অপরাধ-আইন-আদালত

কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা ও লাশ ২৬ টুকরা করার ঘটনায় হাতেনাতে ধরা পড়া আসামি কীভাবে লাপাত্তা হন!

  প্রতিনিধি ৩ ডিসেম্বর ২০২৩ , ৩:৪০:৩৩ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।বিচার যদি করতি চায়,তো হয়।গরিবের বিচার কেউ করে না।অনেক রাগ ওঠে।’ কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা ধরে এসেছিল শিরিনা বেগমের।সাড়ে ১১ বছর আগে কিশোরী মেয়ের টুকরা টুকরা লাশ ডোম হাতে সেলাই করে একটা আকৃতি দিয়েছিলেন।সেলাই করা লাশ হাতে পাওয়ার পর থেকে থানা–পুলিশ,আইনজীবী,আদালত—অনেক ছোটাছুটি করেছিলেন শিরিনা বেগম।আসামি গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন।

কিন্তু ছয় বছর আগে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের শেষ পর্যায়ে হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান আসামি। কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা ও লাশ ২৬ টুকরা করার ঘটনায় হাতেনাতে ধরা পড়া আসামি কীভাবে লাপাত্তা হন,তা নিয়ে এখনো বিস্ময় প্রকাশ করেন মামলাটির সঙ্গে যুক্ত আইনজীবী ও কিশোরীর পরিবারের সদস্যরা।

২০১২ সালের ১ জুন রাজধানীর হাতিরপুলের নাহার প্লাজায় ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হন শিরিনা বেগমের কিশোরী মেয়ে রুমি (১৫)।আসামি সাইদুজ্জামান বাচ্চুর (২৮) সঙ্গে মুঠোফোনে পরিচয় হয়েছিল তার।

ঘটনার ৫ বছর পর ২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল চাঞ্চল্যকর এই মামলায় ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল–৩ সাইদুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ দেন।সেদিন আদালতে উপস্থিত ছিলেন শিরিনা বেগম।তবে সেই রায় তাঁকে স্বস্তি দিতে পারেনি।কারণ,রায় ঘোষণার মাস ছয়েক আগেই হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে পলাতক হয়ে যান আসামি।

‘না খুঁজলে কি আসামি ধরা পড়ে’
শিরিনা বেগম জানান,মামলার রায় ঘোষণার আগেই তিনি শুনেছিলেন যে আসামি সাইদুজ্জামান জামিন পেয়ে গেছেন। সেই আসামি এখন পর্যন্ত ধরা না পড়ায় তাঁর প্রচণ্ড রাগ হয়। তিনি বলেন,না খুঁজলে কি ধরা পড়ে?যারা ছাইড়া দিছে, তারা চেষ্টা না করলে ধরা পড়বে?কার কাছে বিচার চাইব? সেই ক্ষমতাও নাই।আইনজীবী কইল,যদি কোনো দিন পুলিশ আসামিরে ধরতে পারে,তাইলে ফাঁসি হবে।এ রকম একটা কাজ (হত্যাকাণ্ড),আসামি ছাইড়া দিয়া ফাঁসির অর্ডার দেয়।’

শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আবদুছ ছামাদ মামলায় লেখেন, ২০১২ সালের ২ জুন বেতার বার্তার মাধ্যমে খবর পান,হাতিরপুলের নাহার প্লাজার গলিতে মানুষের পায়ের কয়েকটা টুকরা পড়ে আছে।ঘটনাস্থলে মানুষের পায়ের হাড় দেখতে পান তিনি।উপস্থিত লোকজন আরও জানান,স্কাই গার্ডেন হোটেলের কয়েকটি কক্ষের টয়লেটের কমোডে রক্ত মেশানো পানি উপচে পড়ছে এবং পাশের ভবনের ছাদের ওপর মাথা,হাড় ও বুকের খাঁচা পড়ে আছে।

