জাতীয়

উচ্চকক্ষ কোনো আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করতে পারবে না-সংবিধান সংস্কার কমিশন

  প্রতিনিধি ২৭ জানুয়ারি ২০২৫ , ৬:৪৪:৩৮ প্রিন্ট সংস্করণ

0Shares

নিজস্ব প্রতিবেদক।।দ্বিকক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ হলে উচ্চ ও নিম্নকক্ষের ক্ষমতা বা কাজ কী হবে—এ প্রশ্নে নানা আলোচনা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।বিএনপিসহ বিভিন্ন দল দুই কক্ষের সংসদ চায়।তারা অবশ্য দুই কক্ষের কাজ বা ক্ষমতার ব্যাপারে কোনো প্রস্তাব প্রকাশ করেনি।উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের ক্ষমতা ও এর পার্থক্য নিয়ে বিস্তারিত সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে,সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে,জাতীয় সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হলে উচ্চকক্ষ কোনো আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করতে পারবে না। তবে অর্থ বিল ছাড়া অন্য সব বিল বা আইনের খসড়া নিম্নকক্ষে পাস হওয়ার পর তা উচ্চকক্ষে তুলতে হবে। উচ্চকক্ষ বিল অনুমোদনের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সংশোধনীর সুপারিশ করে তা নিম্নকক্ষে ফেরত পাঠানোর ক্ষমতা রাখবে। তবে তাদের সে সুপারিশ আমলে নিতে নিম্নকক্ষ বাধ্য থাকবে না।চূড়ান্ত বিচারে আইন করার ক্ষমতা নিম্নকক্ষের হাতেই থাকবে।

১৫ জানুয়ারি নিজেদের সুপারিশের সারসংক্ষেপ প্রকাশ করে সংবিধান সংস্কার কমিশন।সেখানে দুই কক্ষের সংসদ করার সুপারিশ করা হয়েছে।নিম্নকক্ষের নাম হবে জাতীয় সংসদ এবং উচ্চকক্ষের নাম সিনেট।তবে কোন কক্ষের কী ক্ষমতা থাকবে, তা সুপারিশের সারসংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়নি।

সংবিধান সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়,সংসদের দুই কক্ষের মধ্যে কোন কক্ষের কী ক্ষমতা থাকবে,তা তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে বিস্তারিত আছে।আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখা ছাড়াও উচ্চকক্ষের আরও কিছু ক্ষমতা থাকবে।নিম্নকক্ষের মতো সংসদের উচ্চকক্ষও প্রয়োজনীয় সংসদীয় কমিটি গঠন করতে পারবে।রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি করার আগে সংসদের নিম্নকক্ষের পাশাপাশি উচ্চকক্ষের অনুমোদন নিতে হবে।এই অনুমোদন নিতে হবে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে।সংবিধান সংশোধন করার ক্ষেত্রেও নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষে দুই–তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন হবে।উভয় কক্ষে পাস হওয়ার পর তা নিয়ে গণভোট হবে।উচ্চকক্ষের সদস্যদের মর্যাদা ও সুযোগ–সুবিধা নিম্নকক্ষের সদস্যদের মতো একই হবে।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন,অন্য সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশের সঙ্গে সমন্বয় করার পর সংবিধান সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।

যেভাবে উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে,তাতে এটি রাজনৈতিকভাবে প্রতিনিধিত্বশীল হবে।

নিজাম উদ্দিন আহমদ,সংসদবিষয়ক গবেষক ও অধ্যাপক
বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন থেকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা বলে আসছে।বিএনপি লিখিতভাবে সংবিধান সংস্কার কমিশনকে যে ৬২ দফা প্রস্তাব দিয়েছিল, সেখানেও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের কথা বলেছে।জাতীয় নাগরিক কমিটিও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব দিয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের মতবিনিময়েও অংশীজনদের অনেকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালুর প্রস্তাব দেন।অবশ্য কোন কক্ষের ক্ষমতা কী হবে,তা নিয়ে অনেকে নিজেদের প্রস্তাবের বিস্তারিত প্রকাশ করেনি। তবে জাতীয় নাগরিক কমিটি তাদের প্রস্তাবে বলেছিল,উভয় কক্ষে কোনো বিল আলাদাভাবে পাস হলে তখনই কেবল তা আইনে পরিণত হবে।

