প্রতিনিধি ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ , ১০:০৫:৩৬ প্রিন্ট সংস্করণ
মাজহারুল ইসলাম।।শিশুর হাতে হাতকড়া—এই একটি ছবি বা খবরই যথেষ্ট একটি রাষ্ট্রের নৈতিকতা,আইন-শাসন ও মানবিকতার মানদণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য।সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে কোনো শিশুকে হাতকড়া পরানোর ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।প্রশ্ন উঠছে—এটি কি আইনসম্মত? নাকি এটি স্পষ্টতই মানবাধিকার ও শিশুর অধিকার লঙ্ঘনের শামিল?

কী জানা যাচ্ছে (তথ্যভিত্তিক চিত্র)
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়,একটি ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয় এক অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুকে।আটককালীন সময়ে তার হাতে হাতকড়া পরানো হয়,যা প্রত্যক্ষদর্শী ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবির মাধ্যমে জনসমক্ষে আসে। ঘটনার পরপরই বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা শুরু হয় এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা দাবি করা হয়।
কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোথাও কোথাও বলা হয়েছে—পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এটি করা হয়েছিল।শিশুটি সহিংস বা পালানোর চেষ্টা করছিল।কিন্তু এসব ব্যাখ্যা আইনগতভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য—সেটিই মূল প্রশ্ন।
আইনি বিশ্লেষণ
১. শিশু আইন,২০১৩ (বাংলাদেশ)
শিশু আইন,২০১৩ অনুযায়ী—
১৮ বছরের কম বয়সী সবাই শিশু
কোনো শিশুকে গ্রেপ্তার বা আটক করা হলে তাকে হাতকড়া, দড়ি বা অন্য কোনো শারীরিক বাঁধনে আবদ্ধ করা যাবে না।
শিশুকে প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের সঙ্গে একত্রে রাখা নিষিদ্ধ।
আইনের ভাষায়,শিশুর ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক বা অপমানজনক আচরণ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।সুতরাং,হাতকড়া পরানো prima facie (প্রাথমিকভাবে) আইন লঙ্ঘনের শামিল।
২. ফৌজদারি কার্যবিধি (CrPC)
ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৬ ধারা অনুযায়ী,গ্রেপ্তারের সময় অপ্রয়োজনীয় বলপ্রয়োগ নিষিদ্ধ।শিশুদের ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোরভাবে প্রযোজ্য,কারণ তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
৩. সংবিধানের আলোকে
বাংলাদেশ সংবিধানের—
৩১ অনুচ্ছেদ: আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার
৩২ অনুচ্ছেদ: ব্যক্তিস্বাধীনতা
একজন শিশুকে হাতকড়া পরানো তার মর্যাদা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী,যা সংবিধানস্বীকৃত মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন।
৪. আন্তর্জাতিক আইন ও সনদ
বাংলাদেশ যে আন্তর্জাতিক সনদগুলোর পক্ষভুক্ত—
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ (UNCRC)
বেইজিং রুলস (Juvenile Justice Standards)
এসব সনদ অনুযায়ী,শিশুকে সর্বশেষ উপায় হিসেবে আটক করা যাবে এবং কোনোভাবেই নিষ্ঠুর,অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ করা যাবে না।হাতকড়া পরানো স্পষ্টতই এসব মানদণ্ডের পরিপন্থী।
নৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ
আইন শুধু শাস্তির বিধান নয়; আইন সভ্যতার দর্পণ।একটি শিশুর হাতে হাতকড়া মানে—
শিশুর মানসিক বিকাশে গভীর ক্ষত
সমাজে ভয় ও অবিশ্বাসের সংস্কৃতি
রাষ্ট্রের মানবিক মুখ ক্ষুণ্ণ হওয়া
একজন শিশু অপরাধ করলে তার বিচার হবে সংশোধনমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে,প্রতিশোধমূলক নয়—এটাই আধুনিক বিচারব্যবস্থার দর্শন।
দায় কার?
এই ঘটনায় দায় এড়ানোর সুযোগ নেই—
সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্যদের
তদারককারী কর্মকর্তাদের
এবং সর্বোপরি,প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ও জবাবদিহির ঘাটতির
শুধু ‘ভুল হয়েছে’ বললেই দায় শেষ হয় না।প্রয়োজন নিরপেক্ষ তদন্ত,দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঠেকাতে স্পষ্ট নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ।
সম্পাদকীয় মন্তব্য
শিশুর হাতে হাতকড়া কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি আমাদের আইন প্রয়োগের সংস্কৃতির একটি বিপজ্জনক প্রতিফলন।আমরা যদি আজ একটি শিশুর মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হই,তবে আগামী দিনের ন্যায়বিচারও নিরাপদ থাকবে না।
রাষ্ট্রের শক্তি প্রমাণ হয় দুর্বলদের সঙ্গে আচরণে।শিশুর হাতে হাতকড়া নয়—তার হাতে থাকা উচিত শিক্ষা,সুরক্ষা ও সংশোধনের সুযোগ।এটাই আইন,এটাই ন্যায়,এটাই সভ্যতা।

















