প্রতিনিধি ১১ মার্চ ২০২৩ , ১:২২:৪২ প্রিন্ট সংস্করণ
মাজহারুল ইসলাম।।ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না।এখানে ফেরেশতা আসলেও টাকা দিতে হবে।’সাব-রেজিস্ট্রার অফিস ভবনের ইটেও টাকা চায়।যাঁরা আসেন তাঁরা মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েই আসেন।ক্ষোভের সঙ্গে এসব কথা বলছিলেন সাভার সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে সেবা নিতে আসা আশরাফুল হায়দার খন্দকার।তিনি জানান,তাঁর শ্বশুর মঞ্জুরুল ইসলাম তিন মেয়ের নামে বিরুলিয়া এলাকার সাড়ে চার কাঠা জমি লিখে দেবেন।নিষ্কণ্টক জমি,তারপরও সাব-রেজিস্ট্রারের জন্য আলাদা করে ৫ হাজার টাকা ঘুষ চেয়েছেন সাইদুল নামের একজন।

বৃহস্পতিবার দুপুরে সাভার সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়,জমির ক্রেতা-বিক্রেতা,দলিল লেখক আর দালালের প্রচণ্ড ভিড় ভেতরে।সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দালালেরা নির্দিষ্ট কমিশনের ভিত্তিতে সহজেই জমি নিবন্ধনের কাজ করিয়ে দেন।কাগজপত্রে সমস্যা থাকলেও ঠিকমতো যাচাই করা হয় না।আর দালাল ছাড়া গেলে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়।এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে সাভারের সাব-রেজিস্ট্রার মাইকেল মহিউদ্দীন আব্দুল্লাহ পরিচয় জানার পর কিছু বলতে রাজি হননি।
ঢাকার পাশের কেরানীগঞ্জ,রূপগঞ্জসহ দেশের বেশ কিছু সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে খোঁজ নিয়েও একই চিত্র পাওয়া গেছে। অনেক সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে জাল দলিল তৈরির চক্রও সক্রিয়।
দেশে ভূমি হস্তান্তর দলিল নিবন্ধন হচ্ছে ১৯০৮ সালের রেজিস্ট্রেশন আইনে।এ আইন অনুযায়ী ভূমি নিবন্ধনের দায়িত্ব সাব-রেজিস্ট্রারের।সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়-গুলো দেখভাল করে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা নিবন্ধন অধিদপ্তর।
সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে কিছু অনিয়ম হয় বলে স্বীকার করলেও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মনে করেন না যে দেশে ব্যাপক অনিয়ম হয়।তিনি বলেন,আমার মনে হয় না সারা দেশে অনেক অনিয়ম হয়,তাহলে আমি জানতাম।যদি এমন কিছু হয়,অবশ্যই আইনি পদক্ষেপ নেব।তবে কিছু কিছু অনিয়ম বন্ধের চেষ্টাও আমরা করছি।’
অন্যদিকে নিবন্ধন অধিদপ্তরের ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা মো. জিয়াউল হক বলেন, ‘সাব-রেজিস্ট্রারদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসে।তবে তদন্তে কিছু পাওয়া যায় না।আগের চেয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন। জিয়াউল হক বলেন,নৈতিকতার বিষয়ে এখন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।’
ঘুষ আদায়ের অলিখিত নিয়ম:-দেশের অধিকাংশ সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে ঘুষ আদায়ের নিজস্ব কিছু নিয়মও বানানো হয়েছে।যেমন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে অলিখিত নিয়ম রয়েছে,ভূমি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে সরকারি ফির বাইরেও জমির মূল্যের দশমিক ৫ শতাংশ অর্থ দিতে হবে সাব-রেজিস্ট্রারের জন্য।অর্থাৎ জমির মূল্য ১ কোটি টাকা হলে ৫০ হাজার টাকা সাব-রেজিস্ট্রারের জন্য আলাদা দিতে হবে।