বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সংবাদ

আলমগীরের ফ্রিল্যান্সার ডটকম,আপওয়ার্ক ও ফাইভআরের মতো মার্কেটপ্লেসের মাসিক আয় ৪ লাখ টাকা!

  প্রতিনিধি ২৭ জানুয়ারি ২০২৩ , ১:৪৮:০৯ প্রিন্ট সংস্করণ

মাজহারুল ইসলাম।।আলমগীর ইসলামের জীবনটা যুদ্ধময়।ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পণ্য সরবরাহকারীর চাকরি করতেন।পদের নাম ছিল ‘ডেলিভারি বয়’। দিনে পণ্য পৌঁছে দিতেন নানা জায়গায়।শৈশবেই মা–বাবার বিচ্ছেদ দেখেন।এরপর সিঙ্গাইরে নানাবাড়িতে বেড়ে ওঠা।নানার পরিবার ছিল অসচ্ছল।

তাই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে পেরেছেন তিনি।মাত্র ১৩ বছর বয়সেই জীবিকার সন্ধানে নামতে হয় আলমগীরকে।বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরির ঢাকার এক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে যোগ দেন তিনি।মাঝখানে আবার সিঙ্গাইরে ফিরে গিয়েছিলেন পড়াশোনা করতে। কিন্তু সচ্ছলতা না থাকায় পড়াশোনা শুরুই করতে পারেননি।

আলমগীর ইসলাম রাতে কম্পিউটার শেখার চেষ্টা করতেন। ধীরে ধীরে কম্পিউটার গ্রাফিক ডিজাইনে দক্ষ হয়ে ওঠেন। শুরু করেন তথ্যপ্রযুক্তির ফ্রিল্যান্সিং।সেখানে আসে সফলতা। মানিকগঞ্জের আলমগীর এখন হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা।নিজের গড়া তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডিসকভার আইটি ইনস্টিটিউট চালাচ্ছেন সফলতার সঙ্গে।

গত ৩১ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলায় আলমগীরের সঙ্গে কথা হয় তাঁর তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে বসে।২০০৭ সালে ঢাকার একটি তৈরি পোশাক কারখানার যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন আলমগীর। আরামবাগে অফিস।তাঁর কাজ বিভিন্ন পোশাক কারখানায় পণ্য পৌঁছে দেওয়া।

অফিসেরই একটা ঘরে আলমগীরের থাকার ব্যবস্থা।সেখানে ছিল কম্পিউটার।এখান থেকেই আলমগীরের জীবনে শুরু হয় নতুন বাঁক।কারণ,আলমগীরের ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর।সারা দিন কাজ করতেন পণ্য সরবরাহকারী হিসেবে।আর রাতে কম্পিউটার নাড়াচাড়া করতেন।পাশের এক অফিসে গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ দেখতেন আলমগীর।কি বোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, আবার কম্পিউটার মনিটরের দিকে তাকাতেন।কী হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে,সেটা মাথায় গেঁথে নেওয়ার চেষ্টা করতেন।আর রাতে এসে কম্পিউটারে অনুশীলন করতেন।এভাবেই কম্পিউটার শেখা শুরু আলমগীরের।

বারকোডের নকশা তৈরির একটা কাজ চলছিল অফিসে। অফিসের কর্তাই সেটা করছিলেন।হঠাৎ গিয়ে আলমগীর তাঁকে বললেন,বস আমি করি?’ কর্তা প্রথমে রাজি হলেন না।কিন্তু আলমগীর নাছোড়বান্দা।আলমগীর কম্পিউটারে কাজটি করে দিলেন।আলমগীর বললেন,সেই যে কম্পিউটারে বসলাম,আর ছাড়িনি।কাজ করে গেছি গ্রাফিক ডিজাইনের।বেতন ও সম্মান দুটিই বেড়েছিল ওই অফিসে।সেটা ২০০৮ সালের কথা।

আবার পড়াশোনা:-আলমগীর ইসলামের পড়াশোনা করার অনেক ইচ্ছা।কিন্তু একা কী করবেন?চাকরি থেকে মোটামুটি ভালোই আয় হচ্ছিল।২০১০ সালে আলমগীর ভর্তি হলেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএসসি প্রোগ্রামে।বাণিজ্য বিভাগে সিদ্ধেশ্বরী বালক উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভর্তি হয়ে যান আলমগীর।তিনি বলেন,একসময় খুব কাঁদতাম। আর নিজেকেই বুঝ দিতাম পড়ালেখা সবার কপালে জোটে না।’ অবশেষে ২০১৪ সালে এসএসসি পাস করেন তিনি।এ সময়েই ওয়েবসাইটে কানাডাভিত্তিক একটি তেল কোম্পানির চাকরির বিজ্ঞাপন দেখতে পান।আবেদন করেন কম্পিউটার কন্ট্রোল রুম অপারেটর পদে।ভিসা ফরমও চলে আসে।কিন্তু আলমগীর তো দেশে থেকে কিছু করতে চান,তাই কানাডায় আর গেলেন না।