এখন দেশের জাতীয় সংসদ এক কক্ষের।কোনো নতুন আইন করতে গেলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী (বেসরকারি বিলের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সদস্য) সংসদে তা বিল (আইনের খসড়া) আকারে উত্থাপন করেন। সরকারি বিলের ক্ষেত্রে তা সংসদে তোলার আগে মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করা হয়।সংসদে কোনো বিল পাস হওয়ার পর তা রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানো হয়। রাষ্ট্রপতির সম্মতির পর তা আইনে পরিণত হয়।এরপর সরকার এ–সংক্রান্ত গেজেট প্রজ্ঞাপন জারি করে।

আইন তৈরির ক্ষমতা নিম্নকক্ষের?
সংবিধান সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়,সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হলে তখনো বিল উত্থাপনের প্রক্রিয়া একই থাকবে।আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করার ক্ষমতা থাকবে নিম্নকক্ষের।উচ্চকক্ষের এই ক্ষমতা থাকবে না।তবে সংসদের নিম্নকক্ষে কোনো বিল পাস হলে তা উচ্চকক্ষে তুলতে হবে।উচ্চকক্ষ ওই বিল পর্যালোচনা করে অনুমোদন করতে পারবে বা পুনর্বিবেচনার জন্য সুপারিশসহ আবার নিম্নকক্ষে ফেরত পাঠাতে পারবে।এ ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষকে বিল অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যানের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকবে।ওই সময়ের মধ্যে তাদের কোনো বিল পাস বা নিম্নকক্ষে ফেরত পাঠাতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উচ্চকক্ষ যদি বিল অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান না করে,তাহলে বিলটি উচ্চকক্ষ অনুমোদন করেছে বলে ধরে নেওয়া হবে।কোনো বিল সংসদের উভয় কক্ষে পাস হলে তখন তা রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানো হবে।

আর যদি নিম্নকক্ষে কোনো বিল পাস হওয়ার পর উচ্চকক্ষ তা পাস না করে,তাহলে প্রয়োজনীয় সংশোধনী সুপারিশ করে তারা তা নিম্নকক্ষে ফেরত দেবে।উচ্চকক্ষের সংশোধনী পুরোটা বা আংশিক গ্রহণ করা বা পুরোটা প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা রাখবে নিম্নকক্ষ।যদি নিম্নকক্ষে পরপর দুটি অধিবেশেন পাস হওয়া বিল উচ্চকক্ষ ফেরত পাঠায় এবং এরপর নিম্নকক্ষ পরবর্তী অধিবেশনে ওই বিল আবারও পাস করে তা সরাসরি রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য পাঠাতে পারবে।এ ক্ষেত্রে আর উচ্চকক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে না।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী,নিম্নকক্ষের ৪০০ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন জনগণের সরাসরি ভোটে।আর উচ্চকক্ষে আসন থাকবে ১০৫টি।এর মধ্যে পাঁচজনকে মনোনয়ন দেবেন রাষ্ট্রপতি।বাকি ১০০টি আসন বণ্টন করা হবে জাতীয় নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে।জাতীয় নির্বাচনে দল বা জোটগুলো সারা দেশে যত ভোট পাবে,সে অনুপাতে বণ্টন করা হবে। দলগুলোকে উচ্চকক্ষের ১০০ প্রার্থীর মধ্যে অন্তত এমন পাঁচজনকে মনোনয়ন দিতে হবে,যারা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের।

