আন্তর্জাতিক

সমুদ্রপথে সোমালি জলদস্যুদের তৎপরতা আতঙ্ক

  প্রতিনিধি ২১ মার্চ ২০২৪ , ৪:৫৮:১০ প্রিন্ট সংস্করণ

অনলাইন ডেস্ক রিপোর্ট।।পশ্চিম ভারত মহাসাগরে স্পিড বুটে এক ডজনেরও বেশি সোমালি জলদস্যুরা বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহয় ওঠার আগে জাহাজের ক্রুরা একটি বিপদ সংকেত পাঠিয়েছিলেন।তারা হটলাইনে কলও করেছিলেন। তবে সময়মতো তাদের কাছে কেউ পৌঁছাতে পারেনি।জলদস্যুরা জাহাজ এমভি আবদুল্লাহয় উঠে পড়ে।নাবিকদের সতর্ক করতে ফাঁকা গুলি চালায়।জাহাজের ক্যাপ্টেন ও সেকেন্ড অফিসারকে জিম্মি করে ফেলে।

জলদস্যুরা এমভি আব্দুল্লাহর ক্রুদের ফোন জব্দ করার আগেই একটি বার্তা রেকর্ড করতে সক্ষম হয়েছিলেন জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা আতিক উল্লাহ খান।জাহাজের মালিকদের কাছে পাঠানো ওই অডিও বার্তাতে এমন বর্ণনা দেন তিনি। আতিকুল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে এখন পর্যন্ত কেউ হতাহত হয়নি।’এর এক সপ্তাহ পর এমভি আবদুল্লাহ সোমালিয়ার উপকূলে নোঙর করে।

নতুন শতকের শুরুর দিকে সমুদ্রপথে সোমালি জলদস্যুদের তৎপরতা আতঙ্ক ছড়িয়েছিল।এরপর গত এক দশকে তাদের খুব একটা তৎপরতা দেখা যায়নি সাগরপথে।তাতে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীগুলো মনে করেছিল,তারা সোমালি জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে এনেছে।কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ফের তাদের উৎপাত নিয়মিত হয়ে পড়েছে।তাদের জলদস্যুতার পুনরুত্থানের সর্বশেষ শিকার হয়েছে এই বাংলাদেশি জাহাজটি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন,লোহিত সাগরে যখন হুথিরা বাণিজ্যিক জাহাজে লাগাতার ড্রোন ও মিসাইল হামলা চালাচ্ছে,তখন সোমালি জলদস্যুদের এমন উত্থান শিপিং কোম্পানিগুলোর ঝুঁকি ও খরচ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

জাহাজ শিল্পের অন্তত পাঁচটি কোম্পানির মতে,গত বছরের নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত সোমালি জলদস্যুরা অন্তত ২০টি জাহাজে ছিনতাইয়ের জন্য অভিযান চালিয়েছিল।এই ঝুঁকির কারণে সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ এবং বিমার খরচও বেড়ে গেছে।

সোমালিয়ার জলপথে বিশ্বের ব্যস্ততম কয়েকটি জাহাজ চলাচল পথের একটি।প্রতি বছর আনুমানিক ২০ হাজার জাহাজ এই পথে চলাচল করে।এসব জাহাজ নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে জ্বালানি,পোশাকসহ প্রায় সব ধরনের পণ্য পরিবহণ করে থাকে।মূলত লোহিত সাগর ও সুয়েজ খালের দিকে যাতায়াতকারী জাহাজগুলোকে সোমালি জলপথ ধরে চলাচল করতে হয়।পথে জাহাজগুলো এডেন উপসাগর ব্যবহার করে। এটিই ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ছোট সামুদ্রিক পথ।

২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে সোমালি জলদস্যুদের হামলা মারাত্মক আকার ধারণ করে।তাদের প্রতিরোধে বিভিন্ন দেশের নৌ বাহিনীকে যৌথ উদ্যোগ নিতে হয়।সম্মিলিত অভিযানে শেষ পর্যন্ত পিছু হঠতে বাধ্য হয় জলদস্যুরা। একপর্যায়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।এখন তারা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যদিও তাদের উৎপাত এখনো ২০০৮ থেকে ২০১৪ সালে মতো মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছায়নি।

ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর তথ্যমতে,২০১১ সাল ছিল সোমালি জলদস্যুদের স্বর্ণযুগ।ওই বছর সোমালি জলদস্যুরা ২৩৭টি জাহাজে আক্রমণ করে।এতে শতাধিক মানুষ জিম্মি হয়।ওই বছর ওশানস বিয়ন্ড পাইরেসি মনিটরিং গ্রুপের অনুমান ছিল,জলদস্যুদের তৎপরতায় বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রায় সাত শ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছিল।এর মধ্যে কয়েক শ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয় কেবল জিম্মি মানুষদের মুক্তিপণ হিসেবে।

