বিনোদন

সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন মারা গেছে

  প্রতিনিধি ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ , ৬:৩৩:১৮ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।চলে গেলেন লোকসংগীতের বরেণ্য শিল্পী ফরিদা পারভীন। শনিবার রাত ১০টা ১৫ মিনিটে তিনি মারা গেছেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।খবরটি নিশ্চিত করেছেন ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশীষ কুমার চক্রবর্তী।তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১। তিনি স্বামী এবং চার সন্তান রেখে গেছেন।

দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন ফরিদা পারভীন। কিছুদিন ধরে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছিল,সপ্তাহে দুই দিন তাঁকে ডায়ালাইসিস করাতে হয়।নিয়মিত ডায়ালাইসিসের অংশ হিসেবে ২ সেপ্টেম্বর মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু ডায়ালাইসিসের পর তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তখন চিকিৎসক তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরামর্শ দেন।এর পর থেকে তিনি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন।গত বুধবার অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।অবশেষে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে তিনি চলে যান না–ফেরার দেশে।

১৯৫৪ সালে ৩১ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়া থানায় জন্ম নেওয়া ফরিদা পারভীন গানে গানে কাটিয়েছেন ৫৫ বছর। ১৪ বছর বয়সে ১৯৬৮ সালে ফরিদা পারভীনের পেশাদার সংগীতজীবন শুরু হয়।এরপর পার হতে হয় অনেক চড়াই-উতরাই। পারিবারিক সূত্রেই গানের ভুবনে আসা।গানের প্রতি বাবার টান ছিল বেশি। দাদিও গান করতেন। বাবার চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় যেতে হয়েছে তাঁকে।

শৈশবে যখন মাগুরায় ছিলেন,তখন ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে সংগীতের হাতেখড়ি হয়।এরপর নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তালিম থেকে দূরে থাকেননি।নানা ধরনের গান করলেও শিল্পীজীবনে পরিচিতি,জনপ্রিয়তা,অগণিত মানুষের ভালোবাসা মূলত লালন সাঁইয়ের গান গেয়ে।যখন থেকে লালনের গান গাওয়া শুরু হয়েছিল,তারপর আর থেমে থাকেননি।

শুরুতে নজরুলসংগীত,পরে আধুনিক গান দিয়ে ফরিদা পারভীনের যাত্রা শুরু হলেও জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে লালন সাঁইয়ের গান গেয়ে।এ প্রসঙ্গে ফরিদা পারভীন বলেছিলেন,‘নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে এটা ঘটে।কুষ্টিয়ায় স্থানীয় এক হোমিও চিকিৎসক আমার গানের বেশ মুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন।কিন্তু কেন জানি,তিনি আমার কণ্ঠে লালনগীতি শুনতে চাইতেন।তাঁর মনে হতো, লালনের গান আমার কণ্ঠে বেশি ভালো লাগবে।তাই হঠাৎ করেই আমাকে একদিন লালন ফকিরের গান শেখার পরামর্শ দেন।কিন্তু শুরুতে লালনের গান গাইতে চাইনি।আমার এই অনীহা দেখে বাবা আমাকে অনেক বুঝিয়ে গান শেখার জন্য রাজি করান।বলেন, “ভালো না লাগলে গাইবি না।” এই শর্তে রাজি হই এবং লালনসংগীতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে তালিম নেওয়া শুরু করি।“সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন”, লালনের বিখ্যাত গানটি শিখি।একই বছর দোলপূর্ণিমা উৎসবে গানটি গাইলে শ্রোতারা আমাকে লালনের আরও একটি গান গাইতে অনুরোধ করেন।তখন আমি গান গাইতে অসম্মতি জানাই। শ্রোতাদের বলি,“আমি একটি গান গাইতে শিখেছি।এটাই ভালোভাবে গাইতে চাই।” এ গানই আমার নতুন পথের দিশা হয়েছিল।এরপর ধীরে ধীরে বুঝতে শিখি,কী আছে লালনের গানে তাঁর গানে মিশে থাকা আধ্যাত্মিক কথা ও দর্শন আমাকে ভাবিয়ে তোলে।এ পর্যায়ে অনুভব করি,লালন তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অনবদ্য এক স্রষ্টা হয়ে উঠেছেন।এটা বোঝার পর লালনের গান ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারি না।’

৫৫ বছরের সংগীতজীবনে ফরিদা পারভীনের অনেক স্মরণীয় স্মৃতি আছে।সে রকম একটি ঘটনার কথা এভাবেই বলেছিলেন, ‘১৯৭৩ সাল।বিভিন্ন আখড়া থেকে বাউলশিল্পীদের ঢাকায় এনে লালনের গান রেকর্ডের পরিকল্পনা করেন ওস্তাদ মকছেদ আলী সাঁই। তিনি তৎকালীন রেডিওর ট্রান্সক্রিপশনে কর্মরত ছিলেন। তাঁর আমন্ত্রণে ঢাকায় রেডিওতে আসি।এ সময় স্টুডিওতে উপস্থিত ছিলেন আবদুল হামিদ চৌধুরী,কমল দাশগুপ্ত,সমর দাস,কাদের জমিলির মতো বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞেরা।খুব ভয় হয়েছিল।তাঁদের সামনে আমাকে গাইতে হলো। ১৫ মিনিটের একক সংগীতানুষ্ঠান করে তাঁদের প্রশংসা পেয়েছিলাম। এটিই আমার অন্যতম স্মরণীয় স্মৃতি।’

