অপরাধ-আইন-আদালত

বিচার বিভাগ নিয়ে মন্তব্যে আইন উপদেষ্টাকে হুঁশিয়ারি সুপ্রিম কোর্ট বারের

  প্রতিনিধি ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫ , ৯:২৪:২৪ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।আইন,বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের সাম্প্রতিক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বিচার বিভাগ ও আইন অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।বিচার বিভাগ সম্পর্কে “অযাচিত ও দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য” করার অভিযোগে তাকে হুঁশিয়ার করেছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি (সুপ্রিম কোর্ট বার)।

সোমবার (গতকাল) ‘সাধারণ আইনজীবী সমাজ’-এর ব্যানারে আয়োজিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন আইন উপদেষ্টাকে বিচার বিভাগ নিয়ে বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান।

❝বিচার বিভাগ নিয়ে এভাবে কথা বলবেন না❞

ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন,

> “আপনি একজন সম্মানিত মানুষ,রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। এখন বিচার বিভাগের আলাদা সচিবালয় হয়েছে, বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে সাংবিধানিকভাবে পৃথক। দায়িত্বশীল চেয়ারে বসে থেকে বিচার বিভাগ নিয়ে এভাবে মন্তব্য করলে তা আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে।”

তিনি আরও বলেন,বিচার বিভাগ নিয়ে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে আইন উপদেষ্টাকে সংযত ও সতর্ক হতে হবে।

আইন উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে আপত্তি

প্রতিবাদ সমাবেশে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল বলেন,

> “আইন উপদেষ্টা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন—উচ্চ আদালত থেকে জামিন কম দেওয়ার কথা বলেছি।এই বক্তব্য সরাসরি বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপের শামিল এবং এটি আদালত অবমাননা।”

তিনি আইন উপদেষ্টার বক্তব্য অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানান।

খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবি

সমাবেশে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান বিন হাদির হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে ব্যারিস্টার খোকন বলেন,

> “খুনিরা আকাশে থাকুক বা মাটির নিচে—তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।”

অন্যান্য বক্তারা

সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন—

অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির মঞ্জু

সুপ্রিম কোর্ট বারের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহফুজুর রহমান মিলন

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম

অ্যাডভোকেট আব্দুল লতিফ

অ্যাডভোকেট মাকসুদ উল্লাহ

সমাবেশটি সঞ্চালনা করেন অ্যাডভোকেট সামসুল ইসলাম মুকুল।

⚖️ আইনি বিশ্লেষণ

১. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সংবিধান

বাংলাদেশ সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বাধ্য।
এছাড়া মাসদার হোসেন মামলা (২০০৭)-এর রায়ে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার নির্দেশনা স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে।

আইন উপদেষ্টা নির্বাহী বিভাগের একজন প্রতিনিধি হিসেবে বিচারপতিদের সিদ্ধান্ত,বিশেষ করে জামিন প্রদানের হার বা নীতি নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করলে তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে।

২. আদালত অবমাননা প্রসঙ্গ

আদালত অবমাননা আইন,২০১৩ অনুযায়ী—

বিচার বিভাগের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় এমন মন্তব্য

বিচারিক কার্যক্রমে হস্তক্ষেপমূলক বক্তব্য

এসব আদালত অবমাননার আওতায় পড়তে পারে।উচ্চ আদালত থেকে জামিন “কম দেওয়ার কথা বলা হয়েছে”—এমন বক্তব্য বিচারিক সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করার ইঙ্গিত বহন করে,যা আইনি দৃষ্টিতে গুরুতর।

৩. ক্ষমতার বিভাজন নীতির লঙ্ঘন

সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অন্যতম স্তম্ভ হলো ক্ষমতার বিভাজন (Separation of Powers)।
নির্বাহী বিভাগের কোনো উপদেষ্টা যদি বিচার বিভাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রকাশ্যে দিকনির্দেশনা দেন,তা এই নীতির পরিপন্থী।

৪. রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব

আইন উপদেষ্টার বক্তব্য বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তুলতে পারে,যা বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ক্ষুণ্ন করার ঝুঁকি সৃষ্টি করে।

উপসংহার

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে,রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিদের বক্তব্য শুধু রাজনৈতিক নয়,আইনি ও সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার মধ্যেই পড়ে। বিচার বিভাগ সংক্রান্ত যেকোনো মন্তব্যে সংযম না দেখালে তা আদালত অবমাননার মতো গুরুতর আইনি জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

এই প্রেক্ষাপটে আইন উপদেষ্টার বক্তব্য প্রত্যাহার এবং ভবিষ্যতে বিচার বিভাগ নিয়ে বক্তব্য প্রদানে সতর্কতা অবলম্বনের দাবি আইন অঙ্গনে ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।

আরও খবর

Sponsered content