শিরিনা বেগম (৫২) এখন থাকেন ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার আলফাডাঙ্গা ইউনিয়নের নাওরা মিঠাপুর গ্রামে। চার মেয়ে এক ছেলের মধ্যে রুমি ছিলেন তৃতীয়।ছোট ছোট সন্তান রেখে স্বামী সোবহান ফকির কম বয়সে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।শিরিনা বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ করে টেনেটুনে সংসার চালাতেন।পরে এক আত্মীয়ের পরামর্শে ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঢাকার মিরপুরে চলন্তিকা মোড়ের কাছের বস্তিতে ওঠেন।একটি পোশাক কারখানায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ নেন।একপর্যায়ে বড় ও মেজ মেয়ে ওই কারখানায় সহকারীর (হেলপার) কাজে ঢোকেন।ঘটনার মাত্র ২৬ দিন আগে রুমি একই কারখানায় কোয়ালিটি বিভাগে কাজ পান। শিরিনা বেগমের ভাষায়,‘রুমি ক্লাস এইট পাস ছিল।তাই ভালো কাজ পাইছিল।’

ঘটনার সময় তিনি ঢাকা থেকে গ্রামে গিয়েছিলেন।রুমি রাতে বাসায় না ফেরায় ঢাকায় বড় দুই মেয়ে খোঁজাখুঁজি করে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন।রুমিকে সমাহিত করা হয় গ্রামের বাড়িতে।

সেদিন যা ঘটেছিল:-
রুমি ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পর লাশ টুকরা করার ঘটনার মামলার বাদী পুলিশ।শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আবদুছ ছামাদের বয়ানে মামলার এজাহারে বলা হয়, তিনিসহ আরও দুজন পুলিশ সদস্য হাতিরপুলের নাহার প্লাজায় অজ্ঞাতনামা এক ‘মহিলা’র (১৫) খণ্ডিত লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন।ঘটনাস্থল থেকে তিনি একটি কাঠের বাঁটযুক্ত ১২ ইঞ্চি লম্বা চাকু,একটি কাঠের বাঁটযুক্ত ১ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার দা,একটি তোয়ালে ও একটি সেমিজ জব্দ করেন। ২০১২ সালের ২ জুন বেতার বার্তার মাধ্যমে খবর পান,হাতিরপুলের নাহার প্লাজার গলিতে মানুষের পায়ের কয়েকটা টুকরা পড়ে আছে।ঘটনাস্থলে মানুষের পায়ের হাড় দেখতে পান তিনি।উপস্থিত লোকজন আরও জানান,স্কাই গার্ডেন হোটেলের কয়েকটি কক্ষের টয়লেটের কমোডে রক্ত মেশানো পানি উপচে পড়ছে এবং পাশের ভবনের ছাদের ওপর মাথা,হাড় ও বুকের খাঁচা পড়ে আছে।

এ ঘটনায় নাহার প্লাজায় অবস্থিত হোটেল,ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কর্মচারী,লিফটম্যানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।তাঁরা জানান,নাহার প্লাজার ১৩ তলায় ১৩০৮ নম্বর কক্ষে মো. সাইদুজ্জামান বাচ্চু (২৮) নামে এক ব্যক্তির সোনালী ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস নামের এক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় রয়েছে।ঘটনার আগের দিন ১ জুন সন্ধ্যার সময় সাইদুজ্জামান ১৫ বছর বয়সী এক মেয়েকে নিয়ে তাঁর অফিসে ঢুকেছিলেন।মার্কেটের ওই কর্মচারীরা পরে বাইরে থেকে দরজায় ধাক্কা দিলেও ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেননি।রাত সাড়ে আটটার দিকে আবারও দরজায় নক করলে কেউ সাড়া না দেওয়ায় তাঁরা চলে যান।পরদিন ২ জুন সকাল সোয়া ৮টার দিকে নাহার প্লাজার গলিতে হাড়–মাংস দেখে লোকজন হইচই শুরু করে।পরে ওই কর্মচারীরা আবার ১৩০৮ নম্বর কক্ষে যান এবং দরজায় ধাক্কা দেন।দরজা না খোলায় ভেন্টিলেটর দিয়ে তাঁরা দেখতে পান যে কক্ষের লাইট জ্বালানো ও ফ্যান চলছে।টয়লেট থেকে পানি পড়ার টিপটিপ শব্দ হচ্ছে।কক্ষের ভেতর সাইদুজ্জামান হেলান দিয়ে বসে আছেন।কর্মচারীরা দরজা খোলার জন্য বললে তিনি দরজা না খুলে বলেন,তাঁর অফিসের ব্যবস্থাপক ইলিয়াস চৌধুরী এলে তিনি দরজা খুলবেন।পরে এসআই আবদুছ ছামাদ গিয়ে সাইদুজ্জামানকে পুলিশের হেফাজতে নেন।

