প্রতিনিধি ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ , ৫:০৩:২৬ প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক।।প্রশাসনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি ও পাওনা পরিশোধের পরিমাণ এখনও চূড়ান্ত করতে পারেনি অর্থ মন্ত্রণালয়।পদোন্নতি ও পদায়ন পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ধরনের পাওনা সরকারের বিশেষ তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হচ্ছে।চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের যেকোনও সময় তা সংযোজন-বিয়োজন করে পরিশোধের পরিমাণ চূড়ান্ত করা হবে।অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে,আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে নানাভাবে বঞ্চনার শিকার এবং এ সময়ের মধ্যে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের আবেদন পর্যালোচনা করে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য বঞ্চনা নিরসন কমিটি গঠন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পদ-পদবি ও পদোন্নতি বঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রতিকার পেতে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আবেদন করার পরামর্শ দিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, নির্ধারিত সময়ে এক হাজার ৫৪০টি আবেদনপত্র জমা পড়েছিল।এর মধ্যে ১৯টি আবেদন ছিল মৃত কর্মকর্তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে।কমিটি আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই শেষে সুপারিশ তৈরি করে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়।এরপর তা অনুমোদনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়।বঞ্চিত ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো কর্মকর্তাদের মধ্যে ৭৬৪ জনের ভূতাপেক্ষ সুযোগ-সুবিধাসহ পদোন্নতির অনুমোদন দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
জানা গেছে,তাদের মধ্যে সচিব পদে ১১৯ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।কর্মকর্তাদের মধ্যে সচিব পদ ছাড়াও গ্রেড-১ পদে ৪১ জন,অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২৮ জন,যুগ্ম সচিব পদে ৭২ জন ও উপসচিব পদে চারজন পদোন্নতি পেয়েছেন। বিধান অনুযায়ী সরকারের নিজস্ব বিশেষ তহবিল থেকে তাদের আর্থিক সুবিধাদি পরিশোধ করা হয়েছে বা হচ্ছে।
উল্লেখ্য,২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের একপর্যায়ে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়।এরপর ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপরই অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রশাসনে রদবদল,উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল এবং গত সরকারের আমলে ‘বঞ্চিতদের’ পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।তারই ধারাবাহিকতায় ৭৬৪ কর্মকর্তাকে পদোন্নতির অনুমোদন দিয়েছে সরকার।
এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে,অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের জন্য সাবেক অর্থ সচিব জাকির আহমেদ খানের নেতৃত্বে গঠিত ‘বঞ্চনা নিরসন কমিটির’ প্রতিবেদনের আলোকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পাঠানো সারসংক্ষেপ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে।কর্মকর্তাদের পদভিত্তিক আলাদা আলাদা পদোন্নতির সরকারি আদেশ-জিও জারি করে দ্রুত তাদের বকেয়া টাকা প্রাপ্তির জিও জারি করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।ইতোমধ্যে বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীর পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে।
জানা গেছে,বিগত সরকারের আমলে অবসরপ্রাপ্ত ও পদোন্নতিবঞ্চিত ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ইতোমধ্যে ৭৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে— যা সামনে আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে,সরকারের ব্যয় কমাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব,মুখ্য সচিব ও সচিবের সংখ্যা কমিয়ে ৬০ জন করার সুপারিশ ছিল জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের। পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয় কমিশনের প্রতিবেদনে।কিন্তু এখনও বিষয়টি দৃশ্যমান কোনও উদ্যোগ নেই।অথচ বিভিন্ন অজুহাতে চাকরি ফেরত পেতে বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পাওনা পদোন্নতি দিয়ে তাদের প্রাপ্য সব পাওনা পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।তবে এর পরিমাণ এখনও চূড়ান্ত করতে পারেনি অর্থ মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে,জনপ্রশাসনের কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ সাধারণ সেবা খাতে প্রতিনিয়তই বাড়ছে সরকারের ব্যয়। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এ খাতে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা।চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ,ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি এবং সামনে সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে এ ব্যয় আরও বাড়তে পারে।তবে ব্যয় বাড়লেও এ খাতের সংস্কার না হওয়ায় দেশের সাধারণ নাগরিকরা সুবিধা পাচ্ছেন না বলে মনে করেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।
