আন্তর্জাতিক

ভারত ও চীন বিশ্ব মঞ্চে একসঙ্গে কাজ করার মতো সুযোগ তৈরি করেছে

  প্রতিনিধি ১৩ এপ্রিল ২০২৩ , ১:৪৫:২৯ প্রিন্ট সংস্করণ

অনলাইন ডেস্ক রিপোর্ট।।ভারত ও চীন বিশ্ব মঞ্চে একসঙ্গে কাজ করার মতো সুযোগ তৈরি করেছে।তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়া নিয়েও চীন ক্ষুব্ধ।বিশ্বের দুটি বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ ও এশিয়ার প্রতিবেশী দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনায় চীনের শক্তি বৃদ্ধিতে সতর্ক হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও অপর পশ্চিমা দেশগুলোর ঘনিষ্ঠ হয়েছে ভারত।ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের অভূতপূর্ব পদক্ষেপ নিলেও ঐতিহ্যগতভাবে জোট নিরপেক্ষ নয়াদিল্লির যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক প্রতিরক্ষা বা সামরিক জোট গড়ে তুলেনি।অদূর ভবিষ্যতেও এমন কিছুর সম্ভাবনা কম বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।মার্কিন সাময়িকী নিউজউকের এক প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে।

চীনে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত অশোক কান্ত বলেছেন, আসলে আমরা ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিক মিত্র বলে মনে করি।কিন্তু একটি কোনও সামরিক জোট নয়।

অশোক কান্ত বলেন,আমরা দুই শতক ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিলাম।এরপর আমরা বিশ্বের একটি জনবহুল দেশ হিসেবে আবির্ভূত হই।এটি ছিল উদ্ভাবনী গণতন্ত্র,বহু সংস্কৃতির এবং উন্মুক্ত সমাজ।শীতল যুদ্ধের সময় আমরা সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে,যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে কোনও পরাশক্তির অনুসারি হওয়া উচিত হবে না ভারতের। এটি উভয় দেশের জন্য কাজে আসবে।

বর্তমানে এই নীতিকে ভারত কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ হিসেবে উল্লেখ করে।চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিরোধ বৃদ্ধির পরও এই নীতি বজায় রেখেছে।অবশ্য ওয়াশিংটনকে ভালো অংশীদার হিসেবে মনে করে নয়াদিল্লি।

অশোক কান্ত বলেন,আমরা সমপর্যায়ে থাকব না,আমরা বিভিন্ন ইস্যুতে অবস্থান নেব।কিছু বিষয়ে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি হতে পারি,তবে আমরা একটি সামরিক জোটে যোগ দেব না।এই মৌলিক ঐকমত্য অপরিবর্তিত রয়েছে।

এমন অবস্থানকে নিরপেক্ষতা হিসেবে হাজির করা যায় না। শীতলযুদ্ধের সময় নয়াদিল্লি মস্কোর সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব গড়ে তোলে।এই সম্পর্ক এখনও বজায় রয়েছে কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর অস্ত্রভাণ্ডারে রুশ অস্ত্রের উপস্থিতিতে।

কান্ত বলেন,যুদ্ধ নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও আমরা রাশিয়ার নিন্দা জানানো থেকে বিরত থেকেছি কারণ তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আমাদের কাছে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ,এমনকি বর্তমানেও বিভিন্ন কারণে।

ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই নয়াদিল্লি নিজের সামরিক অংশীদারত্বে বৈচিত্র্য আনার উপায় খুঁজছিল।এই প্রবণতা মার্কিন-ভারত সম্পর্কের জন্য বড় সুযোগ।কান্ত বলেছেন, এক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা একটি বড় খাত হিসেবে সামনে আসে।

চীনের সঙ্গে ভারতের দুই হাজার একশ মাইল দীর্ঘ সমীন্ত রয়েছে।দুই আঞ্চলিক শক্তির কয়েক দশকের উত্তেজনার মূলে এই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা নামের এই সীমান্ত।২০২০ সালে দুই দেশের সেনারা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল।উভয় দেশ উত্তেজনা নিরসনের কথা বললেও তা কখনও থামেনি।

সীমান্তে দুই দেশের সর্বশেষ সংঘাত হয় গত বছর ডিসেম্বরে। মার্কিন সংবাদমাধ্যমের খবরে অজ্ঞাত সূত্রকে উদ্ধৃত তখন বলা হয়েছিল,সংঘর্ষের সময় ভারতের রিয়েল-টাইম গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে যুক্তরাষ্ট্র।

রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় ভারত-চীন কূটনৈতিক উদ্যোগে সরাসরি জড়িত ছিলেন কান্ত।তিনি বলেন,গত কয়েক বছরে বেইজিংয়ের উদ্যোগ ভারতে গভীর উদ্বেগ এবং দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করেছে,এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও।তাই ভারত নিশ্চিতভাবেই চীনের কোনও ধরনের নিয়ন্ত্রণের দিকে অগ্রসর হতে আগ্রহী নয়।আমরা বিশ্বাস করি যে চীনের মতো দেশকে ধারণ করা যাবে না।আবার আমরা চীন থেকে অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নকরণেও আগ্রহী নই।আমি মনে করি আমরা চীনকে নিয়ে ঝুঁকিমুক্ত কৌশলের দিকে বেশি ঝুঁকছি।এপ্রিল মাসে পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্তে যা ঘটেছিল তার পুনরাবৃত্তি এড়াতে আমরা চীনের বেপরোয়া আচরণ থেকে রক্ষার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আগ্রহী।

