প্রতিনিধি ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫ , ২:৩৮:৫৩ প্রিন্ট সংস্করণ
অনলাইন ডেস্ক রিপোর্ট।।অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার দাগি আসামির অস্বাভাবিক জামিন,অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা ও হত্যাচেষ্টার পেছনের গোপন প্লট সামনে আসছে

প্রশ্নের মুখে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা
উগ্রবাদী সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে রহস্য।পুলিশের প্রকাশিত তথ্য এবং তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের বক্তব্যে উঠে আসছে এমন সব ইঙ্গিত,যা এই হত্যাচেষ্টার পেছনে কেবল ব্যক্তিগত শত্রুতা নয়,বরং রাষ্ট্রের ভেতরের শক্তির সম্ভাব্য সংশ্লিষ্টতার প্রশ্নকে সামনে আনছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) জানিয়েছে,সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ফয়সাল করিম মাসুদ নামে একজন ব্যক্তিকে সন্দেহভাজন শ্যুটার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ডিএমপি তার ছবি প্রকাশ করেছে এবং তাকে ধরিয়ে দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে।
তদন্তে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে এসেছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ফয়সাল করিম মাসুদকে বিশেষ উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপর্যায়ের ইঙ্গিতে কারাগার থেকে বের করা হয়েছিল—এমন প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছেন তদন্তকারীরা।পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে,সরকারি সহায়তায় তাকে জামিনে মুক্ত করে এই হামলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।
এই তথ্য সামনে আসার পর প্রশ্ন উঠেছে—একজন অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হওয়া দাগি অপরাধী কীভাবে এত অল্প সময়ে বারবার জামিন পেলেন?
ফয়সাল করিম মাসুদ: অপরাধের ধারাবাহিক ইতিহাস
২০২৪ সালের ২৮ অক্টোবর, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর ঢাকার আদাবরের বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়া স্কুলের অফিসে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুট হয়।এ ঘটনায় আদাবর থানায় দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি ছিলেন ফয়সাল করিম মাসুদ।
এরপর ৭ নভেম্বর র্যাব তাকে আদাবর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে।তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় দুটি বিদেশি পিস্তল,দুটি ম্যাগাজিন,পাঁচটি গুলি, তিনটি মুঠোফোন এবং নগদ পাঁচ হাজার টাকা।তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা হয় এবং একাধিক গণমাধ্যমে তার পরিচয় ও ছবি প্রকাশিত হয়।
অস্বাভাবিক গতিতে জামিন
এই মামলায় চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মোহাম্মদ আলী ও বিচারপতি এস কে তাহসিন আলীর বেঞ্চ ফয়সাল করিমকে ছয় মাসের জামিন দেন।আদালতের আদেশ দেওয়ার মাত্র তিন দিনের মধ্যে তা সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়—যা সাধারণ বিচারিক প্রক্রিয়ার তুলনায় দ্রুত বলে নথিতে দেখা যায়।
এরপর ১২ আগস্ট একই আসামির জামিনের মেয়াদ বাড়াতে আবারও আবেদন করা হলে বিচারপতি মোহাম্মদ আলী ও বিচারপতি ইউসুফ আব্দুল্লাহ সুমনের বেঞ্চ তাকে নতুন করে এক বছরের জামিন দেন।ফলে অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিনি এক দফায় ছয় মাস এবং পরবর্তী দফায় এক বছরের জামিন পান।
আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী পারভেজ হাসেম এ প্রসঙ্গে বলেন, “সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক,বহু আইনজীবী, বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা,সাংবাদিক,শিল্পী ও সাহিত্যিক দেড় বছর ধরে জেলে আছেন।বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ না থাকলেও তাদের জামিন দেওয়া হচ্ছে না।অথচ দাগি অপরাধীদের গোপনে জামিন দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।প্রশ্ন আসে—তাদের কি হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্যই ছাড়া হয়েছে?”