ফরিদা পারভীন দীর্ঘদিন কুষ্টিয়া শহরে বসে লালনসংগীতের চর্চা করেছেন।নাটোরের সিংড়ায় জন্ম নেওয়া ফরিদা পারভীন ছোটবেলায় ছিলেন চঞ্চল প্রকৃতির।প্রায় সারাক্ষণ তিনি দৌড়ঝাঁপ আর খেলাধুলা করে বেড়াতেনতাঁর দাদা ও নানার বাড়ির মাঝখানে ছিল একটি নদ। আত্রাইয়ের সেই শাখানদের নাম ছিল গুর। ওই নদ পার হয়ে অধিকাংশ দিন তরুণী ফরিদা দাদার বাড়ি থেকে নানার বাড়ি যেতেন। নানার বাড়ির পাশে ছিল বিরাট একটা বিল।ছোটবেলায় খেলার সঙ্গী মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে মিলে শাপলা তুলতে যেতেন সেই বিলে।

ছোটবেলা থেকেই ফরিদা পারভীনের ভালো লাগত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান।তখন তিনি বুঝতেনও না যে তিনিই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। কিন্তু রেডিও ছেড়ে দিয়ে তাঁর গান শুনতেন। ফরিদা পারভীনের বেড়ে ওঠাটা একেবারে নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্রামে নয়।কারণ, তাঁর বাবা মেডিকেলে চাকরি করতেন আর তাঁর চাকরির বদলির সুবাদে বিভিন্ন সময়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ফরিদাকেও বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছে।এ কারণে ফরিদার বেড়ে ওঠায় বিভিন্ন জায়গার ছাপ পড়েছে। ফরিদা পারভীনের স্কুলজীবন কেটেছে বিভিন্ন শহরে।তবে তাঁর স্কুলজীবনের শুরুটা মাগুরায়। একাধিক স্কুলে পড়াশোনা শেষে তিনি কুষ্টিয়ার মীর মশাররফ হোসেন বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন।১৯৭৪ সালে কুষ্টিয়া গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি এবং একই কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করেন।

ফরিদা পারভীনের গানের হাতেখড়ি মাগুরা জেলায়।সেটা ১৯৫৭-৫৮ সালের কথা, তখন তিনি মাত্র চার-পাঁচ বছরের মেয়ে।সে সময় মাগুরায় তাঁকে গানে হাতেখড়ি দিয়েছিলেন ওস্তাদ কমল চক্রবর্তী।এরপর যেখানেই তিনি থেকেছেন, সেখানেই বিভিন্নজনের কাছে গানের তালিম নিয়েছেন। স্বরলিপি দিয়ে নজরুলের গান হারমোনিয়ামে ও কণ্ঠে তোলার কাজটি তিনি ওস্তাদ মীর মোজাফফর আলীর কাছেই প্রথম শেখেন। ১৯৬৮ সালে তিনি রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত নজরুলসংগীতশিল্পী নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর লালন সাঁইজির গানের সঙ্গে ফরিদার পারভীনের যোগাযোগ, তখন তিনি কুষ্টিয়াতে থাকতেন।সেখানে তাঁদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন মোকছেদ আলী সাঁই। ১৯৭৩ সালে ফরিদা পারভীন তাঁর কাছেই ‘সত্য বল সুপথে চল’ গান শেখার মাধ্যমে লালন সাঁইজির গানের তালিম নেন।মোকছেদ আলী সাঁইয়ের মৃত্যুর পর খোদা বক্স সাঁই, ব্রজেন দাস,বেহাল সাঁই,ইয়াছিন সাঁই ও করিম সাঁইয়ের কাছে লালনসংগীতের তালিম নেন।

স্বাধীনতার পর ফরিদা পারভীন ঢাকায় চলে আসেন।তাঁর গাওয়া গান দিয়ে ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস শুরু হলো। মোকছেদ আলী সাঁই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ছিলেন।তিনি ফরিদা পারভীনকে ঢাকায় কিছু লালনের গান গাইতে বলেন। তাঁর অনুরোধে তিনি তখন ‘খাঁচার ভিতর’, ‘বাড়ির কাছে আরশি নগর’ গানগুলো গাইলেন। তখন তিনি কুষ্টিয়া থেকে এসে মোকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে লালনের গান শিখে ট্রান্সক্রিপশনে রেকর্ডিং করতে থাকেন। ফরিদা পারভীনের প্রথম স্বামী প্রখ্যাত গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পী আবু জাফর। তাঁর সেই সংসারে রয়েছে তিন ছেলে ও এক মেয়ে; জিহান ফারিয়া, ইমাম নিমেরি উপল, ইমাম নাহিল সুমন ও ইমাম নোমানি রাব্বি।

লালন সাঁইজির গানের বাণী ও সুরকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে ফরিদা পারভীনের অবদান সর্বজনস্বীকৃত।শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বদরবারেও তিনি লালন সাঁইয়ের বাণী ও সুরকে প্রচারের কাজে নিয়েজিত ছিলেন।জাপান,সুইডেন,ডেনমার্ক,কানাডা, অস্ট্রেলিয়া,যুক্তরাষ্ট্র,যুক্তরাজ্যসহ আরও বহু দেশে লালনসংগীত পরিবেশন করেছেন।লালনসংগীতে অবদানের জন্য ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক পান ফরিদা পারভীন।এর বাইরে ১৯৯৩ সালে ‘অন্ধ প্রেম’ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত ‘নিন্দার কাঁটা’ গানটির জন্য শ্রেষ্ঠ সংগীতশিল্পী (নারী) হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।তিনি ২০০৮ সালে জাপানের ফুকুওয়াকা পুরস্কার লাভ করেন লালনশিল্পী হিসেবেই সুপরিচিত হন,তাঁর কণ্ঠে বেশ কটি আধুনিক ও দেশের গান জনপ্রিয় হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকাদির নাম’, ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’ ইত্যাদি।

 

 

আরও খবর

Sponsered content