প্রতিনিধি ১৫ আগস্ট ২০২৫ , ৫:২১:০২ প্রিন্ট সংস্করণ
ঢাবি প্রতিনিধি।।ছয় বছর পর আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদের নির্বাচন হতে যাচ্ছে।এই নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় প্যানেল গোছাচ্ছে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন।তবে নির্বাচন নিয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের তৎপরতা অন্য সংগঠনগুলোর চেয়ে এখন পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে কম।তারা ছাড়া অন্য সব সংগঠন ডাকসু নির্বাচন ঘিরে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে।

ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন ঘিরে ছাত্রদলের তৎপরতা অন্যদের চেয়ে যে কম,তা স্বীকার করে নিয়েছেন সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান। তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে মুঠোফোনে বলেন,ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তাঁরা দাবি জানিয়েছেন। ক্যাম্পাসে ‘মব’ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না প্রশাসন। ছাত্রলীগের অনেকে ভোটার তালিকায় আছেন।জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে থাকা কয়েকজন শিক্ষক এখনো বিভিন্ন হলের প্রাধ্যক্ষ ও আবাসিক শিক্ষক হিসেবে বহাল আছেন। ছাত্রদলের নেতা–কর্মীরা হল পর্যায়ে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন না।এই পরিস্থিতির দ্রুত উত্তরণ ঘটাতে হবে।
এবারের নির্বাচন সামনে রেখে বেশি আলোচনা হচ্ছে নতুন ছাত্রসংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদকে নিয়ে।জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের একাংশের উদ্যোগে গত ফেব্রুয়ারিতে এই সংগঠন গঠিত হয়েছে।গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের প্যানেলে ভিপি (সহসভাপতি) পদে আবদুল কাদের ও জিএস (সাধারণ সম্পাদক) পদে আবু বাকের মজুমদারের নাম চূড়ান্ত হয়েছে। তাঁদের প্যানেলে এক-তৃতীয়াংশ থাকবেন নারী শিক্ষার্থী।
আবু বাকের মজুমদার বলেন, ‘সবাইকে নিয়ে আমরা প্যানেল গঠনের প্রক্রিয়ায় আছি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমরা যুক্ত।’
গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ অবশ্য নিজেদের নামে প্যানেল ঘোষণা করবে না।ভিন্ন কোনো নামে তারা ডাকসুতে নির্বাচন করবে। এর কারণ,সব শিক্ষার্থী যাতে এই প্যানেলের বিষয়ে আগ্রহী হন।
গণ–অভ্যুত্থানের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ও হলে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রকাশ্য কার্যক্রম ছিল না।তবে গত বছরের ৫ আগস্টের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের কমিটি প্রকাশ করে শিবির।বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে তারা ক্যাম্পাসে এখন বেশ তৎপর। আগামী সপ্তাহে ডাকসু ও হল সংসদের প্যানেল ঘোষণা করতে পারে ছাত্রশিবির। সংগঠনের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক মো. আবু সাদিক কায়েমের ভিপি পদে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদের জিএস পদে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে শিবিরও নিজেদের নামে না করে অন্য নামে প্যানেল ঘোষণা করবে।
শিবিরের সম্ভাব্য ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম বলেন, ‘আমাদের প্যানেল চূড়ান্ত হয়নি, আলোচনা চলছে।অন্য দল ও সংগঠনের সঙ্গে আমাদের কোয়ালিশন (জোট) হতে পারে।’
গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট এবারের ডাকসু নির্বাচনে যৌথ প্যানেল ঘোষণা করবে বলে জানা গেছে।এই জোটে আছে ছাত্র ইউনিয়ন (তামজিদ–শিমুল),সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী),বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী,গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (ইউপিডিএফ),ছাত্র ফেডারেশন (জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল) ও বিপ্লবী ছাত্র–যুব আন্দোলন।তবে জোটের বাইরে থাকা ছাত্র ইউনিয়ন (মাহির-বাহাউদ্দিন),সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (বাসদ) এবং বিসিএল (বাংলাদেশ জাসদ) এই প্যানেলে যুক্ত হতে পারে। এর পাশাপাশি পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সংগঠনকেও এই প্যানেলে যুক্ত করার চেষ্টা করছে ছাত্র জোট।
গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের এই প্যানেলে ভিপি পদে ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু ও জিএস পদে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জাবির আহমেদের (জুবেল) নাম আলোচনায় আছে।হল পর্যায়েও সম্ভব হলে এই জোট প্যানেল দেবে।সম্ভব না হলে তাদের প্রার্থীরা স্বতন্ত্র প্যানেলগুলোর সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন।
জাবির আহমেদ বলেন,‘আগামী দিনের লড়াইয়ের জন্য এই ডাকসু নির্বাচনটা গুরুত্বপূর্ণ।আগামী দিনে উগ্র ডানপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে একটা গণতান্ত্রিক জায়গা সবার নিতে হবে। গণতন্ত্রমনা যত শিক্ষার্থী ও আন্দোলন-সংগ্রামের যত মুখ আছে,সবাইকে নিয়ে গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের একটা প্যানেল তৈরি করব আমরা।’
ছাত্রদলের কোন পর্যায়ের নেতারা ডাকসু নির্বাচন করবেন, সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।তবে ছাত্রদলের ভিপি ও জিএস প্রার্থী হিসেবে দুজনের নাম আলোচনায় আছে।তাঁরা হলেন সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবিদুল ইসলাম খান ও কবি জসীমউদ্দীন হল শাখার আহ্বায়ক শেখ তানভীর বারী হামিম।সংগঠনটির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেছেন,সরাসরি সংগঠনের নামে না হয়ে ভিন্ন একটি নামে প্যানেল হতে পারে।তবে কোনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি।
