প্রতিনিধি ১৫ অক্টোবর ২০২২ , ১:০০:২৫ প্রিন্ট সংস্করণ
মাজহারুল ইসলাম।।অনিয়মের অভিযোগে পুরো নির্বাচন বাতিল করে দেয়ার ঘটনা এর আগে কোনোদিন বাংলাদেশে ঘটেনি বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, বুধবার গাইবান্ধা-৫ সংসদীয় আসনের উপ-নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের এ অবস্থান নজিরবিহীন।
বুধবার সকাল আটটা থেকে শুরু হওয়া গাইবান্ধার সাঘাটা-ফুলছড়ি আসনের উপ-নির্বাচন পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে’ চলে যাওয়ায় সকাল এগারোটা নাগাদ ৪৪ কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
“আমরা দেখতে পাচ্ছি, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে অনেকটা। আমরা দেখতে পাচ্ছি, আপনারাও দেখতে পাচ্ছেন। গোপন কক্ষে অন্যরা ঢুকছে, ভোট সুশৃঙ্খলভাবে হচ্ছে না,” ভোটের অবস্থা সম্পর্কে সাংবাদিকদের বলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হাবিবুল আউয়াল।
“তবে কেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলো, তা আমরা এখন বলতে পারব না,” জানান সিইসি।
এর আগে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর লোকদের ভোটকেন্দ্র দখল, অন্য প্রার্থীদের এজেন্টকে বের করে দেয়া, গোপনকক্ষে অবাধ প্রবেশসহ বিভিন্ন আইনবিরোধী কাজের অভিযোগ তুলে ভোট বয়কটের ঘোষণা দেন বাকি চার প্রার্থী।
নির্বাচন কমিশনের জরুরি সভা শেষে বেলা দুইটার দিকে সম্পূর্ণ উপ-নির্বাচন বন্ধ করার কথা জানান সিইসি।
“সমগ্র নির্বাচনী এলাকা, গাইবান্ধা-৫ নির্বাচনী এলাকার ভোট কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছি,” সাংবাদিকদের বলেন হাবিবুল আউয়াল।
বন্ধ নির্বাচন আবার কবে হবে সে বিষয়ে কমিশন পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানান তিনি।
গত ২২ জুলাই ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়ার মৃত্যুতে এই আসনটি শূন্য হয়।
কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে এটিই প্রথম কোনো সংসদীয় আসনের নির্বাচন। এর আগে তাঁর কমিশনের অধীনে গত জুনে অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু ছিল না বলে অভিযোগ রয়েছে নির্বাচন বিশ্লেষকদের।
সাবেক দুই প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ ও কে. এম. নুরুল হুদা এবং সর্বশেষ বর্তমান সিইসির নেতৃত্বে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে প্রত্যাখ্যান করায় এই উপনির্বাচনে কোনো প্রার্থী দেয়নি প্রধান বিরোধীদল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও তার মিত্ররা।
তাঁদের বক্তব্য, আগের দুই কমিশনের মতো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের জয়ী করতেই কাজ করছে গত ফেব্রুয়ারিতে গঠিত বর্তমান নির্বাচন কমিশন।
আওয়ামী লীগের মো. মাহমুদ হাসান রিপন, জাতীয় পার্টির এ.এইচ.এম. গোলাম শহীদ রঞ্জু, বিকল্প ধারার অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম, স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদুজ্জামান নিশাদ ও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ছিলেন গাইবান্ধা-৫ আসনের প্রার্থী।
আগামী ৫ নভেম্বর সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুতে শূন্য হওয়া ফরিদপুর-২ আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ওই আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ছেলে শাহদাব আকবর লাবু চৌধুরী। বিএনপি এই আসনেও কোনো প্রার্থী দেয়নি।
অভিযোগ জাল ভোট
বুধবার সকাল আটটায় গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরুর পর থেকেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী রিপনের লোকেরা বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র দখল করেছে বলে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন অন্যান্য প্রার্থীরা। তাঁরা স্থানীয় নির্বাচন কমিশনে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ করে ভোটগ্রহণ বন্ধের দাবি জানান।
তাঁদের মতে, ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা ভোট কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দিচ্ছিলেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে জালিয়াতি করছিলেন, ভোটারদের গোপনকক্ষে অবাধে প্রবেশ করছিলেন, অন্যান্য প্রার্থীদের এজেন্টকে বের করে দিচ্ছিলেন।
তবে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর পক্ষে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম ফেসবুকে লেখেন, গাইবান্ধা উপ-নির্বাচনে কোনো অনিয়ম হচ্ছে না, সুন্দর, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
‘ভাবমূর্তি উদ্ধার চেষ্টা’
এর আগের দুই নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ আমলে না নিয়ে মানুষের কাছে ‘গ্রহণযোগ্যতা হারানো’র পর গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচন বন্ধ করার ঘটনাটি “রেকর্ড সৃষ্টি করেছে,” বলে বুধবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম. আমিনুজ্জামান।
অনিয়মের অভিযোগে পুরো নির্বাচন বাতিল করে দেবার মতো ঘটনা এর আগে ঘটেনি বলে জানান তিনি।
এর “কয়েকটি কারণ থাকতে পারে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রথম কারণ, এই নির্বাচন কমিশন সাধারণ মানুষের কাছে তাঁদের ভাবমূর্তি উদ্ধার চেষ্টা থেকেই অনিয়ম আমলে নিয়ে ভোট বন্ধ করেছে।”
দ্বিতীয় সম্ভাব্য কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও পক্ষপাতহীন করতে আন্তর্জাতিক চাপকে বিবেচনায় নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। আমরা দেখেছি, বিদেশি বিভিন্ন কূটনীতিকরা সিইসি’র সাথে দেখা করে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে কথা বলেছেন।”
অধ্যাপক সালাহউদ্দিনের মতে, তৃতীয় কারণ হতে পারে, “সরকারের সম্মতিতেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ইসি।”
“বিরোধী দলগুলো আগামী সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত করার দাবি জানিয়ে আসছে,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আগামী কয়েকটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত করতে পারলে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে এই কমিশন এবং তাদের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন করার একটি শক্ত যুক্তি তৈরি হবে।”
শুরু থেকেই এই নির্বাচন কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করে আসছে বিএনপি। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ইসির সংলাপেও বিএনপি অংশ নেয়নি।
এই নির্বাচন কমিশনও “বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় আনতে কাজ করবে,” অভিযোগ করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেনারকে বলেন, “প্রকৃতপক্ষে তাঁদের কোনো ক্ষমতা নেই। সরকার যা বলে তাঁরা সেটিই করবেন।”
“নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া এই নির্বাচন কমিশন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়,” বলেন মির্জা ফখরুল।
তবে গাইবান্ধা-৫ আসনের ভোট বন্ধের সিদ্ধান্তকে ‘সাহসী পদক্ষেপ’ বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের।
তাঁর মতে, “এই নির্বাচন কমিশন যদি আগামী ভোটগুলোতে এমন সাহসী এবং কঠোর অবস্থান নিতে পারেন সেক্ষেত্রে তাঁদের প্রতি আমাদের আস্থা বাড়তে থাকবে এবং আগামী সংসদ নির্বাচন তাঁদের অধীনে অনুষ্ঠিত করার একটি সুযোগ সৃষ্টি হবে।”