প্রতিনিধি ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ , ৩:০৫:০৯ প্রিন্ট সংস্করণ
মাজহারুল ইসলাম।।বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ কখনোই নিছক আবেগঘন ঘটনা ছিল না।এটি বরাবরই ক্ষমতার ভারসাম্য,রাষ্ট্রের দিকনির্দেশনা এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য এক একটি রাজনৈতিক টার্নিং পয়েন্ট।সময় বদলেছে,প্রজন্ম বদলেছে;কিন্তু রাষ্ট্র যখন একমুখী প্রবাহে আটকে পড়ে, তখন কাণ্ডারির প্রত্যাবর্তন অনিবার্য হয়ে ওঠে।

১. ১০ জানুয়ারি ১৯৭২: রাষ্ট্রের জন্ম সম্পূর্ণ হয়েছিল
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যাবর্তন ছিল একটি সদ্য জন্ম নেওয়া রাষ্ট্রের নৈতিক ও রাজনৈতিক বৈধতার চূড়ান্ত সিলমোহর।যুদ্ধ জিতেছিল জনগণ,কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজন ছিল নেতৃত্বের প্রত্যাবর্তন।সেদিন একটি স্বাধীন দেশের শারীরিক অস্তিত্বের সঙ্গে তার রাজনৈতিক আত্মাও ফিরে এসেছিল।এই প্রত্যাবর্তন না হলে স্বাধীনতার কাঠামো অপূর্ণই থেকে যেত।
২. ১৭ মে ১৯৮১: উত্তরাধিকার ও প্রতিরোধের রাজনীতি
শেখ হাসিনার দেশে ফেরা ছিল কেবল পারিবারিক উত্তরাধিকারের প্রশ্ন নয়; এটি ছিল রাজনৈতিক প্রতিরোধের পুনর্গঠন।সামরিক শাসন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে এই প্রত্যাবর্তন আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্যতার অচলাবস্থা থেকে বের করে আনে।ইতিহাস প্রমাণ করে—ব্যক্তির প্রত্যাবর্তন কখনো কখনো একটি দলের অস্তিত্ব রক্ষার শর্ত হয়ে দাঁড়ায়।
৩. ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫: তারেক রহমান—ফেরা মানে কী?
তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে তাই শুধুই আবেগ দিয়ে ব্যাখ্যা করলে ভুল হবে।এটি আসলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও গণতান্ত্রিক ভারসাম্য পুনর্গঠনের একটি অধ্যায়।
এই প্রত্যাবর্তন গুরুত্বপূর্ণ কেন?
কারণ,দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি কার্যত একপাক্ষিক আধিপত্যের অভিযোগ,দুর্বল বিরোধী রাজনীতি ও আস্থার সংকটে ভুগছে।গণতন্ত্র কেবল নির্বাচন দিয়ে টিকে থাকে না; টিকে থাকে শক্তিশালী বিরোধী শক্তি,কার্যকর সংসদ ও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে।একটি বড় রাজনৈতিক শক্তি দীর্ঘদিন মাঠের বাইরে থাকলে রাষ্ট্রব্যবস্থাও একধরনের আত্মতুষ্টিতে ভোগে—যার ফল ভোগ করে সাধারণ জনগণ।
কঠিন বাস্তবতা ও ঝুঁকি
তবে এটাও সত্য,তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন নির্বিঘ্ন আশাবাদের গল্প নয়।
তাঁর অতীত রাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ ছিল,
শাসনামলের দুর্নীতির অভিযোগ ইতিহাসে নথিভুক্ত,
এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা পুনর্গঠন এখন তাঁর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এই প্রত্যাবর্তন যদি কেবল প্রতিশোধের রাজনীতি,পুরনো মুখ ও পুরনো কৌশলের পুনরাবৃত্তি হয়,তবে এটি গণতন্ত্রের জন্য নতুন আশার বদলে নতুন অস্থিরতা তৈরি করবে।
সুযোগ কোথায়?
সুযোগ এখানেই—
তারেক রহমান চাইলে এই প্রত্যাবর্তনকে ব্যবহার করতে পারেন একটি রাজনৈতিক রিসেট হিসেবে।
ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির বদলে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি,
দুর্নীতির অভিযোগ মোকাবিলায় স্বচ্ছতা,
সহিংস রাজনীতির বদলে গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা,
এবং সর্বোপরি জনগণের সামনে একটি ভবিষ্যতমুখী
রাজনৈতিক এজেন্ডা উপস্থাপন—
এসবই নির্ধারণ করবে এই প্রত্যাবর্তন ইতিহাসে কীভাবে লেখা হবে।
ইতিহাস ক্ষমা করে না
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রত্যাবর্তনগুলো কাউকে চিরস্থায়ী নায়ক বানায়নি,আবার কাউকে স্বয়ংক্রিয় খলনায়কও করেনি। ইতিহাস বিচার করেছে ফেরার পর কী করা হলো,সেই প্রশ্নে।
প্রত্যাশা করি,তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ব্যক্তিগত পুনর্বাসনের গল্পে সীমাবদ্ধ না থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি কার্যকর,দায়িত্বশীল ও গণতান্ত্রিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার উপলক্ষ হবে।
কারণ,শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্র কোনো দলের একার সম্পত্তি নয়—
এটি জনগণের,এবং জনগণই ইতিহাসের চূড়ান্ত বিচারক।
















