রাজনীতি

১৭ বছর পর তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনঃআইনের শাসন,রাষ্ট্রীয় সুবিধা ও সাংবিধানিক বৈধতা—প্রশ্নের মুখে বাংলাদেশ

  প্রতিনিধি ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ , ১২:১২:৩৩ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।১৭ বছরের দীর্ঘ নির্বাসনের অবসান ঘটিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুধু আবেগ নয়—এটি আইন,সংবিধান এবং রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার এক জটিল পরীক্ষাও বটে।তাঁর প্রত্যাবর্তন যেমন বিএনপির জন্য রাজনৈতিক শক্তির পুনর্জাগরণ,তেমনি রাষ্ট্রের জন্য একাধিক অস্বস্তিকর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

গ্রেফতার থেকে নির্বাসন: আইনের শাসন নাকি রাজনৈতিক প্রতিশোধ?

২০০৭ সালের ৭ মার্চ ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাসা থেকে তারেক রহমানকে গ্রেফতার করা হয়।তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাঁর বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা দায়ের হয়,যা পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বেড়ে দাঁড়ায় ৭২টিতে।

প্রশ্ন উঠছে—

>এই বিপুল সংখ্যক মামলা কি দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের আইনগত লড়াই,নাকি বিরোধী রাজনীতি দমনের প্রাতিষ্ঠানিক অস্ত্র?

কারাবন্দি অবস্থায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও তাঁর চিকিৎসা ও জামিন প্রশ্নে রাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সীমিত—এমন অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপির।

চিকিৎসার অজুহাতে বিদেশযাত্রা: শর্তভঙ্গের দায় কার?

২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পাওয়ার রাতেই তারেক রহমান স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে লন্ডনে যান চিকিৎসার উদ্দেশ্যে।তবে প্রশ্ন থেকে যায়—

তিনি কি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দেশে ফেরার আইনি বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করেছেন?

যদি করে থাকেন,তাহলে দীর্ঘ ১৭ বছর রাষ্ট্র কেন কার্যকর কোনো প্রত্যর্পণ বা আইনি পদক্ষেপ নেয়নি?

পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হওয়ায় আদালতের দৃষ্টিতে তাকে পলাতক ঘোষণা করা হলেও, বাস্তবে রাষ্ট্র কখনোই তাঁকে দেশে ফেরাতে দৃশ্যমান উদ্যোগ নেয়নি।

বিএনপি ধ্বংসের এক দশক: রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা

তারেক রহমানের অনুপস্থিতির সময়েই বিএনপি পড়ে যায় চরম সংকটে—

২০১০ সালে ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে খালেদা জিয়ার উৎখাত

২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন ও বিএনপির বর্জন

২০১৫ সালে আরাফাত রহমান কোকোর রহস্যময় মৃত্যু

লাগাতার গ্রেফতার,গুম ও মামলার রাজনীতি

এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠে—

> একটি প্রধান বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করে রাখা কি সংবিধানের বহুদলীয় গণতন্ত্রের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?

রাষ্ট্রপতির খালাস: ক্ষমতার সীমা লঙ্ঘন?

গত বছরের গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে খালেদা জিয়ার সাজা মুকুব এবং রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে তারেক রহমানের একাধিক মামলায় খালাস আসে।

এখানেই সবচেয়ে গুরুতর সাংবিধানিক প্রশ্নগুলো সামনে আনা

❓ রাষ্ট্রপতি কি বিচারাধীন বা সাজাপ্রাপ্ত মামলায় নির্বাহী ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করতে পারেন?

❓ সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দয়া প্রদর্শন কি রাজনৈতিক পুনর্বাসনের হাতিয়ার হতে পারে?

❓ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কি এখানে প্রশ্নবিদ্ধ নয়?

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে,সাজা মওকুফ আর বিচারিক খালাস এক নয়—এই দুইয়ের সীমারেখা মুছে গেলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য ভেঙে পড়ে।

২৫ ডিসেম্বরের প্রত্যাবর্তন: সমতা নাকি বিশেষ সুবিধা?

২৫ ডিসেম্বর তারেক রহমানের দেশে ফেরা ঘটে এমন এক সময়ে,যখন বহু সাধারণ নাগরিক বছরের পর বছর বিদেশে আটকে থেকেও মামলা নিষ্পত্তি বা পাসপোর্ট জটিলতায় দেশে ফিরতে পারেন না।

প্রশ্ন তাই অনিবার্য—

> তারেক রহমান কি সাধারণ নাগরিক হিসেবে দেশে ফিরেছেন,নাকি রাষ্ট্রীয় বিশেষ সুবিধার ছত্রচ্ছায়ায়?

যদি তিনি নির্দোষ হন,তবে ১৭ বছর কেন লাগলো?
আর যদি অপরাধী না হন,তবে এত বছর মামলা ঝুলে থাকার দায় কার?

উপসংহার: ব্যক্তি নয়,রাষ্ট্র কাঠগড়ায়

তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন বিএনপির জন্য রাজনৈতিক অর্জন হতে পারে।কিন্তু রাষ্ট্রের জন্য এটি এক ভয়ংকর নজি

আইনের শাসন কি ক্ষমতার সঙ্গে বদলায়?

সংবিধান কি ব্যক্তি অনুযায়ী প্রয়োগ হয়?

বিচার কি শেষ পর্যন্ত ন্যায়,না রাজনৈতিক সমঝোতা?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না দিলে,ইতিহাস একদিন তারেক রহমান নয়—রাষ্ট্রকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।

আরও খবর

Sponsered content