প্রতিনিধি ১৩ জুলাই ২০২৪ , ৫:০৪:১৪ প্রিন্ট সংস্করণ
রবিউল ইসলাম রবি॥বিয়ের প্রায় ২ মাস পর নির্যাতনের ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে দায়েরকৃত মামলার অনুকূলে বাদী ও আসামীর দেয়া আপোষনামায় মামলা নিষ্পত্তি হবার পরই স্বামী কর্তৃক প্রতারণার শিকার হয়েছে নির্যাতিত স্ত্রী।ঘটনাচক্রে একে অপরের বিরুদ্ধে দিয়েছে মামলা।

যৌতুক ও শিশু অপরহণের অভিযোগে স্বামীর বিরুদ্ধে আদালতে পৃথক মামলা দায়ের করেছে স্ত্রী।আবার ‘আখের রস তৈরির মেশিন’ বিক্রয় চুক্তিপত্রের নোটারীতে স্ত্রী মালিকানা থাকলেও ওই মেশিন নিজের দাবী করে আদালতে স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে স্বামী।
খুলনা তেরখাদা উপজেলার কুশলা গ্রামের বাসিন্দা মৃত. মুক্তিযোদ্ধা ওসিকুর রহমান শেখের মেয়ে পান্না বেগম এবং পিরোজপুর নেছারাবাদ উপজেলার চামী গ্রামের আলমের ছেলে সুমনের এর মধ্যে উপরোক্ত বিষয় নিয়ে চলছে আইনি লড়াই।
সুমন বলছেন,তিনি যখন যৌতুক মামলায় ২৮/৪/২৪ তারিখে জেলহাজতে ছিলেন তখন তার স্ত্রী পান্না জাল-জালিয়াতি পূর্বক ব্যাগডেটে ১২/৪/২৩ তারিখে বসিয়ে ‘আখের রস তৈরির মেশিন’ বিক্রয় চুক্তিপত্র তৈরী করেছেন।তার বিরুদ্ধে পান্না একাধিক মিথ্যা মামলা দিয়েছেন।তালাক দিয়েছে এবং দেন মোহর পরিশোধ করেছি।বিস্তারিত তথ্য জানতে চাইলে সুমন কাগজপত্র দেখে জানানোর কথা বললেও পরে জানাননি।চার দিন পর সুমনের ব্যবহৃত মুঠোফোনে কল দিলেও রিসিভ করেননি।
পান্না বলছেন,আখের রস তৈরির মেশিন’ বিক্রয় চুক্তিপত্রের সময় জেলহাজতে ছিল না।সুমন তার পরিচিত মুহুরি দিয়েই ‘আখের রস তৈরির মেশিন’ বিক্রয় চুক্তিপত্র করিয়েছিল। তার তিন সন্তান আছে তা জেনেও সুমন তাকে বিয়ে করেছিল।সুমন এখন তার প্রথম স্ত্রী শারমিনের বুদ্ধিতে সব উল্টাপাল্টা করছে। তার বাবা মারা যাবার পরও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে ভাতা পান ভাই-বোনেরা।সেই টাকার এক অংশ তিনিও পায়।সেই অর্থও স্বামীর সংসারে ব্যয় করে আসছেন বলে জানান পান্না।ঠিকানা তিনটি কেন প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নে পান্না বেগম বলেন,খুলনা হল বাবার বাড়ি,বাকেরগঞ্জ ছিল প্রথম স্বামীর বাড়ি এবং সেখানে বসেই করা হয়েছিল তার জাতীয় পরিচয়পত্র।আর বরিশালে স্বামী সুমনকে নিয়ে ভাড়া থাকি।
পান্না ও সুমনের বিয়ের নোটারী এবং ‘আখের রস তৈরির মেশিন’ ‘বিক্রয় চুক্তিপত্র’ এর নোটারী দুইটিরই সনাক্তকারী আইনজীবী হলেন রাশিদা আক্তার চম্পা।তিনি বলেন,২টি নোটারীর স্বাক্ষর তার এটা সত্য।তবে কোর্টে কাজ করা যে মুহুরীর মাধ্যমে এটি করতে নিয়ে এসেছিল সেই মুহুরী ভালো বলতে পারবে।কেননা প্রায় প্রতিদিনই নোটারী কখন কে করেছে তা পুরোপুরি মনে রাখা মুসকিল।নোটারী ২টিসহ মামলার কাগজপত্র পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়,অন্য স্থানের স্বাক্ষরের মত আখের রস ভাঙ্গানো মেশিন ‘বিক্রয় চুক্তিপত্র’ তে সুমনের হুবাহুব মিল স্বাক্ষর রয়েছে।
‘আখের রস তৈরির মেশিন’ বিক্রয় চুক্তিপত্রে সাক্ষী রয়েছে ২ জন। এরমধ্যে মিরাজ হল পান্নার প্রথম সংসারের ছেলে। অপরজন প্রতিবেশি বেল্লাল।