আবদুছ ছামাদ এখন রাজধানীর উত্তরখান থানার এসআই। গত ২৯ নভেম্বর ঘটনাটি সম্পর্কে তিনি বলেন,সাইদুজ্জামান দরজা না খোলায় বিভিন্ন দোকানের কর্মচারীরা দরজার বাইরে থেকে তালা দিয়ে দেন।ওই অফিসকক্ষেই সাইদুজ্জামান থাকতেন এবং রান্না করে খেতেন।

মধুখালী থানার ওসি শহিদুল ইসলাম বলেন,থানায় সাইদুজ্জামানের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে।আপনি মামলাটির বিষয়ে জানতে চাওয়ার পর গত ৩০ নভেম্বর আসামির গ্রামের বাড়িতে খোঁজ নেওয়া হয়েছে।গ্রামবাসীরা বলেছেন, এত বছরেও সাইদুজ্জামান বাড়িতে আসেননি।তাঁর এক ভাই জার্মানিতে থাকেন।গ্রামবাসীদের সন্দেহ,সেখানেও পালিয়ে গিয়ে থাকতে পারেন তিনি।

আবদুছ ছামাদ বলেন, ‘রুমে ঢুকে দেখি,নির্বিকার ভঙ্গিতে সাইদুজ্জামান সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে।সব পরিষ্কার করে নিজে গোসল করে বসে আছে।’ তিনি জানান,প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে সাইদুজ্জামান স্বীকার করেন যে দুই বছর আগে মুঠোফোনে রুমির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়।প্রায়ই রুমির সঙ্গে তাঁর কথা হতো,দেখা হতো।মাঝেমধ্যে রুমি ওই অফিসে আসত।তাঁদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল।ঘটনার দিন লোকজন যখন বাইরে থেকে তালা দিয়ে দেয়,তখন সাইদুজ্জামান চিন্তায় পড়ে যান।লোকজন জানাজানির ভয়ে মেয়েটিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে ঘরের বটি ও চাকু দিয়ে টুকরা টুকরা করেন।

‘প্রচণ্ড রাগ হয়’
ঘটনার সময় রুমির ছোট ভাই আল আমিন শিশু ছিলেন। এখন তাঁর বয়স ২৩ বছর।গ্রামে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চালান।মা, স্ত্রী, এক ছেলে ও ভাগ্নিকে নিয়ে তাঁর সংসার। গ্রামে তাঁদের ভিটেমাটিও নেই।অন্যের জায়গায় ঘর করে থাকেন।আল আমিন মুঠোফোনে জানান,১০ বছর ঢাকায় থাকার পর গত বছর গ্রামে ফিরে আসেন।মামলার বিষয়ে আর খোঁজ নেন না।তিনি বলেন, ‘শুনছি,অনেক টাকা দিয়ে আসামি চিকিৎসার কথা বলে জামিন নিছিল।আমাদের সে রকম হাত (ক্ষমতা) নাই,লোক নাই,টাকাও নাই।আমার প্রচণ্ড রাগ হয়।’

