প্রতিনিধি ২১ মার্চ ২০২৫ , ৫:০২:১৭ প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক।প্রচলিত ব্যাংকগুলোর ইসলামী শাখা বা শরিয়াহ শাখা এখন ধর্মপ্রাণ গ্রাহকদের পছন্দের তালিকায়। কারণ অনেক পূর্ণাঙ্গ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক আমানতকারীদের আস্থার সংকটে ভুগছে।
শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো নিয়ে বিতর্ক ও আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে সেসব ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের আস্থা কমেছে।এসব ইসলামী ব্যাংকের অনেকগুলোই বিগত সরকারের আমলে বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এসব ব্যাংকের পর্ষদে রদবদল করা হলেও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, গ্রাহকের আস্থা ফিরতে সময় লাগবে।
২০২৪ সাল শেষে ব্যাংকিং খাতে আমানত-প্রবৃদ্ধি কমে হয়েছে সাত দশমিক ৪৭ শতাংশ।তবে ১৮ ব্যাংকের আমানত বেড়েছে ২৬ শতাংশের বেশি।প্রচলিত ব্যাংকগুলোর কয়েকটির ইসলামী শাখায় আমানত বেড়েছে ১০০ শতাংশের বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,কয়েকটি প্রচলিত ব্যাংক ও তাদের ইসলামী শাখা সফলভাবে প্রচুর আমানত সংগ্রহ করেছে।এসব টাকা অর্ধ ডজন ব্যাংক থেকে তুলে নিয়ে এসব ব্যাংকের শরিয়া শাখায় রাখা হয়েছে।’
ইসলামী ব্যাংকে নতুন অনিয়ম পেল বাংলাদেশ ব্যাংক
তিনি আরও বলেন,এস আলম গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে তদন্ত হওয়ায় আমানতকারীরা তাদের টাকা ভালো ব্যাংকে সরিয়ে নিচ্ছেন।’
২০২৪ সালে ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স (এনসিসি) ব্যাংকে আমানত ১৩ দশমিক চার শতাংশ বেড়ে ২৫ হাজার ৪১০ কোটি টাকা হয়েছে।তবে এর ইসলামী শাখায় আমানত রেকর্ড ১১০ শতাংশ বেড়েছে।এটি ব্যাংকিং খাতে সর্বোচ্চ।
এনসিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম শামসুল আরেফিন বলেন,গত বছর কয়েকটি ব্যাংকের ওপর গ্রাহকের আস্থা অনেক কমে যায়।এটি আমাদের ব্যাংকের আমানত বাড়াতে অবদান রাখে।’
তার মতে,কয়েকটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের গ্রাহক তাদের সঞ্চয়ের টাকা তুলতে হিমশিম খাচ্ছিলেন।তাই অনেকেই শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের বিকল্প প্রতিষ্ঠান খুঁজছেন। এটি প্রচলিত ব্যাংকগুলোর ইসলামী ব্যাংকিং ইউনিটকে শক্তিশালী করেছে।
এম শামসুল আরেফিন বলেন, ‘এনসিসি ব্যাংক আর্থিকভাবে সচ্ছল।শরিয়াহভিত্তিক আর্থিক সেবার চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। এই চাহিদা পূরণ করতে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম বাড়ছে।’
একইভাবে গত বছর শেষে পূবালী ব্যাংকের মোট আমানত ছিল ৭০ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা।সামগ্রিকভাবে ব্যাংকটির আমানত প্রবৃদ্ধি ২১ শতাংশ হলেও এর ইসলামী শাখায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯১ দশমিক ১৮ শতাংশ।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী ডেইলি স্টারকে বলেন,অনেক গ্রাহক পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলায় তারা ভালো প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামী শাখার দিকে ঝুঁকছেন।’
‘কঠোরভাবে শরিয়াহ মেনে চলার নীতি আমাদের ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমের প্রতি গ্রাহকের আস্থা বাড়াতে সহায়তা করেছে।’
আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে—গত বছর প্রাইম ব্যাংকের মোট আমানত বেড়েছে ১২ দশমিক ৭৪ শতাংশ।তবে ব্যাংকটির ইসলামী শাখায় আমানত বেড়েছে ৬১ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে—মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ইসলামী শাখায় আমানত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ।ওয়ান ব্যাংকের ইসলামী শাখায় আমানত বেড়েছে ৫৪ শতাংশ।
প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান বলেন, ‘চাহিদা, সহায়ক নীতি,ঝুঁকি ভাগাভাগি,আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ইত্যাদি কারণে দেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের আমানত বাড়ছে।এগুলো ধর্মীয় নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং টাকার নিরাপত্তা দেয়।’
প্রাইম ব্যাংক দেশের প্রথম প্রচলিত ব্যাংক হিসেবে ইসলামী ব্যাংকিং চালু করে। ১৯৯৫ সালে এর পাঁচ শাখায় এ ধরনের সেবা চালু হয়।
‘ইসলামী ব্যাংকিংয়ে আমাদের ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা। শক্তিশালী আর্থিক পরিস্থিতি,ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা, সময়োপযোগী আমানত সুবিধা ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত কর্মী থাকায় প্রাইম ব্যাংকে আমানত প্রবৃদ্ধি হয়েছে।’
গত বছর যমুনা ব্যাংকের সার্বিক আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল ২৬ দশমিক ৩১ শতাংশ।তবে ব্যাংকটির ইসলামী শাখায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৭ দশমিক ১৭ শতাংশ।
যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মির্জা ইলিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ ডেইলি স্টারকে বলেন,শরিয়াহভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ ব্যাংকগুলো সাময়িকভাবে গ্রাহকের আস্থার সংকটে ভুগছে।’
এ ছাড়া,প্রচলিত ব্যাংকগুলোর ইসলামী শাখায় মুনাফা শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর তুলনায় বেশি।এটি গ্রাহকদের আকৃষ্ট করছে জানিয়ে তিনি বলেন,এই শক্তিশালী আমানত প্রবৃদ্ধি আমাদের তারল্য ব্যবস্থাকে উন্নত করেছে।’
গত বছর মিডল্যান্ড ব্যাংকের আমানত বেড়েছে ২৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ।এর ইসলামী শাখায় আমানত বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
মিডল্যান্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী আহসান-উজ জামান বলেন,ব্যাংকটির প্রতি জনগণের আস্থা বাড়ছে কারণ এটি গ্রাহকের প্রয়োজন অনুসারে আর্থিক সেবা দেয়।’
তিনি বলেন,গ্রাহকরা মিডল্যান্ড ব্যাংকে সঞ্চয় রাখতে পূর্বের চেয়ে আরও নিরাপদ বোধ করছেন।এটি আমাদের আমানত বাড়াতে সহায়তা করেছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে—গত বছর অন্য যেসব ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিং শাখায় আমানত বেড়েছিল সেগুলো হলো—সোনালী ব্যাংক ৩৪ দশমিক ১৫ শতাংশ,মার্কেন্টাইল ব্যাংক ২৯ দশমিক ১৫ শতাংশ,এসবিএসি ব্যাংক ২৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ,ট্রাস্ট ব্যাংক ৩৫ শতাংশ,সিটি ব্যাংক ২০ দশমিক ৪০ শতাংশ,মেঘনা ব্যাংক ৭২ শতাংশ ও ইউসিবি ২৭ শতাংশ।
অন্যদিকে,শরিয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংকসহ আর্থিক সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোয় গত বছর আমানত কমেছে।বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক,এবি ব্যাংক,বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক,এক্সিম ব্যাংক,ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক,আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক,ন্যাশনাল ব্যাংক,পদ্মা ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের প্রবৃদ্ধি কমেছে।