দলিল লেখকদের কাছ থেকে ওই টাকা আদায়ের জন্য আবু ও কমল নামে দুজনকে নির্ধারিত করে দিয়েছেন সাব-রেজিস্ট্রার।ওই দুজন সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মী নন। কিন্তু প্রতিদিন অফিস সময়ে তাঁরা টেবিল পেতে বসেন কমিশন আদায় করতে।তবে সাব-রেজিস্ট্রার মো. শাহাজাহান আলী কমিশন আদায়ের কথা অস্বীকার করেন।তিনি বলেন, ‘আবু ও কমলকে আমি চিনি না।তবে তাঁদের কথা শুনেছি। জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁদের বিষয়ে যাচাই করতে যাইনি।’
‘
এ ছাড়া দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের আওতাধীন তেঘরিয়া,বেয়ারা,পশ্চিমদী,পূর্বদী ও বাক্তা মৌজার কয়েক শ দাগের জমি নিবন্ধন বন্ধ রাখা হয়েছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে।ভুক্তভোগীদের দাবি,এসব মৌজায় প্রভাবশালী এক নেতার হাউজিং প্রকল্প থাকায় ভূমি নিবন্ধন করা হচ্ছে না।এর জন্য সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।নিবন্ধন বন্ধ রাখার বিষয়ে সাব-রেজিস্ট্রারের দাবি, উল্লিখিত মৌজাগুলো থেকে খুব কমসংখ্যক দলিল রেজিস্ট্রি হয়।
অভিযোগ আছে,রংপুরের বদরগঞ্জের সাব-রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান কাজীকে ১ হাজার ২০০ টাকা ঘুষ না দিলে দলিল নিবন্ধন হয় না।দলিল লেখকদের কাছ থেকে ঘুষের টাকা তোলার জন্য তিনি দায়িত্ব দিয়েছেন নকলনবিশ আনোয়ার হোসেনকে।দলিল লেখকদের কাছে গিয়ে আনোয়ারের টাকা আদায় করার একটি ভিডিও হাতে এসেছে।বদরগঞ্জের সাব-রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান কাজী অবশ্য ঘুষ নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন।
‘
ঘুষের বিনিময়ে রাজস্ব ফাঁকি:-পাবনা,বরগুনা,ঝিনাইদহ, পটুয়াখালী, পঞ্চগড় এলাকার সাব-রেজিস্ট্রার অফিসগুলোতেও জমি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ঘুষ আদায়ের পাশাপাশি রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ আছে।জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে এবং বাজারমূল্য কম দেখিয়ে দলিল নিবন্ধন করে সরকারকে রাজস্ব বঞ্চিত করার অভিযোগ ওই সাব-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে।জমির প্রকৃত দামের চেয়ে কম দাম দেখিয়ে নিবন্ধন করায় নিবন্ধন ফি কম দিতে হয়।এ ক্ষেত্রে সরকার যথাযথ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়।
নিবন্ধন অধিদপ্তরের তথ্যমতে,প্রতিবছর গড়ে ৩৫ লাখের বেশি দলিল নিবন্ধন হয়।এতে রাজস্ব আয় হয় বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
দলিল নিবন্ধনে ঘুষ বাবদ আদায় করা অর্থ ভাগ করে নেন সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী,দলিল লেখক ও সংশ্লিষ্ট দালালেরা।অভিযোগ আছে,কুমিল্লা সদর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে দলিল লেখকেরাই দলিল করার সময় অফিস খরচের অজুহাতে বাড়তি টাকা নেন।জানা যায়,সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের নিয়ন্ত্রণ অফিস সহকারী খোশনেহার বেগমের হাতে।ঘুষের ২৫ শতাংশই নেন তিনি।৫০ শতাংশ দেন সাব-রেজিস্ট্রারকে,বাকি ২৫ শতাংশ ভাগাভাগি হয় অন্যদের মধ্যে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদর উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার মো. হানিফ ব্যস্ততার কথা বলে ফোনের সংযোগ কেটে দেন।
