প্রতিনিধি ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫ , ৩:১২:০৩ প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক।।আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মনোনয়নপত্র দাখিল সংক্রান্ত আইনি জটিলতা নিরসন,বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তি এবং নির্বাচনি পরিবেশ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি।সোমবার (২২ ডিসেম্বর) বিকেল ৩টায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সিইসির কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

বৈঠকে বিএনপির পক্ষে নেতৃত্ব দেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিল সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ এবং নির্বাচন কমিশনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব ড. মোহাম্মদ জকরিয়া।নির্বাচন কমিশনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন নির্বাচন কমিশনার রহমানেল মাছউদ ও ইসির সিনিয়র সচিব।
মনোনয়নপত্রে অতিরিক্ত কাগজপত্র: আরপিও বনাম বাস্তবতা
বৈঠক শেষে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন,নির্বাচন কমিশনের নিকট আরপিও (Representation of the People Order) বহির্ভূত শর্ত শিথিল করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বিশেষত,বিএনপির প্রার্থীদের মনোনয়নপত্রে জামিনের সার্টিফায়েড কপি বা অর্ডার শিট দাখিলের বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।
আইনি ভাষ্য:
আরপিও’র ১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রার্থীর ওপর কেবল ফৌজদারি মামলার তথ্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
আইন অনুযায়ী জামিনের সার্টিফায়েড কপি বা আদালতের অর্ডার শিট দাখিলের কোনো স্পষ্ট বিধান নেই।
অতিরিক্ত কাগজপত্র চাওয়া হলে তা আইনসঙ্গত কর্তৃত্বের (ultra vires) প্রশ্ন তোলে এবং সমতার নীতির পরিপন্থী হতে পারে।
বাস্তব সমস্যা: রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একাধিক—অনেক ক্ষেত্রে ‘গায়েবি’—মামলা থাকায় বিভিন্ন জেলার আদালত থেকে স্বল্প সময়ে জামিনসংক্রান্ত কাগজ সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।এতে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
‘অভিযুক্ত’ শব্দের ব্যাখ্যা: চার্জ গঠন না এফআইআর?
বিএনপি প্রতিনিধিদল ‘অভিযুক্ত’ শব্দের স্পষ্টীকরণ চেয়েছে—এটি কি কেবল চার্জ গঠিত মামলাকে বোঝাবে,নাকি এফআইআরভিত্তিক নামজারি হলেই ‘অভিযুক্ত’ ধরা হবে?
আইনি বিশ্লেষণ:
ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় চার্জ গঠন না হওয়া পর্যন্ত অভিযোগ প্রমাণিত নয়।
কেবল এফআইআরভুক্ত নামের ভিত্তিতে প্রার্থীকে অযোগ্য বা হয়রানির মুখে ফেলা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
নির্বাচন কমিশনের ব্যাখ্যামূলক নির্দেশনা (clarificatory circular) এ ক্ষেত্রে আইনি অনিশ্চয়তা কমাতে পারে।
নির্বাচনি ব্যয়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট: প্রযুক্তিগত সংশোধনীর প্রস্তাব
নির্বাচনি ব্যয় নির্বাহের জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার বিধিতে একটি বাস্তবসম্মত সংশোধনীর প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি।
প্রস্তাবের সারকথা:
সাধারণত প্রতীক বরাদ্দের পর নির্বাচনি এজেন্ট নিয়োগ করা হয়।
প্রতীক বরাদ্দের আগ পর্যন্ত প্রার্থী নিজে যাতে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন,সে জন্য বিধিতে ‘প্রার্থী অথবা নির্বাচনি এজেন্ট’ শব্দযুগল ধারাবাহিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন এ প্রস্তাব গুরুত্বসহকারে বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা ও নির্বাচনি পরিবেশ: সাংবিধানিক দায়
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন,আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মূল দায়িত্ব সরকারের হলেও নির্বাচনকালীন সময়ে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ—বিশেষত বদলি ও নিয়োগ—নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত।
আইনি দৃষ্টিভঙ্গি:
সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্বে নিয়োজিত।
কমিশনের কার্যকর তদারকি ছাড়া ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করা কঠিন।
তারেক রহমান: ৩৬টি মামলা,জামিন ও খালাসের চিত্র
বৈঠকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি গুরুত্ব পায়। দলটির ভাষ্য অনুযায়ী,তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অধিকাংশ মামলাই রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপ্রসূত।
মামলার সারসংক্ষেপ (দলীয় দাবি অনুযায়ী):
মোট মামলা: প্রায় ৩৬টি
উল্লেখযোগ্য অংশে উচ্চ আদালত থেকে জামিন ও একাধিক মামলায় খালাস/স্থগিতাদেশ রয়েছে।
বেশ কিছু মামলা ‘গায়েবি’ ও এফআইআরভিত্তিক, যেখানে তদন্ত বা চার্জ গঠন দীর্ঘদিন অনিষ্পন্ন।
আইনি অবস্থান:
ভোটার হওয়ার অধিকার একটি মৌলিক নাগরিক অধিকার।
কেবল অভিযোগ বা বিচারাধীন মামলা ভোটার তালিকাভুক্তির পথে স্বয়ংক্রিয় বাধা হতে পারে না,যদি না আদালতের চূড়ান্ত দণ্ড কার্যকর থাকে।
উপসংহার: আইনের শাসন ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন
এই বৈঠক নির্বাচনকালীন আইনি কাঠামো ও বাস্তবতার মধ্যকার ফাঁকগুলো স্পষ্ট করেছে।আরপিও’র মূল বিধান অনুসরণ,অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্রের চাপ কমানো,‘অভিযুক্ত’ শব্দের স্পষ্ট ব্যাখ্যা এবং প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা—সব মিলিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক,প্রতিযোগিতামূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশনের সক্রিয় ভূমিকা এখন সময়ের দাবি।

