মামলা চালাতে রুমির পরিবারকে আইনি সহায়তা দিয়েছিল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।সংগঠনের লিগ্যাল এইড অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক দীপ্তি সিকদার জানান,সাইদুজ্জামান জামিন পাওয়ার পর এর বিরুদ্ধে মহিলা পরিষদ অ্যাটর্নি জেনারেলকে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দিয়েছিল। কাজ হয়নি। তিনি বলেন,আমার দীর্ঘ আইনজীবী জীবনে এমন নৃশংস ঘটনা দেখিনি।রুমির লাশ দেখেছি।ডোম প্রতিটি টুকরা একসঙ্গে করে সেলাই করে দিয়েছিলেন।এ ধরনের ঘটনায় সুষ্ঠু বিচার না হলে সমাজে তা খারাপ উদাহরণ তৈরি করে।’

আসামি এখন কোথায়?
জামিন নেওয়ার পর আসামি সাইদুজ্জামান বিদেশে পালিয়ে গেছেন বলে ধারণা করা হয়।সাইদুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার জাহাপুর ইউনিয়নের বকশী চাঁদপুর গ্রামে।

আসামির অফিসকক্ষে রুমির মুঠোফোন পাওয়া গিয়েছিল। ঢাকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে প্রথমে যোগাযোগ করা হয়েছিল আলফাডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এ কে এম আহাদুল হাসানের সঙ্গে।তাঁর কাছ থেকেই সন্ধ্যায় রুমির মা হত্যার কথা জানতে পারেন।আহাদুল হাসান সম্প্রতি বলেন,এমন ঘৃণ্য অপরাধ করা আসামির সাজা কার্যকর না হওয়া দুঃখজনক।মধুখালী থানায় একাধিকবার তিনি আসামির খোঁজে যোগাযোগ করে জেনেছেন,আসামি মালয়েশিয়া বা অন্য কোনো দেশে পালিয়ে গেছেন।

কথা বলার একপর্যায়ে নিহত রুমির মা বলেন,এখনো বিচারের আশা ছাড়ি নাই।আপনারা সাংবাদিকেরা অনেক সাহায্য করেছিলেন।আপনারা সবাই মিলে আরেকবার চেষ্টা করলে আসামি ধরা পড়তে পারে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মধুখালী থানার ওসি শহিদুল ইসলাম বলেন,থানায় সাইদুজ্জামানের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে।আপনি মামলাটির বিষয়ে জানতে চাওয়ার পর ৩০ নভেম্বর আসামির গ্রামের বাড়িতে খোঁজ নেওয়া হয়েছে। গ্রামবাসী বলেন,এত বছরেও সাইদুজ্জামান বাড়িতে আসেননি। তাঁর এক ভাই জার্মানিতে থাকেন।গ্রামবাসীদের সন্দেহ, সেখানেও পালিয়ে গিয়ে থাকতে পারেন তিনি।

সাইদুজ্জামানের বড় ভাই জাহাপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য শেখ মনসুর আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান,তাঁদের ১১ ভাই-বোনের মধ্যে সাইদুজ্জামান সবার ছোট।শিশু অবস্থায় মা-বাবা হারানো সাইদুজ্জামান ঢাকায় অন্য ভাইয়ের কাছে বড় হয়েছেন। আইএ/বিএ পাস করেছেন।তিনি দাবি করেন,রুমি হত্যার পর থেকে ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই।জামিন নেওয়ার পর তাঁর ভাই একদিন বাড়িতে এসেছিলেন।অল্প সময়ের মধ্যেই বিদেশে চলে যান।কোন দেশে গেছে জানতে চাইলে বলেন, ‘সেটা বলতে পারব না।থাইল্যান্ড হতে পারে।’

কথা বলার একপর্যায়ে রুমির মা এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘এখনো বিচারের আশা ছাড়ি নাই।আপনারা সাংবাদিকেরা অনেক সাহায্য করছিলেন।আপনারা সবাই মিলে আরেকবার চেষ্টা করলে আসামি ধরা পড়তে পারে।’

আরও খবর

Sponsered content