং স্টেডিয়ামে জনতাকে জড়ো হতে আমন্ত্রণ জানিয়ে আসছে।গত মাসের শেষের দিকে দেশটির পূর্বাঞ্চলে লোগার অঞ্চলে তিন নারীসহ ১২ জনকে প্রকাশ্যে দোররা মারা হয়।আর ৯ ডিসেম্বর পারওয়ান প্রদেশের রাজধানী চারিকরে ৯ জন নারীসহ ২৭ জনকে দোররা মারা হয়।এক তালেবান কর্মকর্তা গনমাধ্যমকে বলেন,ব্যভিচার, ডাকাতি,সমকামিতাসহ নৈতিক অপরাধের দায়ে তাঁদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে।’

সাম্প্রতিক সময়ে এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তালেবান আবারও যেন ১৯৯০-এর দশকের শাসনে ফিরে যাচ্ছে।ওই সময় দোষী ব্যক্তিদের প্রকাশ্যে পাথর ছুড়ে এবং শিরশ্ছেদ করা হতো।

প্রায় দুই দশকের যুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট সরকারকে হটিয়ে ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তালেবান কাবুল দখল করে নেয়।সে সময় তালেবান নেতারা আগের কট্টরপন্থা থেকে সরে এসে উদারনীতি গ্রহণের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।কিন্তু মুখের কথা ও বাস্তবতার মধ্যে বিস্তর ফারাক।প্রায় প্রতিটি দিনই দেশটির নারী ও মেয়েদের জন্য খারাপ খবর দিয়ে যাচ্ছেন ক্ষমতাসীনেরা। নারীর স্বাধীনতা যেন খাঁচায় বন্দী।

শিক্ষার দ্বার বন্ধ
২০০১ সালে তালেবান সরকারকে উৎখাতের পর ২০ বছর ধরে দেশটিতে নারীদের মধ্যে একটি শিক্ষিত শ্রেণি তৈরি হয়। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে অনেক নারী সাংবাদিক,সংসদ সদস্য,শিল্পী,উদ্যোক্তা,অ্যাথলেটস হয়েছেন।এমনকি সরকারের মন্ত্রিসভায়ও অনেকে স্থান করে নিয়েছিলেন।কিন্তু গত বছরের আগস্টে তালেবান আবার ক্ষমতা দখল করে ১২ বছরের বেশি বয়সী মেয়েশিশুদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।আর বিশ্ববিদ্যালয়গামী নারী শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক শ্রেণিকক্ষ ও প্রবেশপথ চালু করে।কোথাও কোথাও শ্রেণিকক্ষে ছেলে-মেয়ের মাঝখানে পর্দা দিয়ে পৃথক করা হয়।মেয়েদের শুধু নারী শিক্ষক বা বয়স্ক পুরুষ শিক্ষক পড়াতে পারতেন।তিন মাস আগেই আফগানিস্তানজুড়ে হাজারো নারী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন।তবে তাদের জন্য পশুচিকিত্সা বিজ্ঞান,প্রকৌশল,অর্থনীতি, সাংবাদিকতার মতো বিষয়গুলো নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল তালেবান।এসবের পরও যতটুকুই-বা পড়াশোনা করার সুযোগ ছিল,তা ২১ ডিসেম্বর পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে তালেবান নেতৃত্ব।

আফগানিস্তানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী গনমাধ্যমকে বলেন,তালেবান নারী ও নারীর শক্তিকে ভয় পায় বলে তাঁর মনে হয়।তিনি বলেন,আমাকে আমার ভবিষ্যতের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারত যে সেতুটি (শিক্ষা),সেটিই তারা (তালেবান) ধ্বংস করে দিয়েছে।’

পোশাক বিধি না মানার কারণে নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ।তালেবানের উচ্চশিক্ষাবিষয়ক মন্ত্রী নেদা মোহাম্মদ নাদিম রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে বলেন,ড্রেস কোড (পোশাক বিধি) না মানার কারণে তাঁদের (নারী) বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।তাঁরা এমনভাবে সেজে আসেন, যেন বিয়েবাড়িতে এসেছেন।’

তারা আমাকে ঘিরে ছিল।আমার হাত বাঁধা হয়।বলা হয়, চিৎকার করা যাবে না।কারণ,পুরুষদের কানে যেন বাইরের কোনো নারীর কণ্ঠস্বর না পৌঁছায়।তারপর তারা আমাকে দোররা মারতে শুরু করে।

