প্রতিনিধি ২৬ মে ২০২৩ , ৫:০৭:১৯ প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক।।প্রবাদ আছে রতনে রতন চেনে।এতে বোঝানো হয় অসৎ লোক আর একজন অসৎ লোককে দেখলেই চিনতে পারে।তাদের মধ্যে মৈত্রীও হয় সহজে।এই প্রবাদেরই যেন সর্বশেষ নমুনা দেখা গেল মোহাম্মদ আলী হায়দার রতনের ব্যাংক ঋণকাণ্ডে।
এই রতনের কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ৬০৯ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে আর ফেরত পায়নি পাঁচটি ব্যাংক। মন অবস্থার মধ্যেও এই খেলাপিকেও ঋণ দিতে চেয়েছে এবি ব্যাংক।বেসরকারি ব্যাংকটি রতনকে কৌশলে ৩৫০ কোটি টাকা ঋণের সুবিধাভোগী করতে জোরালো চেষ্টা চালায়।যা গড়িয়েছে উচ্চ আদালত পর্যন্ত।
ঋণ খেলাপিকে নতুন করে ঋণ দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই রতনের সাজানো কাগুজে প্রতিষ্ঠান ব্র্যান্ড শেয়ার ট্রেডিংয়ের নামে ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেয় এবি ব্যাংক। তড়িঘড়ি করে রতনের কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ঘটনা ফাঁস হলে প্রশ্ন ওঠে ‘রতনে রতন চিনল কেমনে?’
তবে তাদের এই অসাদুপায় ধরা পড়ে যায় আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) চোখে।এই আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার পদক্ষেপে আটকে গেছে সাজানো প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ ছাড়ের প্রক্রিয়া।
এদিকে বানিজ্য মন্ত্রণালয় রতনের কাগুজে প্রতিষ্ঠান ব্র্যান্ড শেয়ার ট্রেডিংয়ের কাছ থেকে চিনি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত বুধবার অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ব্র্যান্ড শেয়ার ট্রেডিং থেকে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে ১২ হাজার ৫০০ টন চিনি কেনার প্রস্তাব দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রস্তাবটি অনুমোদন পায়। এ চিনি কেনার জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ব্যয় হবে ১৩১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। প্রতি কেজি চিনির দাম পড়বে ১০৫ টাকা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে,ব্র্যান্ড শেয়ার নামে কাগুজে কোম্পানিটির মালিকানায় রতনের নাম নেই।ওই কোম্পানির ৯০ ভাগ মালিকানা দেখানো হয় মোহাম্মদ আতাউর রহমান নামে এক ব্যক্তির।তিনি একজন ছাত্র বলে পরিচয়পত্রের তথ্য বিশ্লেষন করে নিশ্চিত হয়েছে আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট।আর ১০ ভাগ মালিকানা দেখানো হয় রতনের মালিকানাধীন ব্র্যান্ড উইন গ্রুপ অব কোম্পানির এক কর্মকর্তা মো. মামুন রশিদের নামে।
কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ অনুমোদনের বিষয়ে এবি ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে বিএফআইইউ। চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনকেও। বিষয়টি জানাজানি হলে গত বুধবার ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদনে জালিয়াতির অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।বিস্তারিত অনুসন্ধান করে আগামী তিন মাসের মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন,সিআইডি ও বিএফআইইউকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন,আর্থিক খাতের আলোচিত অর্থ পাচারকারী পি কে হালদারের মতোই নামসর্বস্ব কোম্পানি খুলে রতন ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা হাতানোর মিশনে নেমেছেন। পি কে হালদারও একই কায়দায় হাজার হাজার কোটি লুটে নিয়েছেন।
বিএফআইউর চিঠির তথ্য বলছে,২০২২ সালের ৯ জুন কোম্পানি হিসেবে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর (আরজেএসসি) থেকে নিবন্ধন নেয় ব্র্যান্ড শেয়ার ট্রেডিং লিমিটেড।এরপর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর ট্রেড লাইসেন্সও নেয় প্রতিষ্ঠানটি।