উচ্চকক্ষের সংশোধনী পুরোটা বা আংশিক গ্রহণ করা বা পুরোটা প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা রাখবে নিম্নকক্ষ।যদি নিম্নকক্ষে পরপর দুটি অধিবেশেন পাস হওয়া বিল উচ্চকক্ষ ফেরত পাঠায় এবং এরপর নিম্নকক্ষ পরবর্তী অধিবেশনে ওই বিল আবারও পাস করে তা সরাসরি রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য পাঠাতে পারবে।এ ক্ষেত্রে আর উচ্চকক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে না।

উচ্চকক্ষ হলে কি পরিবর্তন আসবে:-
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন,এই পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠিত হলে সেখানে একধরনের ভারসাম্য ও বৈচিত্র্য থাকবে।নিম্নকক্ষে কোনো দলের প্রতিনিধিত্ব না থাকলেও উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্ব থাকতে পারে।এখানে তুলনামূলক বেশিসংখ্যক দল এবং সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে।এর ফলে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষে অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনার সুযোগ তৈরি হবে।উচ্চকক্ষ যৌক্তিকভাবে এবং জনস্বার্থ বিবেচনায় কোনো বিল বা বিলের ধারায় সংশোধনী আনার সুপারিশ করলে বা কোনো বিল ফেরত পাঠালে তা নিয়ে জনপরিসরেও আলোচনা তৈরি হবে।এটি সংসদের নিম্নকক্ষের ওপর চাপ হিসেবে কাজ করবে।আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষ একটি ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’বা ভারসাম্যের রাখার জায়গা হিসেবে কাজ করবে।তবে যেহেতু নিম্নকক্ষের সদস্যরা জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন,তাই তাঁদের ক্ষমতা বেশি রাখা যুক্তিযুক্ত।

বিএনপি,গণতন্ত্র মঞ্চ,জামায়াতে ইসলামী,কমিউনিস্ট পার্টিসহ (সিপিবি) বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের প্রতিক্রিয়ায় কমিশনগুলোর প্রতিবেদন দেওয়ার বিষয়কে ইতিবাচক হিসেবে বর্ণনা করেছে।তবে কমিশনগুলো পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ না করায় দলগুলোও সামগ্রিকভাবে প্রতিক্রিয়া দেয়নি।বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও অন্য দলগুলোর নেতারা বলে আসছেন,ফেব্রুয়ারিতে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে সুপারিশের বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ হবে বলে তাঁরা আশা করছেন।

প্রথম ধাপে গঠন করা ছয়টি কমিশনের প্রধানেরা কমিশনগুলোর সুপারিশ সমন্বয় করার পর আগামী মাসের মাঝামাঝি থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করবে অন্তর্বর্তী সরকার।এর মধ্য দিয়ে সুপারিশগুলো গ্রহণের সিদ্ধান্ত আসবে।

সংসদবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ বলেন,ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আইনপ্রণেতাদের মধ্যে অনেক বড় মাপের আইনে বিশেষজ্ঞ আছেন।বাংলাদেশে এর ঘাটতি আছে। সংসদে আইন পাস হয় মূলত দলীয় সিদ্ধান্তে।এখানে খুব বেশি আলোচনা হয় বা রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকে,তেমনটা দেখা যায় না।তিনি মনে করেন,যেভাবে উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে,তাতে এটি রাজনৈতিকভাবে প্রতিনিধিত্বশীল হবে। দলগুলো উচ্চকক্ষে বিশেষজ্ঞদেরও মনোনয়ন দিতে পারবে। এতে বিল নিয়ে আলোচনা দলীয়ভাবে কিছুটা প্রতিনিধিত্বশীল হবে।এটি নতুন একটি “এক্সপেরিমেন্ট” হিসেবে দেখা যায়।’ অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ বলেন,অনেক দেশে উভয় কক্ষ একসঙ্গে বিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়।তবে এখানে যেহেতু নিম্নকক্ষের সদস্যরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন, তাই তাঁদের ক্ষমতা বেশি দিতে হবে।’

0Shares

আরও খবর

Sponsered content

0 Shares