স্বপ্ন হলো বড়:-আলমগীর কাজ জানতেন;কিন্তু কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সনদ ছিল না।২০১৫ সালে তাঁর বন্ধু আতিকুর রহমান প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরামর্শ দেন।ঢাকার ক্রিয়েটিভ আইটি ইনস্টিটিউটে গ্রাফিক ডিজাইন কোর্সে ভর্তি হলেন আলমগীর।চাকরির পাশাপাশি সপ্তাহে দুই দিন ক্লাস করতেন। কোর্স করতে করতেই তিনি জানতে পারলেন ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে।ফ্রিল্যান্সিং করে ভালো আয় হয়,সেটিও প্রথম শুনলেন।জানলেন,ফ্রিল্যান্সার ডটকম,আপওয়ার্ক ও ফাইভআরের মতো মার্কেটপ্লেসের (অনলাইন কাজের বাজার) কথা।কীভাবে কী করতে হবে,তা বুঝে নিলেন প্রশিক্ষকের কাছ থেকে।আলমগীর ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রথম কাজ করেন ২০১৫ সালে।ফ্রিল্যান্সার ডটকমে লোগো তৈরির প্রতিযোগিতায় প্রথম হয় তাঁর নকশা।আয় করেন ১৫০ মার্কিন ডলার।

ডিসকভার আইটি ইনস্টিটিউট:-আলমগীর অভিজ্ঞতা থেকে বুঝলেন তাঁর মতো অনেকেই আছেন,যাঁরা কিছু করতে চান। কিন্তু পারছেন না।২০১৬ সালে আলমগীর তাঁদের জন্য প্রতিষ্ঠা করলেন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডিসকভার আইটি ইনস্টিটিউট। ঢাকার ফকিরেরপুল এলাকায় যেহেতু দীর্ঘদিন কাজ করেছেন, তাই সেখানে একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে ছোট পরিসরে প্রশিক্ষণকেন্দ্র খুললেন।ভালোই সাড়া পেলেন।অনেকে আগ্রহী হলেন।ফ্রিল্যান্সিং শেখার একটি ব্যাচও তৈরি হলো।আলমগীর ধীরে ধীরে তৈরি করলেন দক্ষ কর্মী।কাউকে কাউকে নিয়োগ দিলেন নিজের প্রতিষ্ঠানে।

আবার ফেরা সিঙ্গাইরে:-২০১৯ সালে আলমগীর ইসলাম মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে ফিরে এলেন।যখন গ্রামে ফিরে এলেন, তখন তাঁর ঢাকার প্রতিষ্ঠানে ১০ জন কর্মী কাজ করেন। আলমগীরের মাসিক আয় তখন প্রায় চার লাখ টাকা। চারজন কর্মীকে সিঙ্গাইরে নিয়ে যান।বাকি ছয়জন ঢাকায় ফ্রিল্যান্সিং করেন।তিনি বলেন,দেখলাম,শহরে শেখার অনেক সুযোগ আছে।কিন্তু গ্রামে নেই।গ্রামের তরুণদের অনেকেরই ইচ্ছা ফ্রিল্যান্সিং বা ভালো কোনো কাজ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর।তাই গ্রামে এসে কাজ শুরু করলাম।’

সিঙ্গাইর পৌরসভা কার্যালয়ের পাশে দুই হাজার বর্গফুটের অফিস ভাড়া নিলেন আলমগীর।সেখানে নতুন করে গোছাতে লাগলেন ডিসকভার আইটি ইনস্টিটিউট।

বর্তমানে আলমগীরের প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণার্থী ১০০ জন।গত চার বছরে তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে ৪৫টি ব্যাচে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন ১ হাজার ১০০ জন।এর মধ্যে ২০০ জনকে বিনা মূল্যেই শিখেয়েছেন।

২০১৩ সালে নানা-নানির কথামতো আলমগীর ইসলাম বিয়ে করেন।তখনো তিনি চাকরি করেন।আলমগীর এখন তিন মেয়ের বাবা।২০১৯ সালে নিজ গ্রামে নানাবাড়িতে নতুন বাড়িও করেছেন।একই বছর তাঁর নানার যকৃৎ ক্যানসার ধরা পড়ে। আলমগীর নানার চিকিৎসা করান।আড়াই বছর টানা চিকিৎসার পর গত বছর নানা মারা যান।

সিঙ্গাইরে ফিরে গেলেও অনলাইন কাজের বাজার ফাইভআর ও আপওয়ার্কে কাজ করেন এখনো।এই দুই ওয়েবসাইটের শীর্ষস্থানীয় ফ্রিল্যান্সারদেরও (টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার) একজন তিনি।মাঝখানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানেও চাকরি শুরু করেন বাংলাদেশ থেকে।মাসিক বেতন ছিল প্রায় আড়াই হাজার মার্কিন ডলার।এ চাকরির চুক্তি শেষ হওয়ার পর এখন যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।মাসিক বেতন দুই হাজার ডলার।সিঙ্গাইরে নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে মাসিক আয় হচ্ছে লাখ টাকার ওপরে।

আলমগীর ইসলাম বলেন,আমার ইচ্ছা প্রতিষ্ঠানটিকে আরও বড় করা।এখন সিঙ্গাইরে চারজন কর্মী আছেন।একসময় শতজন কর্মী আমার প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন,এটা আমার স্বপ্ন।এত দিন ঢাকায় থাকলে আমার স্বপ্নটা হয়তো পূরণ হতো।কিন্তু আমার চিন্তাভাবনা নিজ গ্রাম ঘিরে।গ্রামের ছেলেমেয়েদের দক্ষ করে তুলতে চাই। সেটি সম্ভব হলে মনে করব,আমি সফল হয়েছি।’

আরও খবর

Sponsered content