সাদাফ,তালেবানের নির্যাতনের শিকার আফগান তরুণী
গত বছরের ১৩ আগস্ট ইউনিসেফ এক প্রতিবেদনে বলেছে, আফগানিস্তানে মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষা বন্ধ করার কারণে দেশটি তার অর্থনীতিতে ৫৪০ কোটি ডলারের ক্ষতির মুখে পড়তে পারে,যা দেশের জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ। জাতিসংঘের সংস্থাটি সতর্ক করে বলেছে,তরুণ প্রজন্মের নারীদের পড়াশোনা শেষ করতে না দেওয়া এবং কর্মক্ষেত্রে প্রবেশে বাধা দিয়ে সরকার ভবিষ্যৎ কর্মক্ষম জনসংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে।

তবে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও কিছু শিক্ষার্থী তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার বিকল্প উপায় খুঁজে নিচ্ছে।দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ভেতরে প্রায় ৩০০টি গোপন স্কুল রয়েছে,যেখানে হাজারো মেয়ে পড়াশোনা করছে।

কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছেন নারীরা
তালেবান ক্ষমতা দখলের পর থেকে কর্মজীবী নারীদের বেশির ভাগই এখন কর্মহীন।বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নারী কর্মীদের চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে।এমনকি এসব নারীর স্থলে তাঁদের পুরুষ কোনো আত্মীয়কে নেওয়া হয়েছে।

আফগানিস্তানে করোনা-১৯ মহামারির ঠিক আগে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২২ শতাংশ।কিন্তু তালেবান ক্ষমতায় আসার পর হাজারো মানুষ চাকরি হারান,যার বেশির ভাগই ছিলেন নারী।আফগান উইমেনস চেম্বার অব কমার্সের মতে, সব শিল্প খাতেই প্রভাব পড়েছিল,তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা ছিল অনেক বেশি।মুখ না ঢাকার কারণে তাঁদের শাস্তি হতে পারে—এমন আশঙ্কায় ৩ হাজার ৫০০-র বেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী ব্যবসায়ীকে তাঁদের ব্যবসা বন্ধ করতে হয়েছে।

তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের আগে দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ শিক্ষক ছিলেন নারী,কিন্তু এখন হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষকতা করছেন।একই চিত্র গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) এবং আফগান ইনডিপেনডেন্ট জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের (এআইজেএ) করা প্রতিবেদনে বলা হয়,তালেবান ক্ষমতায় আসার পর দেশটির ৪৩ শতাংশ গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে গেছে।আর ৮৪ শতাংশ নারী গণমাধ্যমকর্মী চাকরি হারিয়েছেন।

ক্ষমতায় এসেই তালেবান বিদ্যমান বিচারব্যবস্থা ভেঙে দেয়। তাদের নিজস্ব বিচারক নিয়োগ করে এবং ইসলামি আইনের নিজস্ব ধরন প্রয়োগ করে।যেখানে দেশটিতে ৩০০ জনের বেশি নারী বিচারক ছিলেন,এখন সেখানে কেউ নেই।কয়েক শ বিচারক অন্য দেশে পালিয়ে গেছেন এবং প্রায় ৭০ জন নারী বিচারক আত্মগোপনে রয়েছেন।

বর্তমানে মারজিয়া নামের এক নারী বিচারপতি বলেন,মামলা পরিচালনা করার মতো কোনো নারী আইনজীবী নেই।আর নারী বিচারপতিদের কাজে ফেরার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।

অনেক আফগান নারী চিকিৎসক,বিশেষ করে যাঁরা প্রজনন ও যৌন স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেছেন,তাঁরা নিরাপত্তার স্বার্থে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।একারণে এখন স্বাস্থ্যসেবা খাত একটি বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে।এমনকি তালেবানের মন্ত্রিসভায় কোনো নারী রাখা হয়নি।বন্ধ করে দেওয়া হয় নারীবিষয়ক মন্ত্রণালয়।এর পরিবর্তে নৈতিকতা-বিষয়ক মন্ত্রণালয় চালু করে। কাবুলের নারী সরকারি কর্মচারীদের বেতন কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং যেসব নারীর কাজ পুরুষদের দ্বারা হবে না, তাঁদের ছাড়া অন্য নারীদের বাড়িতেই থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