মিরাজ বলেন,তার মায়ের সাথে সকল বিষয় নিয়েই প্রতারণা করা হয়েছে।
বেল্লাল বলেন,স্বামী-স্ত্রীর ‘আখের রস তৈরির মেশিন’ বিক্রয় চুক্তিপত্রটি সত্য।তাদের মধ্যে টাকা লেনদেন হয়েছে শুনেছি। তাছাড়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে এ নিয়ে পরে সমস্যা হবে তা বুঝতে পারেননি তিনি।সে জন্য সে সময় গুরুত্বপূর্ণভাবে বিষয়টি ভাবিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের ১৯ জুন বরিশাল সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রট আদালতে নোটারী পাবলিক (নং-১৮৯৬) এর মাধ্যমে সুমন দেড় লাখ টাকা দেন মোহর ধার্য্য করে পান্নাকে বিয়ে করেন।পরদিন অর্থাৎ ২০ জুন সুমন ও পান্না নগরীর ১০ নং ওয়ার্ড কাজী মুহাম্মদ সাইদুর রহমান কাসেমীর কাছে গিয়ে ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী বিয়ে করেন। নিকাহনামার ফরমে উল্লেখ রয়েছে,বর্তমানে সুমনের স্ত্রী নেই এবং পান্না বিধবা।প্রথম বিয়ের তথ্য গোপন রেখে সুমন ২য় বিবাহ করে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অমান্য করেছেন।সুমন তা তার দায়েরকৃত মামলায় প্রথম স্ত্রীকে ৫নং সাক্ষী রেখে প্রমাণিত করেছেন।পান্নার প্রথম সংসারে ২ ছেলে ও ১ মেয়ে আছে তা জেনেশুনে সুমন ওই সন্তানসহ ২য় স্ত্রী পান্না কে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন।সুমন তার নিজের সুগারকেইন নিয়ে রুপাতলী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকায় ভাসমানভাবে ইক্ষুর রস বিক্রি করতেন এবং নগরীর ২৫ নং ওয়ার্ডের তুলাতুলির আহম্মেদ মোল্লা সড়কে স্বামী-স্ত্রীসহ ওই সন্তানদের নিয়ে একত্রে বসবাস করতেন।বিয়ের দুই সপ্তাহ পর পান্না জানতে পারে,সুমন গাঁজা ও ইয়াবা সেবনকারী এবং খুচরা মাদক বিক্রেতা এবং তার স্ত্রী ও সন্তান আছে।পৃথক বিষয় নিয়ে শুরু হয় সংসারে অশান্তি।নির্যাতনের শিকার হয় পান্না।
২০২২ সালের ৩ আগষ্ট পান্না বেগম বাদী হয়ে বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানায় স্বামী সুমনকে আসামী করে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একটি মামলা (নং-৬) দায়ের করেন। যার জি.আর নং-৫৯৯/২২ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা নং- ১৬৯/২৩।এ মামলায় জেলহাজতে যায় সুমন। জেল থেকে বেড়িয়ে সুমন ও তার স্ত্রী পান্না একত্রে সংসার শুরু করলেও ওদিকে মামলা চলমান থাকে।মামলা উঠাতে বললে পান্না অবস্থা বুঝে উঠাবেন বলে স্বামীকে বলেন।হঠাৎ সুমন তার সুগারকেইন বিক্রি করার সিন্ধান্ত নেয়।সুগারকেইন কেনার জন্য পান্না তার বাবার বাড়ি থেকে পৌনে দুই লাখ টাকা নিয়ে আসে।২০২৩ সালের ১২ এপ্রিল সুগারকেইন বিক্রয় চুক্তিপত্র নোটারী (নং- ৬২০) করে স্বামীকে টাকা দেয়। মালিকানা পরিবর্তন হলেও আবারো পূর্বের ন্যায় ব্যবসায় শুরু করেন সুমন।হঠাৎ ৯/১০ মাস পর জরুরীভাবে ব্যবসার জন্য সুমন স্ত্রীর কাছে ৫০ হাজার চায়।উপায়ন্ত না পেয়ে পান্না ২০২৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বরিশাল সরকারী সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ সংলগ্ন চৌমাথা সংলগ্ন ‘শক্তি ফাউন্ডেশন’ নামক এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা লোন উঠিয়ে স্বামীকে দেয়।মামলা চলমান থাকলেও সংসারে স্বামী-স্ত্রী মিলের মধ্যে হঠাৎ সুমনের পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজন পান্নাকে মামলা উঠানোর অনুরোধ করেন।
