সম্পাদকীয়

হাদি হত্যাকাণ্ড: রাষ্ট্রের ছায়ায় খুন, কার দায়,কার বিচার?

  প্রতিনিধি ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ , ৪:১২:৫৯ প্রিন্ট সংস্করণ

মাজহারুল ইসলাম।।এদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী,চাঁদাবাজ ও স্বৈরাচার—এই তিন শক্তি যখন এক সুতোয় গাঁথা হয়, তখন সত্য বলার অপরাধে কাউকে মরতেই হয়।শহিদ ওসমান হাদি সেই নির্মম সত্যের নাম।তাকে হত্যা করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে,কারণ সে তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছিল। হাদি যদি সাধারণ কেউ হতো,খুনিরা আজ হাতকড়া পরত।কিন্তু খুনি যখন রাষ্ট্রের ছায়ায় আশ্রয় পায়, তখন বিচার লাশের সাথেই কবর হয়।

হাদি কোনো দলের পতাকা বহন করেনি,কোনো চাঁটির ছায়ায় দাঁড়ায়নি,ক্ষমতার দরজায় মাথা নোয়ায়নি।সে ছিল স্পষ্টবাদী—সত্যের পক্ষে অবিচল।তাই রাজনীতি,পুলিশ ও দালাল—সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে তাকে শত্রু বানিয়েছে। সত্য বলাই ছিল তার অপরাধ।

আজ হাদি নেই।সূর্য উঠছে,সূর্য ডুবছে।আর পর্দার আড়ালে হিসাব বদলাচ্ছে পরিকল্পনাকারীরা।মিডিয়ার পর্দা বদলাবে, শুরু হবে আবার ঢাকা-৮ আসনের নোংরা রাজনীতি—কে হবে এমপি,কার পেছনে কত টাকা।অনেকের পথের কাঁটা সরে গেছে বলে তারা স্বস্তি পেতে পারে।কিন্তু তারা ভুলে গেছে—হাদি কাঁটা ছিল না,হাদি ছিল আগুন।আগুনকে হত্যা করা যায় না; আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

হাদিকে হয়তো হত্যা করা গেছে,কিন্তু মুছে ফেলা যায়নি। সে রয়ে গেছে কোটি মানুষের বুকের ভেতর।আমরা গর্বিত—হাদি আমাদের দেশের সন্তান,বরিশালের ছেলে।

হে আল্লাহ,তুমি হাদির মতো লাখো হাদি তৈরি করে দাও। এই অন্যায়ের দেশে ন্যায়বিচার চাওয়া আজ বোকামি মনে হলেও,ইনশাআল্লাহ—হাদি হত্যার বিচার আসমানে সিলেক্ট হয়ে গেছে।সেখানে কোনো দালাল নেই,কোনো নাটক নেই—শুধু সত্য আর শাস্তি।

হাদি,তুমি শহিদ।তুমি অমর।তুমি বেঁচে থাকবে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে।আর তোমার রক্ত প্রশ্ন করতেই থাকবে—এই রাষ্ট্র কাদের জন্য?

আইনগত প্রশ্ন ও দায়: কার জবাবদিহি?

শহিদ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড কেবল একটি ব্যক্তিগত খুন নয়—এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ,একটি মানবাধিকার লঙ্ঘন,এবং একটি সম্ভাব্য রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার দলিল।এখানে কয়েকটি মৌলিক আইনগত প্রশ্ন অনিবার্যভাবে উঠে আসে:

১. এফআইআর ও তদন্তের অগ্রগতি কোথায়?
ফৌজদারি কার্যবিধি (CrPC) অনুযায়ী,একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে মামলা রুজু ও নিরপেক্ষ তদন্ত শুরু করা আইনগত বাধ্যবাধকতা।দুই দিন পার হলেও যদি কার্যকর অগ্রগতি না থাকে,তবে প্রশ্ন ওঠে—তদন্ত কি ইচ্ছাকৃতভাবে ধীর করা হচ্ছে?

২. তদন্তকারী সংস্থার নিরপেক্ষতা নিশ্চিত কে করবে?
যদি অভিযোগ থাকে যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো অংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত,তাহলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (UN Minnesota Protocol) স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত অপরিহার্য।সে ক্ষেত্রে বর্তমান কাঠামোতে তদন্ত চলা কি স্বার্থের সংঘাত তৈরি করছে না?

৩. সাক্ষী ও তথ্যদাতাদের নিরাপত্তা কোথায়?
সাক্ষী সুরক্ষা ছাড়া ন্যায়বিচার অসম্ভব। রাষ্ট্র যদি হাদি হত্যার সম্ভাব্য সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়,তবে সেটি সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদের সরাসরি লঙ্ঘন।

৪. রাজনৈতিক দায় এড়ানো যাবে কি?
হাদির বক্তব্য ও অবস্থান যদি কারো রাজনৈতিক স্বার্থে আঘাত করে থাকে,তবে সেই রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ভূমিকা তদন্তের আওতায় আনা কি অপরিহার্য নয়?একটি খুনের ঘটনায় শুধু ‘খুনি’ নয়,উসকানিদাতা,সুবিধাভোগী ও আড়ালকারীরাও আইনগতভাবে দায়ী।

৫. রাষ্ট্র কি তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ?
বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্রকে নাগরিকের জীবন ও মতপ্রকাশের নিরাপত্তা দেওয়ার দায় দিয়েছে।হাদির ক্ষেত্রে যদি রাষ্ট্র সেই নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়ে থাকে,তবে এটি কেবল অপরাধ নয়—এটি একটি সংবিধানিক ব্যর্থতা।

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত হাদি হত্যাকাণ্ড একটি খোলা ক্ষত হয়েই থাকবে।বিচার বিলম্ব মানেই বিচার অস্বীকার।আর যখন বিচার অস্বীকার রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিতে পরিণত হয়,তখন প্রতিটি নীরবতা অপরাধের সহযোগী হয়ে ওঠে।

আরও খবর

Sponsered content