তবে তালেবানের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সুহাইল শাহিন এক টুইটে বলেছেন,দেড় লাখ নারী আফগানিস্তানের জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, হাসপাতাল ও ক্লিনিকে কাজ করছেন।

তালেবানের প্রধানমন্ত্রী মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দ দাবি করেছিলেন,নারীদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে।কিন্তু বাস্তবতা হলো,কাজ পাওয়া আফগান নারীদের জন্য খুবই কঠিন।আর যাঁরা এখনো কাজে টিকে থাকতে পেরেছেন, তাঁরা সৌভাগ্যবান।তালেবানের বিধিনিষেধের বেড়াজালে সর্বশেষ যোগ হয়েছে এনজিওতে দেশটির নারীদের কাজ বন্ধের ঘোষণা।

চলাফেরায় বাধা
শুধু পড়াশোনা করা যাবে না,চাকরি করা যাবে না,এমনটা নয়।এখন নারীদের একা দূরের পথে যেতে দেওয়া হয় না। গত বছরের ডিসেম্বরে তালেবানের এক নির্দেশে বলা হয়, কোনো নারী সড়কপথে ৪৫ মাইল (৭২ কিলোমিটার) দূরত্ব বা এর বেশি যেতে চাইলে পরিবারের ঘনিষ্ঠ একজন পুরুষ সদস্যকে সঙ্গে থাকতে হবে।গত আগস্টে তালেবান সরকারের নীতিনৈতিকতা-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আকেফ মুহাজির গনমাধ্যমকে বলেছিলেন,নারীদের জীবন স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

তবে তিনি এ কথা বললেও শৃঙ্খলে আটকে হাঁসফাঁস করছেন নারীরা।তাঁদের একজন ২৯ বছরের শামসিয়া মাহজাবিন কাবুলে দুই সন্তান নিয়ে থাকেন।চার বছর আগে আত্মঘাতী বোমা হামলায় স্বামীকে হারিয়েছেন।এর পর থেকে শামসিয়া শুধু নিজেদের পরিবারকে নয়,শ্বশুরবাড়িকেও আর্থিক সাহায্য করে আসছেন।তালেবানকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন,তোমরা আমার স্বামীকে মেরে ফেলেছ।পরিবারে আয় করার কেউ নেই। এখন তোমরা আমাকে ঘরে থাকতে বাধ্য করছ।তাহলে আমার সন্তানদের জন্য খাবার আনব কোথা থেকে?’

তালেবানের এই নিষেধাজ্ঞার কারণে স্বাস্থ্যসেবার মতো প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলোতে নারীদের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। যেখানে দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশকে চিকিৎসাকেন্দ্রে পৌঁছাতে দুই ঘণ্টার বেশি যাত্রা করতে হয় এবং প্রায় অর্ধেককে ৩০ মিনিটের বেশি পথ পাড়ি দিতে হয়। এমনও বলা হয় যে তালেবান কর্মকর্তারা পুরুষ অভিভাবক ছাড়া নারীদের চিকিৎসা করাতে চিকিৎসকদের বাধা দিচ্ছেন।

এই অবনতির খেসারত মেয়েদের বইতে হচ্ছে।তারা খাবার পাচ্ছে না,একাকিত্ব ও মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে এবং ছেলেরা যেখানে স্কুলে যাচ্ছে,সেখানে তাদের বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। এটি শুধু মানবিক সংকটই নয়,শিশু অধিকারের বিপর্যয়ও।
ক্রিস নায়ামানদি, আফগানিস্তানে সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক।

চলতি বছরের মে মাসে, নীতিনৈতিকতা-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রচারের অংশ হিসেবে সব নারীকে জনসমক্ষে বোরকা পরতে বা তাঁদের মুখ ঢেকে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।তালেবান ঘোষণা দেয়,যে নারী হিজাব পরবে না,সেই বাড়ি চিহ্নিত করে তাঁর পুরুষ অভিভাবককে সতর্ক করা হবে।এরপর না পরলে দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসেবে পুরুষ অভিভাবককে ডাকা হবে,আর শেষ পদক্ষেপে অভিভাবকে তিন দিনের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।

পরিবারের আর্থিক সংকটের প্রথম শিকার মেয়েরা!