এর তিন মাস পর গত বছরের ৭ নভেম্বর ১০ হাজার টাকা জমা দিয়ে এবি ব্যাংকের গুলশান শাখায় কোম্পানিটি একটি চলতি হিসাব খোলে।এ বছরের ১০ জানুয়ারি কোম্পানিটি ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ চেয়ে এবি ব্যাংকে আবেদন করে। আবেদন মঞ্জুর হলেও বিএফআইইউ অনিয়ম খুঁজে পাওয়ায় কোম্পানিটি আর টাকা তুলে নিতে পারেনি ব্যাংক থেকে।
বিএফআইইউর চিঠি সূত্রে জানা গেছে,গত ১০ জানুয়ারি এবি ব্যাংকের গুলশান শাখায় ব্র্যান্ডশেয়ার ট্রেডিংয়ের ঋণের আবেদন আসে।আবেদনে প্রতিষ্ঠানটির মালিক দেখানো হয় মোহাম্মদ আতাউর রহমান ও মো. মামুন রশিদকে।তবে এর ঠিকানা দেওয়া হয়েছে রতনের মালিকানাধীন ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশনের,যার কার্যালয় ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে।
আর আবেদনপত্রের প্যাডে যে ই-মেইল ও ওয়েবসাইট ব্যবহার করা হয়েছে তা-ও তারই মালিকানার ব্র্যান্ডউইন নামে আরেকটি কোম্পানির।এ কোম্পানির নামে দ্রুত ছাড় করতে আবেদনের দিনই এবি ব্যাংকের গুলশান শাখা ব্যবস্থাপকসহ তিন কর্মকর্তা গ্রাহকের ধানমন্ডির অফিস ও বাড়ির ঠিকানা পরিদর্শন করে একটি পরিদর্শন প্রতিবেদন দেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়,ভুয়া পরিদর্শন প্রতিবেদন দিয়ে একেবারে নতুন নিবন্ধিত কোম্পানিকে বড় কোম্পানি দেখানো হয়।পরদিন ঋণ প্রস্তাবটি শাখা থেকে প্রধান কার্যালয়ের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটিতে পাঠানো হয়।আবেদনের এক মাস পর গত ৯ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকের ৭৫৫তম পর্ষদ সভায় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের জোর চেষ্টায় তা অনুমোদন হয়।
আবার ব্র্যান্ড শেয়ার ট্রেডিংয়ের নামে ঋণ অনুমোদন হলেও সব ধরনের ব্যাংকিং রীতিনীতি অমান্য করে ইনফ্রাটেকের অনুকূলে ১৬ কোটি ১৩ লাখ টাকার গ্যারান্টি ইস্যু করে ব্যাংক।
সূত্র বলছে,রতনের মালিকানাধীন ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন ও ব্র্যান্ডউইন গ্রুপ অব কোম্পানির ৫টি ব্যাংকে ৬০৯ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে,যার বেশিরভাগই এখন খেলাপি।বিভিন্ন সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে এ ঋণ নেওয়া হয়।কাজ শেষ হলেও ন্যাশনাল,ইউসিবি,এসআইবিএল,জনতা ও বেসিক ব্যাংক ঋণের টাকা পায়নি।ফলে এসব ঋণ এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
এছাড়া আদৌ কার্যাদেশ পেয়েছে কি না, তা নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠেছে ব্যাংকগুলোতে।জানা গেছে,বেনামি কোম্পানির নামে ঋণ অনুমোদন বিষয়ে প্রথমে গত ২০ মার্চ এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে বিভিন্ন তথ্য চেয়ে চিঠি দেয় বিএফআইইউ।এছাড়া পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ঋণ ছাড় বন্ধ রাখতে বলা হয়।পরে গত ২৫ এপ্রিল বিষয়টি পরিচালনা পর্ষদের সভায় উপস্থাপন করে পর্ষদের পর্যবেক্ষণ, মতামত ও এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানানোর জন্য এমডিকে আরেকটি চিঠি দেওয়া হয়।যদিও চিঠির জবাব দেননি ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
এ বিষয়ে জানতে ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানির ল্যান্ড ফোনে ফোন করে কথা হয় আলী হায়দার রতনের সঙ্গে। তিনি বলেন,যে প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন হয়,সে কোম্পানিতে আমার মালিকানা নেই।’ তবে ওই কোম্পানিটির মালিকরা তার আত্মীয় বলে স্বীকার করেন তিনি।এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে,খেলাপিকে নতুন করে ঋণ দিতে পারে না কোনো ব্যাংক।যে কারণে ভিন্ন কৌশলে আলী হায়দার রতনকে ওই কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার চেষ্টা করে এবি ব্যাংক।আর এমন জালিয়াতি-কারসাজিতে ব্যাংকটির এমডিও জড়িত।
এ বিষয়ে এবি ব্যাংকের পক্ষে হেড অব ব্র্যান্ড তানিয়া সাত্তার বলেন,বিএফআইইউর চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাদেরকে অবহিত করা হয়েছে।এবি ব্যাংক স্বপ্রণোদিত হয়ে উক্ত নন-ফান্ডেড ঋণ সুবিধার সর্বপ্রকার লেনদেন স্থগিত করেছে।ঋণ সুবিধার কোনো অর্থ ঋণপত্র বা গ্যারান্টির মাধ্যমে অদ্যাবধি উত্তোলন বা প্রদান করা হয়নি।’