রাজনৈতিক যোগসূত্র ও ভাইরাল বৈঠক
এই হত্যাচেষ্টার পেছনে রাজনৈতিক যোগসূত্রের কথাও সামনে এসেছে।সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়,ওসমান হাদির সঙ্গে ইসলামী ছাত্র শিবির নেতা সাদিক কায়েমের একাধিক অন্তরঙ্গ বৈঠক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আরিফ জেবতিক তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে সাদিক কায়েমের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।বিশ্লেষক সাব্বির খান লিখেছেন,“পরিকল্পিতভাবে ভয়াবহ অপরাধীদের জেল থেকে বের করে নিষ্ঠুর নাটক মঞ্চস্থ করা হচ্ছে।আরও কতজনকে এভাবে মারা হবে—এটাই এখন বড় উদ্বেগ।”
হাদি: বিতর্কিত চরিত্র ও ‘বলির পাঁঠা’ তত্ত্ব
বিশিষ্ট সংস্কৃতি কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমাম বলেন, “হাদি এক বছর ধরে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ি ভাঙা,মব হামলায় নেতৃত্ব দেওয়া এবং অশ্লীল বক্তব্যের মাধ্যমে পরিচিত।তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের ক্ষোভ সর্বজনবিদিত।তাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগের দিকে আঙুল তোলার সুযোগ তৈরি করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।”
তিনি আরও বলেন, “হাদিকে তারা নিজেদের কেনা বলীর পাঁঠা বানাতে চেয়েছিল।কিন্তু রহস্য ফাঁস হওয়ায় এখন এই ঘটনা তাদের জন্য বুমেরাং হতে চলেছে।”
বিএনপি–শিবির–জামায়াতের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী পুলিশের তথ্য উদ্ধৃত করে বলেন, “এই ঘটনায় জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতা সাদিক কায়েম জড়িত।”
অন্যদিকে ইসলামী ছাত্র শিবির বিএনপির নেতা মির্জা আব্বাসকে মাস্টারমাইন্ড বলে দাবি করে।শিবির নেতা ও ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েম ফেসবুকে এই অভিযোগ তোলেন।পরে মির্জা আব্বাস ঢাকা মেডিকেলে হাদিকে দেখতে গেলে সেখানে তাকে শিবির ও ‘জুলাই যোদ্ধারা’ মিলে নাজেহাল করে।
নির্বাচন, হামলা ও দমন অভিযান
হাদিকে গুলি করা হয় ১২ ডিসেম্বর বিজয়নগরে নির্বাচনী প্রচারণার সময়,ঠিক একদিন আগে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে।বিশ্লেষকদের মতে,এই হামলার মাধ্যমে একদিকে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতির চিত্র দেখানো হয়েছে,অন্যদিকে নির্বাচন বানচাল ও নতুন দমন অভিযান শুরুর অজুহাত তৈরি করা হয়েছে।
হাদিকে গুলির ঘটনার পরপরই অন্তর্বর্তী সরকার “অপারেশন ডেভিল হান্ট: ফেজ–২” চালুর ঘোষণা দেয়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসীদের দমনের উদ্দেশ্যে এই অভিযান শুরু করা হয়েছে।”
মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ ১ হাজার ৫০৬ জনকে গ্রেপ্তার করে,যাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী,আগস্ট ২০২৪ থেকে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অন্তত ৪৪ হাজার ৪৭২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অক্টোবর–নভেম্বরে এই সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়ায়।
হাদির অবস্থা ও উগ্রবাদী হুমকি
হাদিকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়,পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসকদের ভাষায়,তার অবস্থা আশঙ্কাজনক এবং তিনি লাইফ সাপোর্টে আছেন।
এ অবস্থাতেও উগ্রবাদী বক্তব্য থামেনি।এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “ফ্যাসিস্টদের বাংলাদেশে কোনো জায়গা হবে না।”
তিনি আরও বলেন, “ওসমান হাদির রক্তের শপথ—আওয়ামী লীগকে এক ইঞ্চি জায়গাও দেওয়া হবে না।”
ইনকিলাব মঞ্চ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ নিরাপত্তার দাবিতে সক্রিয় ছিল।অন্তর্বর্তী সরকার মে মাসে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করে।
একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে,ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টা এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।দাগি অপরাধীদের রহস্যজনক জামিন,উগ্রবাদী রাজনীতি,গণগ্রেপ্তার ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া বানচালের চেষ্টার সঙ্গে এটি গভীরভাবে যুক্ত।
তাদের আশঙ্কা,সহিংসতাকে ব্যবহার করে গণতান্ত্রিক শক্তিকে দমন এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার একটি সুপরিকল্পিত কৌশল বাস্তবায়ন করা হচ্ছে—যার কেন্দ্রে রয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।

















