রাজনীতি

ড. ইউনূসের বিচার স্থগিত হবে কি না—এমন নানা প্রশ্নের জন্ম হয়েছে?

  প্রতিনিধি ৩০ আগস্ট ২০২৩ , ৩:২৪:৩৫ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বিচার স্থগিত রাখতে ১৬০ বিশ্বনেতার খোলা চিঠি ঘিরে সব মহলে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।এই বিবৃতির মাধ্যমে সরকারের ওপর বিদেশি চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে কি না, ড. ইউনূসের বিচার স্থগিত হবে কি না—এমন নানা প্রশ্নের জন্ম হয়েছে।

যদিও এই চিঠি নিয়ে সরকার কোনো চাপে নেই বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম।তবে এই বিবৃতি দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।

মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর ব্রিকস সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনেও উঠে আসে বিষয়টি। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন,ভদ্রলোকের (ড. মুহাম্মদ ইউনূস ) যদি এতই আত্মবিশ্বাস থাকত যে তিনি কোনো অপরাধ করেননি,তাহলে তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিবৃতি ভিক্ষা করে বেড়াতেন না।আমাদের বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। এছাড়া আমাদের সব কিছু আইন অনুযায়ী চলে।কেউ যদি ট্যাক্স না দেয়। আর যদি শ্রমিকদের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়। আর লেবার কোর্টে মামলা হয়,আমাদের কী সেই হাত আছে মামলা বন্ধ করে দেব?’

গত সোমবার জাতিসংঘের নিয়মিত ব্রিফিংয়েও উঠে আসে ড. ইউনূস প্রসঙ্গ।এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন,প্রফেসর ইউনূসকে হয়রানির বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’

পাওনা মুনাফার দাবিতে সোমবার সকালে ১৮ শ্রমিক ঢাকার শ্রম আদালতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা করেন।এ মামলায় সমন জারি করেছেন আদালত।আগামী ১৬ অক্টোবরের মধ্যে এ সমনের জবাব দিতে বলা হয়েছে।এছাড়া শ্রম আইন লঙ্ঘনের আরেকটি অভিযোগে ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলার বিচার শুরু হয়েছে।এরপরই নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হয়রানি বন্ধ এবং বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন ১০০ নোবেলজয়ীসহ ১৬০ জন বিশ্বনেতা।ওই চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের একজন স্যাম ডেলি-হ্যারিস এক বিজ্ঞপ্তিতে চিঠিটি প্রকাশ করেছেন।

১৬০ বিশ্বনেতার লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে,আমরা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী,নির্বাচিত কর্মকর্তা,ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের নেতার পাশাপাশি বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে লিখছি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে আপনাদের জাতি যেভাবে প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে আমরা তার প্রশংসা করি। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি যে হুমকি দেখেছি তাতে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।’

ড. ইউনূস সম্পর্কে চিঠিতে লেখা হয়,বর্তমান প্রেক্ষাপটে মানবাধিকারের প্রতি যে হুমকি আমাদের উদ্বিগ্ন করে তা হলো- নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের মামলা।আমরা উদ্বিগ্ন যে,সম্প্রতি তাকে টার্গেট করা হয়েছে।এটা ক্রমাগত বিচারিক হয়রানি বলেই আমাদের বিশ্বাস।এর আগে ৪০ জন বিশ্বনেতা তার নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে আপনার কাছে যে আবেদন করেছিলেন এই চিঠিটি তার ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলারই চেষ্টা।’

চিঠিতে বিশ্বনেতারা লেখেন,আমরা বিনীতভাবে অনুরোধ করছি যে,আপনি অবিলম্বে অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে বর্তমান বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত করুন।তারপর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইন বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা রাখার সুযোগসহ আপনার দেশের মধ্য থেকে নিরপেক্ষ বিচারকদের একটি প্যানেল দ্বারা অভিযোগের পর্যালোচনা করা হবে।আমরা নিশ্চিত যে,তার বিরুদ্ধে দুর্নীতিবিরোধী এবং শ্রম আইনের মামলাগুলোর যে কোনো পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার করলে তিনি খালাস পাবেন।’

চিঠিতে সই করা নেতাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন,পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস-হোর্তা,আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন,জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন প্রমুখ।

এই চিঠি প্রকাশ হওয়ার পর দেশজুড়ে নানা আলেচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।গতকাল এই চিঠি নিয়ে সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী,দুদক আইনজীবী ও রাজনীতিবিদরা নানা মন্তব্য করেন।

গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ ইউনূসের মামলা নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিদের বিবৃতিতে সরকার বিচলিত নয়।গোটা বিষয়টি হতাশাজনক এবং বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম।

মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এটা হতাশাজনক যে,একজনকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য অব্যাহতভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে।অতীতে কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক মর্যাদা শুধু যে তার গুণের কারণে হয়েছে সেটি নয়,এর পেছনে অনেক বিনিয়োগ আছে।’

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন,বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন। বিচার বিভাগই সিদ্ধান্ত নেবে এবং বিচার চলবে।এটি নিয়ে বিচলিত বা চিন্তিত নই।’

কোনো বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করার আহ্বান এর আগে শোনেননি জানিয়ে তিনি বলেন,আমি মনে করি না,যারা এই আবেদনে শামিল হচ্ছেন,তারা তাদের সুনামের প্রতি সুবিচার করছেন।একটি বিচারকে তারা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন এবং এটিকে আমরা স্বাগত জানাই।’

কিন্তু একজন ব্যক্তি যিনি ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত,যিনি শত শত হাজার হাজার মানুষকে নিয়োগ করেছেন,যার সম্পত্তি আছে,তার আইনগত বিষয় থাকতে পারে।তার মানে এই নয় যে,তিনি অপরাধী হয়ে যাবেন,বা সেটি তদন্ত করা যাবে না। পৃথিবীতে এমন কোনো ব্যক্তি কি আছেন,যার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করা যাবে না,বা তদন্ত করা যাবে না?’

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি (ড. ইউনূস) বা তার লোকজন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এখনো অর্থ ব্যয় করে যাচ্ছেন—এতে কোনো সন্দেহ নেই।’

এখানে (মামলায়) সরকারের প্রভাব অতীতে ছিল না এবং আগামীতেও থাকবেও না। বিচার বিভাগ স্বাধীন এবং তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সরকার বা দূতাবাসগুলো কথা বলবে জানিয়ে তিনি বলেন,আমরা যতটুকু জানি ততটুকু তুলে ধরব।একটি বিচারাধীন বিষয় নিয়ে সরকার বা দূতাবাস বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নতুন করে কিছু বলার বা ব্যাখ্যা করার কিছু নেই। কারণ আদালত সিদ্ধান্ত নেবে।’

সরকার ও ড. ইউনূসের মধ্যে দূরত্ব আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন,আপনারা ওয়ান-ইলেভেন ঘঠনাপ্রবাহ জানেন।কিন্তু তারপরে ১৫ বা ১৭ বছরে আমাদের দিক থেকে কিছু নেই।’

একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দুই পাতা বিজ্ঞাপন দিতে অন্তত দুই মিলিয়ন ডলার (২০ কোটি টাকার বেশি) লাগে, সে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে বলেও জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেওয়া ১৬০ নেতার চিঠিকে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ বলে মন্তব্য করেছেন মামলা সংশ্লিষ্ট সিনিয়র আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে এনেক্স ভবনের সামনে সাংবাদিকদের কাছে এ মন্তব্য করেন তিনি।

আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন,বিশ্বনেতারা বাংলাদেশের আইন,বিচার বিভাগকে না জেনে,পর্যালোচনা না করে অযাচিতভাবে বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ করছেন।তারা আদালতে ড. ইউনূসের মামলা নিয়ে এত মাতামাতি করছেন কেন আমার বুঝে আসে না।’

বিশ্বনেতাদের বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে খুরশীদ আলম খান বলেন,বাংলাদেশে আসুন,দেখুন কত স্বচ্ছতার সঙ্গে ড. ইউনূসের মামলার বিচারকাজ চলছে।শুধু ড. ইউনূসের কথায় বাংলাদেশের বিচার বিভাগ নিয়ে বিরূপ ধারণা পোষণ করবেন না।’

নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলাবাজি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।একইসঙ্গে তার বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার করে হেনস্তা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

মঙ্গলবার বিকালে দলের দপ্তর সম্পাদক মুহম্মদ মুনির হোসেনের সই করা এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান তিনি।

মির্জা ফখরুল বলেন,ড. মুহাম্মদ ইউনূস হলেন এই জাতির একজন সূর্যসন্তান।শত বছর পরেও এই জাতির মানুষ তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে এবং লজ্জিত হবে এই ভেবে যে,এ রকম বরেণ্য একজন মানুষের সঙ্গে এই দেশের সরকার কী রকম নীচ আচরণ করেছিল।’

তিনি বলেন,তার বিরুদ্ধে সব মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।তিনি এই দেশের একজন কীর্তিমান ব্যক্তি।তাকে যারা ছোট করতে চান,অপমান করতে চান তারা আরেকবার জন্ম নিলেও তার সমান উচ্চতায় যেতে পারবেন না।এই অনিবার্য সত্যটা মেনে নিয়ে তাকে হেনস্তা করা বন্ধ করুন। এইসব মামলাবাজি বন্ধ করুন।’

আরও খবর

Sponsered content