প্রতিনিধি ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ , ৫:১১:২৬ প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক।।জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ ক্রমেই গভীর হচ্ছে।এই প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা নিশ্চিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হচ্ছেন রাজনীতিবিদরা।কেউ চাইছেন পুলিশের একটি দল,কেউ অস্ত্রধারী দেহরক্ষী (গানম্যান),আবার কেউ চাইছেন আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স।কেউ কেউ একই সঙ্গে নিরাপত্তা ও অস্ত্রের লাইসেন্স—দুটোই চেয়েছেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়,এখন পর্যন্ত অন্তত ১৫ জন রাজনীতিবিদ নিরাপত্তা,গানম্যান অথবা অস্ত্রের লাইসেন্স চেয়ে আবেদন করেছেন।এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।পাশাপাশি প্রায় ২৫ জন সরকারি কর্মকর্তা আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছেন।
হাদি হত্যার পর আবেদন বেড়েছে
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান,ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও সম্ভাব্য প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনার পর রাজনীতিবিদদের মধ্যে নিরাপত্তা চাওয়ার প্রবণতা স্পষ্টভাবে বেড়েছে।তিনি বলেন, “কাকে গানম্যান দেওয়া হবে,কাকে অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হবে—এসব বিষয়ে চলতি সপ্তাহেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে।”
১২ ডিসেম্বর রাজধানীর পুরানা পল্টনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর শরিফ ওসমান হাদি চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরে মারা যান।মামলার প্রধান আসামি নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ফয়সাল করিম এখনো গ্রেপ্তার হয়নি—যা নিরাপত্তা উদ্বেগকে আরও তীব্র করেছে।
কারা কারা নিরাপত্তা চেয়েছেন
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র অনুযায়ী—
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান—সার্বক্ষণিক গানম্যান ও বাসভবনের জন্য সশস্ত্র পুলিশ সদস্য
জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু—নির্বাচনী নিরাপত্তা
এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ—নির্বাচনী প্রচারে পুলিশের গাড়িসহ নিরাপত্তা
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি—পুলিশ সদস্য ও গানম্যান
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব ইউনুস আহম্মেদ সেখ—গানম্যান
বিএনপি মনোনীত ও স্বতন্ত্র বেশ কয়েকজন সম্ভাব্য প্রার্থী—গানম্যান বা অস্ত্রের লাইসেন্স
জামায়াতের প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন,সাম্প্রতিক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় দলের আমিরের নিরাপত্তা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।পর্যায়ক্রমে অন্য শীর্ষ নেতাদের ক্ষেত্রেও আবেদন করা হবে।
নির্বাচনের সময় অস্ত্র নীতিমালা
১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।ভোট হবে ১২ ফেব্রুয়ারি,প্রচার শুরু ২২ জানুয়ারি।
এই প্রেক্ষাপটে ১৪ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জারি করে
‘রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও জাতীয় সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীদের অনুকূলে আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স ও রিটেইনার নিয়োগ নীতিমালা-২০২৫’।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী,ভোটের আগে ও পরে মিলিয়ে ৯৬ ঘণ্টা বৈধ অস্ত্র প্রদর্শন নিষিদ্ধ।অতীতে নির্বাচন কমিশন সাধারণত বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়ার নির্দেশনা দিলেও এবার সে ধরনের নির্দেশনা এখনো আসেনি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সতর্ক
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন,
“ঢালাওভাবে অস্ত্রের লাইসেন্স দিলে অপব্যবহারের ঝুঁকি থাকে।তাই কার ঝুঁকি কতটা—তা যাচাই করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান মনে করেন,
> “নতুন করে অস্ত্রের লাইসেন্স দিয়ে কোনো কাজ হবে না। কারও যদি নির্দিষ্ট ও চিহ্নিত ঝুঁকি থাকে,তবে তার জন্য আলাদা নিরাপত্তা দেওয়া যেতে পারে।এই ঝুঁকি মূল্যায়ন আরও আগেই করা উচিত ছিল।”
বিশ্লেষকদের মতে,নিরাপত্তা কেবল অস্ত্রের মাধ্যমে নিশ্চিত হয় না। কার্যকর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান,পেশাদার পুলিশ ব্যবস্থা,রাজনৈতিক সহনশীলতা ও আইনের শাসনই টেকসই নিরাপত্তার ভিত্তি।নেতাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া রাষ্ট্রের সক্ষমতার পরিচয় নয়; বরং এটি রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতার একধরনের স্বীকারোক্তিও হতে পারে।
উপসংহার
ভোট যত ঘনিয়ে আসছে,নিরাপত্তা উদ্বেগ ততই প্রকাশ্য হচ্ছে। গানম্যান ও অস্ত্রের লাইসেন্সের আবেদন কেবল ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়—এটি দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও রাষ্ট্রের সক্ষমতা নিয়েও বড় প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে। নির্বাচন কতটা শান্তিপূর্ণ হবে,তার একটি বড় নির্ভরতা এখন এই নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপরই।

















