সারাদেশ

বিআরটিএ পরিদর্শক সৌরভ সাহার অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদের অভিযোগ

  প্রতিনিধি ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ , ১:৩৪:৩২ প্রিন্ট সংস্করণ

ঘুষ বাণিজ্য,ক্ষমতার অপব্যবহার ও মানিলন্ডারিংয়ের আইনি বিশ্লেষণ

নিজস্ব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।।বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) মেকানিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে চাকরি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন সৌরভ কুমার সাহা। নোয়াখালী অফিসে যোগদানের মধ্য দিয়েই শুরু হয় তার সরকারি চাকরি জীবন।তবে অভিযোগ উঠেছে,চাকরির শুরুতেই খুলে যায় তার ভাগ্যের চাকা। মাত্র ১১ বছরের ব্যবধানে নামে-বেনামে তিনি অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

রাজনৈতিক প্রভাব ও নিয়োগ প্রশ্ন

সূত্র জানায়,ফরিদপুর সদর উপজেলার বাসিন্দা সৌরভের বাবা বিজয় কৃষ্ণ সাহা ছিলেন পত্রিকার হকার। সীমিত আয়ের পরিবার থেকে উঠে আসা সৌরভ ২০১৪ সালে আওয়ামী পরিবারের পরিচয়ের সূত্র ধরে সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সুপারিশে বিআরটিএতে চাকরি পান বলে অভিযোগ রয়েছে।

এরপর দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে মেকানিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে পরিদর্শক হন সৌরভ। ঢাকার উত্তরা,গোপালগঞ্জ,চাঁদপুর, মাদারীপুর হয়ে সর্বশেষ বরিশাল বিআরটিএ অফিসে দায়িত্ব পালন করেন।

ড্রাইভিং লাইসেন্স ও রেজিস্ট্রেশন বাণিজ্য

অনুসন্ধানে জানা গেছে,সৌরভ তার দায়িত্বকালীন সময়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে একটি সুসংগঠিত দালালচক্র গড়ে তোলেন।প্রতি বোর্ডে কয়েকশ পরীক্ষার্থীর মধ্যে অধিকাংশকে ফেল করিয়ে পরে দালালদের মাধ্যমে পাস করানোর অভিযোগ রয়েছে।

সূত্র অনুযায়ী—

প্রতি লাইসেন্সে ঘুষ: ৩–৪ হাজার টাকা

এর মধ্যে সৌরভের অংশ: প্রায় ২,৫০০ টাকা

প্রতি বোর্ড থেকে আয়: ৫–৬ লাখ টাকা

মাসিক অবৈধ আয়: প্রায় ৩০ লাখ টাকা

এ কাজে বিআরটিএর চিহ্নিত দালাল,ব্যক্তিগত ড্রাইভার ও কয়েকজন ট্রাফিক কর্মকর্তার যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে।

রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস ঘুষ

অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে—

সিএনজি অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশন: ফাইলপ্রতি ৪০–৫০ হাজার টাকা

ট্রাক রেজিস্ট্রেশন: ৫–১০ হাজার টাকা

মোটরসাইকেল: ১–১.৫ হাজার টাকা

ফিটনেস: সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা

বিশেষভাবে গুরুতর অভিযোগ হলো,প্রধান কার্যালয়ের টাইপ অনুমোদন ছাড়াই ১৯১টি সিএনজি রেজিস্ট্রেশন,যেখানে প্রতিটি থেকে ৫০ হাজার টাকা করে ঘুষ নেওয়ার কথা মামলায় উল্লেখ করা হয়।

দুদকের মামলা ও জামিন প্রশ্ন

২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে বরিশালের দুদক কর্মকর্তা রাজকুমার সাহা বাদী হয়ে সৌরভ কুমার সাহাকে প্রধান আসামি করে মামলা দায়ের করেন। মামলায় আরও আসামি করা হয়—

বিআরটিএর সহকারী পরিচালক রোকনুজ্জামান

রানার অটোর এমডি নজরুল ইসলাম

মামলায় বলা হয়,পরস্পরের যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রতারণার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষতি করা হয়েছে। সৌরভ গ্রেপ্তার হলেও রহস্যজনকভাবে তিনি জামিনে মুক্তি পান, যা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

আইনি ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ

১. দুর্নীতি দমন আইন, ২০০৪

দুর্নীতি দমন আইন ২৬ ও ২৭ ধারায় বলা হয়েছে—

অবৈধ সুবিধা গ্রহণ

আয়ের উৎসের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ অর্জন
শাস্তিযোগ্য অপরাধ,যার সর্বোচ্চ শাস্তি দশ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড।

সৌরভের ঘোষিত বেতন (২৭ হাজার টাকা) ও অভিযোগকৃত সম্পদের মধ্যে ব্যাপক অমিল থাকায় এই আইন সরাসরি প্রযোজ্য।

২. মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২

নামে-বেনামে সম্পদ ক্রয়,আত্মীয়স্বজনের নামে গাড়ি ও বাস রেজিস্ট্রেশন এবং অবৈধ আয়ের অর্থ বৈধ করার চেষ্টা মানিলন্ডারিং অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। এ আইনে রয়েছে—

৪ থেকে ১২ বছরের কারাদণ্ড

অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্তের বিধান
৩. দণ্ডবিধি, ১৮৬০
দণ্ডবিধির ১৬১, ১৬৫ ও ৪২০ ধারায়—

সরকারি কর্মচারীর ঘুষ গ্রহণ

ক্ষমতার অপব্যবহার

প্রতারণা
গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।

৪. সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা

এই বিধিমালা অনুযায়ী অভিযোগ প্রমাণিত হলে—

চাকরিচ্যুতি

ভবিষ্যতে সরকারি চাকরির অযোগ্যতা
নিশ্চিত হতে পারে।

উপসংহার

বিআরটিএর মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবা সংস্থায় দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমন বিস্তৃত দুর্নীতির অভিযোগ শুধু ব্যক্তিগত অপরাধ নয়,এটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ওপর আঘাত। আইনি বিশেষজ্ঞদের মতে,সুষ্ঠু তদন্ত হলে এ ঘটনায় দুর্নীতি, মানিলন্ডারিং ও ক্ষমতার অপব্যবহারের একাধিক অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এখন দেখার বিষয়—দুদক ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এই অভিযোগের শেষ পর্যন্ত কীভাবে অনুসন্ধান ও বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়।

আরও খবর

Sponsered content