২০২৪ সালের ১৪ মার্চ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে চলমান মামলার অনুকূলে বাদী পান্না ও আসামী সুমনের মধ্যে মিল-মীমাংসার হয়েছে তা উল্লেখ করে আপোষনামা দিলে বিচারক মামলাটি নিষ্পত্তি করে দেন। এরপর থেকেই যৌতুকের দাবীতে অটল থাকে সুমন।পান্নার শিশু অপহরণ করে কৌশলে ওই মামলায় আপোষনামা দিতে বাধ্য করে সুমন।
এরপূর্বে ২০২৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সকালে প্রতিদেনের ন্যায় সুমনের ব্যবসায় (আখের রস বের করার মেশিন) সহযোগিতা করতে যায় পান্নার প্রথম সংসারের সাড়ে ১০ বছরেরে ছেলে মাহফুজ।ঘন্টা কয়েক পরে মাহফুজের বড় ভাই মিরাজ হাওলাদার (১৪) গিয়ে ভাইকে না পেয়ে প্রশ্ন তুললে সুমন তাকে জানায় বাসস্ট্যান্ডে ঘুরতে গেছে।এলাকাসহ আত্মীয়-স্বজনদের কাছে খোঁজাখুঁজির পর না পেয়ে ২০২৪ সালের ২১ এপ্রিল বরিশাল কোতয়ালী মডেল থানায় একটি সাধারণ ডাইরী দায়ের করেন।এরপর পান্না বাদী হয়ে সুমনসহ ৬ জনকে আসামী করে ২০২৪ সালের ১১ জুন বরিশাল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে শিশু অপহরণের অভিযোগে একটি মামলা (নং-২১১) দায়ের করেন।এরপরই রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যাওয়া মাহফুজকে ঢাকা থেকে নিয়ে আসে সুমন।বর্তমানে মাহফুজ তার মার কাছে রয়েছেন। মাহফুজ জানান,তাকে তার ২য় বাবা সহ কয়েকজন লোক মিলে ঢাকা নিয়ে গিয়েছিল।পুরো ঘটনা শুনতে চাইলে কেঁদে দেয় মাহফুজ।
২০২৪ সালের ১৭ এপ্রিল পান্না বাদী হয়ে তার স্বামী সহ স্বামীর প্রথম স্ত্রী শারমিন কে আসামী করে বরিশাল অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে যৌতুকের অভিযোগ এনে একটি মামলা (সি.আর নং-৬২৭) দায়ের করেন।প্রায় ১ মাস পর অর্থাৎ ২০২৪ সালের ১৫ মে সুমন বাদী হয়ে ওই ‘সুগারকেইন’ বা ‘আখের রস বের করার মেশিন’ নিজের বলে দাবী করে স্ত্রী পান্নাকে আসামী করে বরিশাল অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রট আমলী আদালতে একটি মামলা (সি.আর নং- ৮৪২) দায়ের করেন।দায়েরকৃত এ মামলায় সুমন নিজেই তার প্রথম স্ত্রী শারমিন কে ৫নং স্বাক্ষী রেখেছেন।আদালতে সুমন জবানবন্দি দিয়েছেন আসামী পান্না ব্যাগডেটের ১২/০৪/২০২৩ তারিখ বসিয়ে একটি জাল চুক্তিপত্র থানায় জমা দিয়ে আখের রস ভাঙ্গানো মেশিন নেয়ার চেষ্টা করছে।যা তিনি গত ০৯/০৫/২০২৪ তারিখ থানায় গিয়ে জানতে ও শুনতে পান।মামলার বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে, ২০২২ সালের ৭ জুন সুমন তালাক দিয়েছে স্ত্রী পান্নাকে।এবং দেন মোহর পরিশোধ করেছেন।অপরদিকে পান্না বলছে আরো সংসার একত্রে করেছে,যা ভাড়াটিয়া বাসার আশেপাশের মানুষরা সবাই দেখছেন।

