বর্তমানে জলদস্যুদের হামলার সংখ্যা বেশ কম।জলদস্যুরা ইদানিং কম টহল দেওয়া এলাকায় ছোট জাহাজগুলোকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে।গত নভেম্বর থেকে তারা সফলভাবে কমপক্ষে দুটি পণ্যবাহী জাহাজ ও ১২টি মাছ ধরার জাহাজ করায়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছে।

সোমালি এই জলদস্যুদের একটি চক্রের দুই সদস্য বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন,তারা প্রায় এক দশক ধরে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। লোহিত সাগরে হুতি হামলার কারণে নৌ বাহিনীগুলোর মনোযোগ সেদিকে সরে গেছে।জলদস্যুতায় ফিরতে এই সুযোগই নিয়েছেন তারা।গত কয়েক মাসে তারা যথেষ্টই আতঙ্ক ছড়াতে সক্ষম হয়েছেন সমুদ্রপথে।

সোমালি জলদস্যুদের অর্থায়ন করেন আলিয়াস ইসমাইল ইসা নামের এক সোমালি ব্যক্তি।গত ডিসেম্বরে তিনি একটি পণ্যবাহী জাহাজ ছিনতাইয়ের জন্য জলদস্যুদের অর্থায়ন করেছিলেন। সোমালিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল হুল আনোদ থেকে টেলিফোনে বার্তাসংস্থা রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।বলেন,লোহিত সাগরে হুতিদের হামলার কারণে সাগরের এই এলাকায় টহল কমিয়েছে নৌ বাহিনীগুলো। এই সুযোগ নিয়েছে তারা (জলদস্যু)।

জলদস্যুদের এই উৎপাতদ খোদ সোমালিয়াকেও ভাবাচ্ছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট হাসান শেখ মোহাম্মদ গত মাসে রয়টার্সকে বলেছিলেন,নতুন করে জলদস্যুদের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার প্রচেষ্টাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা না গেলে তারা আবার আগের মতো আতঙ্কজনক হয়ে উঠতে পারে।

বাংলাদেশের এমভি আব্দুল্লাহর মতো গত সপ্তাহেই জলদস্যুদের হামলার শিকার হয় মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি রুয়েন। ভারতীয় নৌ বাহিনী ওই জাহাজকে জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত করে। ভারতীয় নৌ বাহিনী জানিয়েছে,এমভি রুয়েনে থাকা ৩৫ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছে এবং ১৭ জিম্মিকে উদ্ধার করা হয়েছে।বর্তমানে জাহাজটি আবার সমুদ্রে ফিরেছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলদস্যুবিরোধী মিশন আটলান্টা বলেছে,জলদস্যুরা বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লায় আক্রমণের জন্য সম্ভবত এমভি রুয়েনকে লঞ্চপ্যাড হিসেবে ব্যবহার করেছিল।

ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের অপরাধবিরোধী শাখার উপপরিচালক সাইরাস মোডি বলেন,এই অঞ্চলে ভারতীয় নৌ বাহিনী অন্তত এক ডজন যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে।এই পদক্ষেপ জলদস্যুদের তৎপরতায় বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠতে পারে।এর ফলে জলদস্যুরা দেখবে লাভের চেয়ে ঝুঁকি বেশি। তখন হয়তো কোনো জাহাজ ছিনতাইয়ের উদ্যোগ নেওয়ার আগে কয়েকবার চিন্তা করতে বাধ্য হবে।

তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সকে বলেন,এমভি আবদুল্লাহ উদ্ধারে কোনো ধরনের সামরিক পদক্ষেপের পক্ষপাতী নয় ঢাকা।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলদস্যু প্রতিরোধ মিশন গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এডেন উপসাগর ও সোমালি বেসিনে সক্রিয় পাঁচটি জলদস্যু গ্রুপকে চিহ্নিত করেছে।ইউরোপীয় মিশনের মতে, বর্ষা মৌসুমের শেষের দিকে জলদস্যুরা আরও পূর্ব ও দক্ষিণের দিকে সরে যেতে পারে।

