জাতীয়

ভিসানীতি প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র রক্ষা কতটুক যৌক্তিক কিংবা কার্যকর?

  প্রতিনিধি ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ৩:৪৬:৩৭ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।বাংলাদেশে মার্কিন ভিসানীতি প্রয়োগ শুরুর পর তা বেশ আলোচনায় আসে।গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট সরাসরি নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্তদের নাম প্রকাশ না করলেও কয়েকজনের নাম নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভিসানীতির উদ্যোগ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিবৃতি অনুযায়ী দেশের গণতন্ত্রকে ক্ষুন্নকারী,নির্বাচনে জালিয়াতি এবং সহায়তাকারী,সরকারি আমলা এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যরাও এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসতে পারেন।সর্বোপরি এই নীতির প্রভাব কেমন হতে পারে বাংলাদেশের ওপর। শুরুতেই প্রশ্ন আসে ভিসানীতি প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র রক্ষা কতটুক যৌক্তিক কিংবা কার্যকর?

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন,এখন গণতন্ত্র-ঘাটতির যুগ।এই যুগে আত্মপরিচয়ের রাজনীতি (আইডেন্টিটি পলিটিক্স), লোকরঞ্জনী রাজনীতি (পপুলিস্ট পলিটিক্স) এবং কুতথ্যের (ডিজইনফরমেশন) রাজনীতির জয়-জয়কার।লোকে এগুলো খুব পছন্দ করে।এ ধরণের প্রার্থী ও দলকে ভোট দিতে অনেকেই আগ্রহী।এ কারণে সারা দুনিয়াতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধবিরোধী প্রচুর নেতা ও দল দেখা যায়।এমতাবস্থায় বাইডেন প্রশাসনের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রকল্প কতটা সার্থক হবে,আমি তা নিশ্চিত নই।আরেকটা কথা হচ্ছে,বৈশ্বিক পর্যায়ে অনুশীলনের সময় যদি সবার জন্য একই মান নির্ধারণ করা না হয়,তাহলে এই প্রকল্প থেকে খুব একটা ফল আসবে না।

তবে এই নীতি প্রয়োগের পর রাজনীতিবিদ এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা গেছে উদ্বেগ।বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর প্রভাব সম্পর্কে শান্তনু মজুমদার বলেন, প্রথমবার যখন ঘোষণাটি আসে তখন একধরণের প্রভাব অনুভূত হয়েছিল।সরকারি দলকে বিষন্ন এবং বিরোধীদেরকে ব্যাপক চাঙ্গা মনে হয়েছিল।

কিন্তু গত কয়েক দিন আগে আবার ঘোষণাটি আসার পরে কোনো দিক থেকে খুব একটা মাতামাতি লক্ষ্য করছি না। আমার মনে হয়,মার্কিন ভিসা নীতি নির্বাচন পর্যন্ত সামান্য একটু মনস্তাত্ত্বিক চাপ হিসেবে থাকলেও থাকতে পারে।কিন্তু নির্বাচনের সাফল্য নির্ভর করবে রাজনৈতিক রফার ওপরে। আর এটা হতে হবে ‘দেশি সমাধান’।

এই ভিসানীতির প্রভাব বৈশ্বিক রাজনীতিতেও বাংলাদেশকে ভোগান্তিতে ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক খালিদ কুদ্দুসের মতে,যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটি পদক্ষেপ নিয়েছে,নিশ্চয়ই এর পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণ অবশ্যই আছে।এখন সরকারের উচিত স্যাংশনের বিষয় মাথায় রেখে কীভাবে তা মোকাবিলা করতে পারব সেই পদক্ষেপ নেওয়া।কেননা এই নিষেধাজ্ঞা শুধু যে নির্বাচনেই প্রভাব ফেলবে এমনটা না,অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।আমরা আশা করব,সরকার ইতোমধ্যে এ বিষয় নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।যদি এই সমস্যা সামনে কমার বদলে আরও বেড়ে যায় তাহলে এর প্রভাব দেশের অর্থনীতিতেও বাজেভাবে পড়তে পারে।

সাম্প্রতিক দশকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে হট কেকে পরিণত হয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল।এই অঞ্চলে বাংলাদেশও সম্পৃক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখানে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে তা স্পষ্ট।বাংলাদেশের ওপর ভিসা নীতি প্রয়োগ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব বিস্তারের কোনো কৌশল হতে পারে কিনা এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো রোবেল মোল্লা ইত্তেফাককে বলেন,নিওক্লাসিক্যাল বাস্তববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিকে দেখলে,বাংলাদেশের অবস্থানকে দুটি দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যায়।

প্রথমত,দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ এক গুরুত্বপূর্ণ ও উদীয়মান দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ফলে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থের পক্ষে অগ্রাধিকার নির্ধারণে আরও স্পেস পাচ্ছে।দ্বিতীয়ত,বৈশ্বিক শক্তিসমূহের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক লড়াইয়ের ক্ষেত্র হিসেবে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের উত্থান আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। আর বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতি ও ভূ-কৌশলগত কারণে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিসমূহের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ভিসানীতিতে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কভিসানীতিতে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক।তাই যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার আধিপত্য বৃদ্ধি ও চীনের প্রভাব ঠেকাতে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা করছে,সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রচেষ্টা বলয়ের বাইরে নয়।যুক্তরাষ্ট্র কাছে টানার ক্ষেত্রে হার্ড কিংবা সফট উভয় অ্যাপ্রোচই অনুসরণ করতে পারে। তাই ভিসা নীতিকে বৃহত্তর ভূ-রাজনীতির হিসেব-নিকেশ থেকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই।

কিন্তু বাংলাদেশ তার ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুকে বর্ণিত কৌশল অনুসরণ অব্যাহত রাখবে।এ আউটলুক বাংলাদেশকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও নিয়মতান্ত্রিক বহুপক্ষীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করা ও জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।সুতরাং,যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি বাংলাদেশের এ নীতিতে ভিন্নতা আনতে পারবে বলে আমার কাছে এমনটা মনে হচ্ছে না।

আরও খবর

Sponsered content