তালেবান ক্ষমতা দখলের পরই ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে জমা থাকা আফগানিস্তানের জাতীয় রিজার্ভের ৯১০ কোটি ডলার জব্দ করে যুক্তরাষ্ট্র।এ কারণে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে।আফগান জনগণ ক্রমে নিত্যপণ্য কেনার সামর্থ্য হারাচ্ছে।খাদ্য দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে এবং মুদিদোকানগুলো তাদের গুদামে আগের মতো মাল তুলতে পারছে না।

এমন অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পরিবারে প্রথম শিকার হতে হয় ঘরের মেয়েদের।কারণ,পরিবারগুলো মনে করে,মেয়েদের বিয়ে দিলেই একটি খাওয়ার মুখ কমে। সেভ দ্য চিলড্রেনের মতে,আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সেখানকার পরিবারগুলোকে খাবারের সংকটে ফেলেছে। পাশাপাশি মৌলিক চাহিদার পূরণেও সংকট তৈরি হয়েছে।এসব কারণে বাল্যবিবাহ বেড়েছে।

ছোট্ট এই মেয়েকে তার পরিবার ঋণের দায়ে ২৩ বছর বয়সী এক তরুণের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয়।

আর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যমতে,নারী ও মেয়েদের শিক্ষাগত ও পেশাগত কাজের সুযোগের অভাব বাল্যবিয়ের একটি কারণ।এ ছাড়া পরিবারের পক্ষ থেকে নারী ও মেয়েদের তালেবান সদস্যদের বিয়ে করতে বাধ্য করা হচ্ছে। আবার অনেক সময় তালেবান সদস্যরাই তাদের বিয়ে করতে বাধ্য করছেন।

গত ১০ আগস্ট সেভ দ্য চিলড্রেনের ‘ব্রেকিং পয়েন্ট: লাইফ ফর চিলড্রেন ওয়ান ইয়ার সিনস দ্য তালেবান টেকওভার’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়,প্রায় ৯৭ শতাংশ পরিবারকে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে বেগ পেতে হচ্ছে।এর মধ্যে যাও খাবার জুটছে,সেখানে মেয়েশিশুরা ছেলেদের চেয়ে কম খাবার পায়।প্রায় ৮০ শতাংশ শিশু জানিয়েছে,তারা গত ৩০ দিন ক্ষুধা পেটে ঘুমাতে গিয়েছে।এ ক্ষেত্রে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের হার দ্বিগুণ।

বিষণ্নতা বাড়ছে
১৫ বছর বয়সী মুসকার স্বপ্ন ছিল,সে চিকিৎসক হবে।কিন্তু এখন সে বলছে,তাঁর স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে।মুসকা দ্য গার্ডিয়ানকে বলে,তালেবান ক্ষমতায় আসার আগে প্রতিদিনই হামলা হতে পারে,এমন ভয়ের মধ্যে ছিলাম।কিন্তু স্কুলে যেতে পারতাম।আমি অনেক বিস্ফোরণ কাছ থেকে দেখেছি,একটি থেকে তো অল্পের জন্য বেঁচে গেছি।কিন্তু আশাবাদী ছিলাম, একদিন পরিস্থিতির উন্নতি হবে।মেয়ে ও নারীরা সমান অধিকার ও সুযোগ পাবে।কিন্তু তালেবান আমার স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে।যখন আমি প্রথম শুনলাম,আমাদের স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ,সেদিন আমি কান্না থামাতে পারছিলাম না।মনে হচ্ছিল,আমি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছি।’

ড্রেস কোড না মানার কারণে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।তাঁরা এমনভাবে সেজে আসেন, যেন বিয়েবাড়িতে এসেছেন।

নেদা মোহাম্মদ নাদিম, তালেবানের উচ্চশিক্ষাবিষয়ক মন্ত্রী
সেভ দ্য চিলড্রেনের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে,আফগান নারী ও মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বেড়েছে।সংস্থাটির তথ্যমতে,দেশটিতে ২৬ শতাংশ মেয়ে ও ১৬ শতাংশ ছেলের মধ্যে বিষণ্নতার লক্ষণ দেখা দিয়েছে।আর উদ্বেগজনিত সমস্যা দেখা গেছে ২৭ শতাংশ নারীর মধ্যে।সে তুলনায় ছেলেদের মধ্যে এ হার ১৮ শতাংশ।মেয়েরা জানিয়েছে,দুশ্চিন্তার কারণে তাদের ঘুমের সমস্যা হচ্ছে।তারা ঘুমের মধ্যে খারাপ স্বপ্নও দেখছে।তারা আরও বলেছে,তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে তারা আনন্দ পাবে—এমন কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেনি।আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সময় কাটাতে পারছে না,পার্কে যেতে পারছে না,দোকানে যেতে পারছে না।