এ বিষয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন,তাঁরা শিগগিরই ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের জন্য প্যানেল গঠনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলে ৮ আগস্ট কমিটি ঘোষণা করেছিল ছাত্রদল।হলে কমিটি দেওয়ার প্রতিবাদে সেদিন রাতে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ হয়।বিষয়টি নিয়ে পরের কয়েক দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাল্টাপাল্টি সমালোচনা ও বিতর্ক চলে।এই ঘটনার পর নির্বাচনকেন্দ্রিক তৎপরতা শুরু করতে ছাত্রদল সময় নিচ্ছে,এমন আলোচনাও শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছে।
গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের এই প্যানেলে ভিপি পদে ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু ও জিএস পদে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জাবির আহমেদের (জুবেল) নাম আলোচনায় আছে।হল পর্যায়েও সম্ভব হলে এই জোট প্যানেল দেবে।সম্ভব না হলে তাদের প্রার্থীরা স্বতন্ত্র প্যানেলগুলোর সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন।
দলীয় বিভিন্ন প্যানেলের বাইরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক উমামা ফাতেমার নেতৃত্বে একটি স্বতন্ত্র প্যানেলের বিষয়েও ক্যাম্পাসে আলোচনা রয়েছে। উমামা একসময় ছাত্র ফেডারেশনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।সে জন্য বামপন্থী সংগঠনগুলো তাদের প্যানেলে উমামাকে রাখার চেষ্টা করেছিল।কিন্তু উমামা তাতে সম্মত হননি।
নিজ উদ্যোগে স্বতন্ত্র একটি প্যানেল দেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে বলেছেন উমামা ফাতেমা।তিনি বলেছেন,শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্যানেল নিয়ে আলোচনা চলছে।শিগগিরই সব জানানো হবে।
এ ছাড়া গণ অধিকার পরিষদের ছাত্রসংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইসলামী আন্দোলনের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র আন্দোলন ইতিমধ্যে প্যানেল ঘোষণা করেছে।
ভোটার ৩৯ হাজার ৭৭৫ জন
গত মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) থেকে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র বিতরণ চলছে।ভিপি,জিএসসহ ডাকসুর যেকোনো পদে মনোয়নপত্রের (ফরম) মূল্য ৩০০ টাকা।হল সংসদের ক্ষেত্রে তা ২০০ টাকা।
মনোনয়নপত্র বিতরণের শেষ তারিখ ১৮ আগস্ট।মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত।যাচাই-বাছাই শেষে ২১ আগস্ট চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে।
ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুযায়ী, ভোটার ৩৯ হাজার ৭৭৫ জন।এর মধ্যে ছাত্র ভোটার ২০ হাজার ৮৭৩ জন।ছাত্রী ভোটার ১৮ হাজার ৯০২ জন।
ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে গতকাল দুপুরে চারটি হলে (মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল,মাস্টারদা সূর্য সেন হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ও স্যার এ এফ রহমান হল) গিয়ে ২২ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক।তাঁরা বলেন, প্রচার–প্রচারণা সেভাবে শুরু হয়নি।এর একটি কারণ,অনেক বিভাগ–ইনস্টিটিউটে পরীক্ষা চলছে।আরেকটি কারণ,এখনো ডাকসু ও হল সংসদে প্রার্থী চূড়ান্ত হয়নি।তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্ভাব্য প্রার্থীরা অনেকের সঙ্গে বসে আলোচনা করছেন,সমর্থন চাইছেন।প্রার্থী ও প্যানেল চূড়ান্ত হওয়ার পরই ক্যাম্পাসে পুরোদমে নির্বাচনী আবহ তৈরি হবে।
সর্বশেষ নির্বাচনে ডাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদে ভিপি,জিএসসহ পদ ছিল ২৫টি,হল সংসদে ছিল ১৩টি।এবার কেন্দ্রীয় সংসদে নতুন তিনটি পদ যুক্ত করা হয়েছে।তবে হল সংসদে পদসংখ্যা এবারও ১৩টিই থাকছে।
১৯৯০ সালের পর সর্বশেষ ২০১৯ সালের মার্চে ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচন হয়েছিল।নির্বাচনের দিন দুপুরে ছাত্রলীগ ছাড়া বাকি সব প্যানেল ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল।ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে স্থাপনের দাবি উঠলেও তখনকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা শোনেনি।এবারের নির্বাচনে অবশ্য ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে রাখা হচ্ছে।জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ এখন নিষিদ্ধ।ফলে এই নির্বাচনে ছাত্রলীগের অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই।
সর্বশেষ নির্বাচনে ডাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদে ভিপি,জিএসসহ পদ ছিল ২৫টি,হল সংসদে ছিল ১৩টি।এবার কেন্দ্রীয় সংসদে নতুন তিনটি পদ যুক্ত করা হয়েছে।তবে হল সংসদে পদসংখ্যা এবারও ১৩টিই থাকছে।
দীর্ঘ ২৮ বছরের বিরতির পর ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে ভিপি হন নুরুল হক নুর।তিনি এখন গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি।ওই নির্বাচনে নুরের প্যানেল থেকে সমাজসেবা সম্পাদক পদে জয়ী হন আখতার হোসেন।আখতার এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব।ওই নির্বাচনে ডাকসুর জিএসসহ ২৩টি পদে জয়ী হয় ছাত্রলীগ (এখন নিষিদ্ধ)। তবে সেই নির্বাচন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
এবারের ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন,ডাকসুর এবারের নির্বাচনের আলাদা তাৎপর্য আছে।এবারই প্রথমবারের মতো হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে।ফলে আবাসিক বা অনাবাসিক কোনো ভোটারের ওপর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নেই।নির্বাচন সুষ্ঠু করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও প্রস্তুতি রয়েছে।