উল্লেখ্য,সরকারি প্রশাসন,নির্বাহী বিভাগ,বিচার বিভাগ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা,কর সংগ্রহ,ডাটা ব্যবস্থাপনাসহ রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো পরিচালনায় প্রতি বছরের বাজেটেই বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ দেয় সরকার।আর সেই অর্থের একটা বড় অংশই ব্যয় হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ নানাবিধ সুবিধা পরিশোধে।
অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী,২০২৪-২৫ অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সাধারণ সেবা খাতে ৪৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সরকার।আগের অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ৩২ হাজার ৮৪ কোটি টাকা।এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে সাত মাসে সরকারের ব্যয় বেড়েছে ১৫ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা।অর্থবছর শেষে এই ব্যয় দাড়াতে পারে ৩২ থেকে ৩৭ হাজার কোটি টাকায়।
সূত্র জানিয়েছে,কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শুধু বেতন-ভাতা বাবদ চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের ব্যয় হয়েছে ৩৭ হাজার ৪৭ কোটি টাকা।গত অর্থবছরের একই সময়ে যেখানে ৩৬ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল।এছাড়া শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা খাতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে খরচ হয়েছে ১২ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা।গত অর্থবছরের একই সময় পর্যন্ত এ খাতে সরকারের ব্যয় ছিল ১২ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা।ফলে এ খাতেও সরকারের ব্যয় বেড়েছে। চলতি অর্থবছর শেষে এই ব্যয় আরও বাড়বে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে,২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা বাবদ বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮১ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা—যা গত বছরের তুলনায় তিন হাজার ৬৮৬ কোটি বেশি।এর মধ্যে কর্মকর্তাদের বেতন বাবদ ১২ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা ও কর্মচারীদের বেতন বাবদ ২৯ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা ব্যয় হবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন ভাতা বাবদ ব্যয় হবে ৩৯ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা।এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৭৭ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছর এ খাতে ব্যয় হয় ৬৩ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান,সাধারণত প্রতি বছরই বেতন-ভাতা খাতে বাজেট বরাদ্দ ৬ থেকে ৮ শতাংশ বাড়ে।সেই হিসাবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য এই বরাদ্দ প্রায় ৮৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।তবে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ মতো যদি মহার্ঘভাতা যুক্ত হয় তাহলে ব্যয় বেড়ে ৯৭ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি যেতে পারে। সাধারণত সরকার প্রতি পাঁচ বছর পর পর একটি নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা করে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,বিগত সরকারের সময় অবসরে যাওয়া অনেক কর্মকর্তাদের প্রশাসনে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।তাদের পদোন্নতি দিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পদায়নও করা হয়েছে।এই ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে।ইতোমধ্যে সরকার গঠিত এ সংক্রান্ত একটি কমিটি অবসরে যাওয়া বা পদবঞ্চিত বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ফিরিয়ে আনাসহ তাদের পাওনা পরিশোধের সুপারিশ করেছে,যা রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিয়েছেন। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।তাদের পাওনা পরিশোধে জিও জারি করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
তিনি জানান.সরকারের বিশেষ বরাদ্দ থেকে এই পাওনা পরিশোধ করা হচ্ছে।সব পাওনা পরিশোধ হয়ে গেলে তা একত্রিত করে মূল বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।তখন এই খাতের মোট ব্যয় জানানো সহজ হবে।
অপরদিকে এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমানের বক্তব্য পাওয়া না গেলেও তিনি তার নিজের ফেসবুকের ভেরিফায়েড পেজে লিখেছেন, “অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের জন্য গঠিত ‘বঞ্চনা নিরসন কমিটির (বনিক)’ প্রতিবেদনের আলোকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রেরিত সারসংক্ষেপ মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে।”
‘কর্মকর্তাদের মধ্যে সচিব পদ ছাড়াও গ্রেড-১ পদে ৪১ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২৮ জন,যুগ্ম সচিব পদে ৭২ জন ও উপসচিব পদে চার জনের পদোন্নতির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।’
তিনি লিখেছেন,‘পদভিত্তিক আলাদা আলাদা পদোন্নতির সরকারি আদেশ (জিও) জারি করে দ্রুত বকেয়া টাকা প্রাপ্তির জিও জারি করা হবে।’

