কাবুলের একজন ফার্মাসিস্ট মহম্মদ মহিবুল্লাহ গনমাধ্যমকে জানান,যখন বিষণ্নতা দূর করার এবং ঘুমের ওষুধের বিক্রি কমে এল,তখন দেখা গেল নারীদের মধ্যে এ-জাতীয় ওষুধ কেনার হার বেড়েছে। তিনি বলেন,‘তালেবান দেশটি দখলের পর থেকে বেশির ভাগ সময়ই শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যুদ্ধ থেমে গেছে,হামলাও কমে গেছে।কিন্তু এখন নারীদের মধ্যে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট,স্ট্রেস রিলিভার বা ঘুমের ওষুধ কেনার প্রবণতা বেড়েছে।তারা অনেক চাপের মধ্যে আছে।যদিও অনেক পুরুষ আমাকে বলে,তারা আগের তুলনায় অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন,কিন্তু নারী এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি বিপরীত।’

দেশটির চিকিৎসকেরা সতর্ক করে বলছেন,কিশোরী মেয়েদের মধ্যে বিষণ্নতা বাড়ছে।মনোবিজ্ঞানী রোহুল্লাহ রেজভানি বলেন, আফগানরা,বিশেষ করে মেয়েরা,যাঁরা কয়েক মাস ধরে বাড়িতে রয়েছেন,তাঁরা আগের চেয়ে অনেক বেশি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি।অনেকের মধ্যে মানসিক চাপ ও হতাশা তৈরি হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, তাদের স্বপ্ন, জীবনের লক্ষ্য সব হারিয়ে ফেলেছে।

পার্ক ও শরীরচর্চা কেন্দ্রেও মেয়েদের যেতে মানা
একটি বিনোদন পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক ব্যক্তি। সব ধরনের পার্ক,শরীরচর্চা কেন্দ্রে এখন নারীদের যাওয়া মানা।

গত নভেম্বরে তালেবান ভাইস অ্যান্ড ভার্চু মন্ত্রণালয় নারীদের পার্কে,ব্যায়ামাগারে যাওয়া নিষিদ্ধ করে।একই সঙ্গে পুরুষ অভিভাবক ছাড়া নারীর রেস্তোরাঁয় যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।এতে কোণঠাসা হয়ে পড়া নারীদের বাইরের চলাফেরা আরও সীমিত হয়ে পড়ে।

তালেবান বলছে,পার্কগুলোতে ইসলামিক আইন মানা হচ্ছে না। দেশটির নৈতিকতাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র মোহাম্মদ আকিফ গনমাধ্যমকে বলেন,নারী ও পুরুষ আলাদাভাবে চলছে না,নারীরা হিজাব পরছেন না। এ কারণেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আফগানিস্তানে সেভ দ্য চিলড্রেনের দেশীয় পরিচালক ক্রিস নায়ামানদি বলেন,এই অবনতির খেসারত মেয়েদের বইতে হচ্ছে।এক বিবৃতিতে তিনি বলেন,তারা খাবার পাচ্ছে না, একাকিত্ব ও মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন এবং ছেলেরা যেখানে স্কুলে যাচ্ছে,সেখানে তাদের বাড়িতে থাকতে হচ্ছে।এটি শুধু মানবিক সংকটই নয়,শিশু অধিকারের বিপর্যয়ও।

মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আকেফ মোহাজের সাংবাদিকদের বলেন, নারী-পুরুষের বিভেদ না মানার কারণে ও নারীরা ঠিকভাবে হিজাব না পরায় এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।এই নিষেধাজ্ঞার আগে পার্কে যাওয়ার জন্য আলাদা আলাদা দিন নির্ধারণ করা ছিল।আর ব্যায়ামাগার সব সময়ই নারী-পুরুষদের জন্য আলাদাই ছিল।

ওয়াহিদা নামের এক নারী এএফপিকে বলেন,স্কুল নেই, কাজ নেই…আমাদের জন্য অন্তত এমন একটি জায়গা দরকার,যেখানে আমরা মন খুলে সময় কাটাতে পারি,কথা বলতে পারি। আমরা সারা দিন ঘরে থেকে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি।’

আরও খবর

Sponsered content