দলিল লেখকদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ:-জমির দলিল নিবন্ধনের ক্ষেত্রে দলিল লেখকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।দেশের ৫০১টি সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে প্রায় ৯৮ হাজার নিবন্ধিত দলিল লেখক আছেন।তাঁরা জমির ক্রেতা-বিক্রেতার চাহিদা অনুসারে দলিল লেখেন।এর জন্য নির্ধারিত হারে পারিশ্রমিক নেওয়ার কথা।১৯৯৪ সালে আইন মন্ত্রণালয় থেকে দলিল লেখকদের পারিশ্রমিকের হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
কিন্তু দলিল লেখকেরা সে নির্দেশনা উপেক্ষা করে সেবাগ্রহীতাদের থেকে ইচ্ছেমতো টাকা নেন।না দিলে নানাভাবে হয়রানি করেন।অনেক সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের নিয়ন্ত্রকও দলিল লেখকেরাই।নোয়াখালী সদর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের এজলাসে সাব-রেজিস্ট্রারের পাশে দাঁড়িয়ে নিবন্ধন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করেন দলিল লেখক সমিতির নেতারা।জমির শ্রেণিসহ কাগজে গরমিল থাকলেও ঘুষের বিনিময়ে দ্রুত রেজিস্ট্রির ব্যবস্থা করেন তাঁরা।একাধিক দলিল লেখক নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন,প্রতিটি সাব-কবলা দলিল রেজিস্ট্রি করতে প্রথমে সাব-রেজিস্ট্রারের জন্য ২ হাজার টাকা,বঙ্গবন্ধু দলিল লেখক সমিতির নামে ১ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হয়।প্রতি হেবা দলিলে সরকারি চার্জ ১ হাজার ৫০০ টাকা হলেও নেওয়া হয় ৭-৮ হাজার টাকা।
বেড়া উপজেলা দলিল লেখক সমিতির বিরুদ্ধে দলিলপ্রতি লাখে ১ হাজার টাকা চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ আছে। সমিতির নেতারা এই টাকা আদায় করেন।অভিযোগ রয়েছে, নাটোরের বাগাতিপাড়ায় সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে নির্ধারিত অর্থের চেয়ে দ্বিগুণ টাকা দিতে হয় দলিল লেখকদের।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাব-রেজিস্ট্রার বলেন, ‘দলিল লেখকের পারিশ্রমিকের বিষয়ে সরকারের নির্দেশনা অনেক আগের,সেটা আপডেট না করায় তাঁরা ইচ্ছেমতো টাকা নেন।’
বাড়তি টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে বাংলাদেশ দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক যোবায়ের আহমেদ বলেন, ‘দলিল লেখকেরা কাজের পারিশ্রমিক তো অবশ্যই নেবেন। কাজ অনুসারে কত টাকা পাবেন,তা নির্ধারিত নেই।খুশি হয়ে পার্টি যা দেয়।’
ডিজিটালাইজেশন করার পরামর্শ ২০১৯ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় বলা হয়,সাব-রেজিস্ট্রার অফিসগুলোতে দলিল নিবন্ধনের জন্য সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে ১ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়তি নেওয়া হয়। এর ১০-৫০ শতাংশ সাব-রেজিস্ট্রার এবং বাকি অংশ অন্যদের মধ্যে বণ্টন হয়।একটি অংশ জেলা রেজিস্ট্রার অফিস,নিবন্ধন অধিদপ্তর পর্যন্ত যাওয়ার অভিযোগ আছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘গবেষণার পরবর্তী সময়েও অবস্থার উন্নতি হয়নি।সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে অনিয়ম-দুর্নীতি অব্যাহত আছে।এসবের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না।পুরো প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজেশন করতে হবে।তাতে হয়তো দুর্নীতি অনেকটা কমে আসবে।’

