বর্তমানে জলদস্যুরা সমুদ্রের পশ্চিম ও উত্তরের দিকে অনেক বেশি বিস্তৃত এলাকাজুড়ে সক্রিয়।তারা এমন এলাকায় হামলা চালাচ্ছে যেখানে এরই মধ্যে যুদ্ধঝুঁকির জন্য জাহাজগুলোকে বিমার জন্য বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। জলদস্যুদের হুমকির জন্য এডেন উপসাগর ও লোহিত সাগরে চলাচলকারী জাহাজগুলোর বিমার খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাচ্ছে।

জাহাজগুলোতে বেসরকারি সশস্ত্র রক্ষীদের ক্রমবর্ধমান চাহিদাও খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।মেরিটাইম সিকিউরিটি সূত্র জানায়,তিন দিনের জন্য একটি সশস্ত্র রক্ষীদল নিয়োগের খরচ ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় মার্চে বেড়ে প্রায় দেড় গুণ হয়ে গেছে।এ রকম একটি দল ভাড়া করতে খরচ হয় সাধারণত চার থেকে ১৫ হাজার মার্কিন ডলার।সশস্ত্র এসব রক্ষীরা হুতিদের মিসাইল ও ড্রোনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে না পারলেও সোমালি জলদস্যুদের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম।

এদিকে মাল্টার জাহাজ এমভি রুয়েন ছিনতাইয়ের পর জলদস্যুরা কোনো মুক্তিপণ দাবি করেছিল কি না,তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।তবে জলদস্যুদের অর্থায়নকারী ইসা ও এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, রুয়েনকে মুক্তি দেওয়ার জন্য কয়েক মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণের বিষয়ে একটি আলোচনা হয়েছিল।

জাহাজটি পরিচালনাকারী বুলগেরিয়ান কোম্পানি নাভিবুলগারের একজন মুখপাকেত্রর সঙ্গে কথা হয় রয়টার্সের।তিনি মুক্তিপণ নিয়ে আলোচনার বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।শুধু জাহাজটি উদ্ধারের জন্য ভারতীয় নৌ বাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

এদিকে এমভি আবদুল্লাহর মালিক এসআর শিপিংয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন,জলদস্যুরা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছিল।কিন্তু কোম্পানি কোনো মুক্তিপণের কথা তাদের বলা হয়নি।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন,হুতি ও সোমালি জলদস্যুদের মধ্যে সরাসরি কোনো সম্পর্কের প্রমাণ নেই।যদিও জলদস্যুদের অর্থায়নকারী ইসা বলেছেন,জলদস্যুরা হুতি মিলিশিয়াদের সাম্প্রতিক আক্রমণের সূত্র ধরেই অনুপ্রাণিত হয়েছে।

এক দশক আগে সোমালি জলদস্যুদের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় শিপিং কোম্পানিগুলো জাহাজে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছিল।আন্তর্জাতিক নৌ বাহিনী,ন্যাটো,ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে জলদস্যুবিরোধী অভিযান চালানো হয়।

ওই সময় ১৪টি দেশের অন্তত ২০টি যুদ্ধজাহাজ এডেন উপসাগর ও ভারত মহাসাগরের জাহাজ চলাচল রুটে নিয়মিত টহল দেয়।এই এলাকাটি ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের জাহাজ চলাচলকারী রুটের মোট আয়তনের চেয়েও বিস্তৃত।

সোমালিয়ায় জাতিসংঘের রাজনৈতিক কার্যালয়ের কাউন্টার-পাইরেসি ইউনিটের সাবেক প্রধান জন স্টিড বলেন,এ পদক্ষেপগুলোর কারণে জলদস্যুরা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।তাদের হামলার সংখ্যা শূন্যে নেমে আসে।কিন্তু হুমকি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জলদস্যুবিরোধী অভিযানে থাকা অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা কমে যায়।

স্টিড জানান,২০২২ সালে জাতিসংঘের একটি প্রস্তাবে বিদেশি জাহাজগুলোকে সোমালি জলসীমায় টহল দেওয়ার কথা বলা হয়।কিন্তু সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট মোহামুদ বলেছিলেন, জলদস্যুদের হুমকি মোকাবিলায় বিদেশি জাহাজ পাঠানো কোনো কার্যকর সমাধান নয়।বরং সোমালিয়ার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করলে এই হুমকি মোকাবিলা করা সম্ভব।

সোমালিয়া সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী,সেদেশের কোস্ট গার্ডে ৭২০ জন প্রশিক্ষিত সদস্য রয়েছেন।তবে তাদের ব্যবহারের জন্য মাত্র চারটি ছোট জাহাজ রয়েছে, যার মধ্যে আবার তিনটিই নষ্ট।

আরও খবর

Sponsered content