তিনি বলেন,আমরা মূলত নিজেদের সামর্থ্য গড়ে তুলব। কিন্তু এজন্য বহির্বিশ্বে চীনকে ঘিরে ভারসাম্য প্রয়োজন এবং পরে যুক্তরাষ্ট্র ও একই মানসিকতার দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন।এটি আমাদের নীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

এটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ আমাদের প্রতিরক্ষা বাজেট মোটামুটি কম আক্রমণাত্মক এবং অদূর ভবিষ্যতে আমরা উন্নয়নের মনোযোগ দিতে চাই।সীমান্তে কোনও সংঘাত বা উত্তেজনা আমাদের স্বার্থের পক্ষে না।

ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ভিজিটিং অধ্যাপক স্মরণ সিং মনে করেন,উত্তেজনা নিরসন হলো একমাত্র উপায় যার ফলে ভারত ও চীন নিজেদের উন্নয়নের চাকা সচল রাখতে পারবে।কিন্তু দুটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি এবং রাষ্ট্র নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে চেষ্টা করবে।তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা অনিবার্য।

ভারত ও চীন বিশ্ব মঞ্চে একসঙ্গে কাজ করার মতো সুযোগ তৈরি করেছে।বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান বহুমুখী আন্তর্জাতিক বিশ্ব ব্যবস্থায় দেশ দুটি একে অপরের জন্য প্রয়োজনীয় হিসেবেও আবির্ভূত হচ্ছে।এর মধ্যে রয়েছে নয় দেশের সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন ব্লক এবং ব্রাজিল,রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে দুই দেশের অঘোষিত জোট ব্রিকস। আরও কয়েকটি দেশও এই দুটি ব্লকে যোগ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

আরেকটি বহুজাতীয় গোষ্ঠীতে যোগদানের প্রতিশ্রুতির দিকে যাচ্ছে ভারত।কোয়াড নামে এই গোষ্ঠীটিতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান।চীন এই গোষ্ঠীর সমালোচনা করে আসছে।

এই বিষয়ে কান্ত ও সিং উভয়েই উল্লেখ করেছেন,জাতি হিসেবে ভারতের গড়ে ওঠার মূল্যবোধের সঙ্গে এসব সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

সিং বলেন,দেশ ভাগের পর স্বাধীনতা পাওয়ার দুর্বল মুহূর্তেও ভারত জোট নিরপেক্ষতাকে বেছে নিয়েছে।এটি ভারতের সভ্যতার ডিএনএ।বর্তমানে বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ,তৃতীয় বৃহত্তম প্রতিরক্ষা ব্যয়কারী,পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি এবং পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হলেও জোট নিরপেক্ষতার মনোভাব ত্যাগ করেনি ভারত।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও নয়াদিল্লির কাউন্সিল ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডিফেন্স রিসার্চ-এর প্রতিষ্ঠাতা হ্যাপিমন জ্যাকব ভারত-চীন সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন।গত বছর বাণিজ্যে চীনকে ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষ আসন নিলেও ভারতের অর্থনীতিতে বেইজিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে।ফলে ভারত চীনা আগ্রাসন নিয়ে প্রকাশ্যে বেশি কিছু বলে না।চীনের সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে এমন অবস্থান।দুই দেশের বিরোধের মূলে রয়েছে চীন কর্তৃক ভারতের ভূমি দখল।যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়া নিয়েও চীন ক্ষুব্ধ।

নয়াদিল্লিভিত্তিক অবজারবার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ফেলো মনোজ যোশি মনে করেন,চীন ও ভারতের খুব ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ কম।সম্পর্ক যাতে খুব খারাপ না হয় সে বিষয়ে দুই দেশ সর্তক।

তিনি বলেন,চীন ও ভারতের দ্বন্দ্ব মার্কিন-ভারত সম্পর্কের দিকে ধাবিত হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।কিন্তু ভারতের অবস্থান মূলত দেশের আয়তন ও স্বার্থের ভিত্তিতে। পাকিস্তানের কাছ থেকে নিরাপত্তা হুমকির আশঙ্কায় রয়েছে দিল্লি।আর যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক মিত্র।আর পারস্য উপসাগরের ইরানকে বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে মনে করে ভারত। যেখানে তেহরানের যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তিক্ত।

জোশি বলেন, এই পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সামরিক জোটে ভারতের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা বাতিল করে দেয়। এমন সামরিক সম্পর্কের জন্য দুই দেশের দৃষ্টিভঙ্গি আরও ঘনিষ্ঠ হওয়া প্রয়োজন।

আরও খবর

Sponsered content