বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সংবাদ

বয়োবৃদ্ধ আবেদ সিরাজ বাক্‌প্রতিবন্ধী হয়েও ফ্রিল্যান্সার করে মাসে আয় হচ্ছে ৫০ হাজার টাকা

  প্রতিনিধি ২৬ মে ২০২৩ , ৯:০১:২০ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।বয়োবৃদ্ধ আবেদ সিরাজ। বয়স ৬৮ বছর। ২২ মে রাজধানীর একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে দেখা হয় আবেদ সিরাজের সঙ্গে।কথা বলতে গিয়ে দেখা গেল তাঁর কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।জানা গেল তিনি বাক্‌প্রতিবন্ধী। সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে দেওয়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পরিচয়পত্রে লেখা আছে ‘বাক্‌প্রতিবন্ধী (মাঝারি)’।

তবে পক্ব কেশের আবেদ সিরাজের হাসিমাখা মুখে আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়া।আর তা থাকবেই–বা না কেন? ৬৮ বছর বয়সেও তিনি কাজ করে যাচ্ছেন।গ্রাফিক ডিজাইন ও ডিজিটাল বিপণনে কাজ করেন একজন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে। মাসে আয় হচ্ছে কমবেশি ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংয়ের এই ক্ষেত্র,যেখানে তরুণদের অংশগ্রহণই বেশি,সেখানে আবেদ সিরাজ নিঃসন্দেহে এক ব্যতিক্রম।

বাক্‌প্রতিবন্ধী হিসেবে বেড়ে ওঠা:-
ছোটবেলা থেকে আবেদ সিরাজ বাক্‌প্রতিবন্ধী।পটুয়াখালীর বাউফলে বাড়ি।১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবারের সঙ্গে পালিয়ে আসেন ঢাকায়।ধানমন্ডিতে আশ্রয় নেন নানার বাসায়।পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। পড়াশোনায় বেশ কয়েক বছর বিরতি পড়ে যায় নানা কারণে। ১৯৯০ সালে মিরপুরের সরকারি বাংলা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন।মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকল্যাণে স্নাতক (সম্মান) হন ১৯৯৪ সালে।

তখন দেশে কম্পিউটারের প্রসার শুরু হয়েছে।এক আত্মীয়ের বাসায় টুকটাক কম্পিউটারের কাজ শিখতে থাকেন।বিভিন্ন প্রকল্পে ডেটা এন্ট্রির কাজ করতে থাকেন আবেদ সিরাজ। ২০০৪ সালে এক শিক্ষকের কাছে খোঁজ পেয়ে যোগ দেন আন্তর্জাতিক সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশে।কাজ সেই ডেটা এন্ট্রি। কেয়ারে চার বছর কাজ করেন।এরপর বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে স্বল্প সময়ের জন্য চাকরি করেন।কথা বলায় সমস্যা,তাই কোনো প্রতিষ্ঠানেই বেশি দিন চাকরি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি আবেদ সিরাজের।

ষাট পেরিয়ে নতুন উদ্যমে:-
ষাট বছর পেরোনোর পর জীবনে যেন বাঁকবদল ঘটে তাঁর। ২০১৬ সাল থেকে ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংয়ের বিভিন্ন বিষয় শেখার কথা ভাবেন।একাধিক প্রশিক্ষণকেন্দ্রে যান।কিন্তু তাঁর বয়স বেশি এবং কথা বলায় সমস্যার কারণে তিনি কোথাও কোনো কোর্সে ভর্তি হতে পারেননি।আবেদ সিরাজ বলেন, ‘২০১৮ আমি ও আমার এক অগ্রজ বন্ধু ঢাকার ক্রিয়েটিভ আইটি ইনস্টিটিউটে যাই।বাইরে থেকে দেখে প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ঢোকার আর সাহস পাইনি।একজন এসে জিজ্ঞেস করলেন কেন এসেছি।আমরা বললাম গ্রাফিক ডিজাইন শিখতে চাই।ধরেই নিয়েছিলাম,বয়সের কারণে তারাও ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু ক্রিয়েটিভ আইটি আমাদের দুজনকেই কোর্সে ভর্তি করে নিল।’

গ্রাফিক ডিজাইন শিখতে লাগলেন আবেদ সিরাজ।একসময় তিনি আর তাঁর বন্ধু কাজ করতে লাগলেন।আবেদ সিরাজ বলেন, ‘টুকটাক যা কাজ পাই,সেটার পারিশ্রমিক ভাগ করে নিতাম আমরা।খুব বেশি আয় হতো না,তবে ভালো লাগত, শুরুটা তো হলো।’

২০২০ সালে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের (এলইডিপি)’ ডিজিটাল বিপণনের একটি কোর্স করেন আবেদ সিরাজ। লেগে ছিলেন ভালোভাবেই।তাঁদের ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে সিরাজ পুরস্কারও পান।

১৯৯৬ সালে বিয়ে করেছেন।বর্তমানে স্ত্রী,দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সিরাজের পরিবার।থাকছেন ঢাকার মিরপুরে। মিরপুরে পৈতৃক সম্পত্তি ছিল সিরাজদের,যেটার আয় দিয়ে চলছিল তাঁদের পরিবার।হঠাৎ সেগুলো বেহাত হয়ে গেল। ২০২০ সালে সিরাজের মা মারা যান।তার ঠিক ৪০ দিন পর করোনায় মারা যান সিরাজের বড় বোন।

গ্রাফিক ডিজাইনে সফলতা:-
এই বিপদে ফ্রিল্যান্সিংয়ে আরও ঝুঁকে পড়লেন আবেদ সিরাজ।অনলাইনে আউটসোর্সিংয়ের কাজ দেওয়া–নেওয়ার ওয়েবসাইট (মার্কেটপ্লেস) ফ্রিল্যান্সার ডটকম,৯৯ ডিজাইনস, আপওয়ার্ক ডটকম ও ফাইভার ডটকমে কাজ করেন তিনি। বিদেশে থাকা বিভিন্ন গ্রাহকের জন্য টি–শার্টের নকশা করেন আবেদ সিরাজ।এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মতো টি–শার্টের নকশা করেছেন তিনি।

আবেদ সিরাজ বলেন,বয়স যা–ই হোক,ইচ্ছাশক্তি ও কাজের প্রতি আগ্রহ থাকলে কাউকে ফিরিয়ে দেব না।শেখার কোনো বয়স নেই।আমার মতো অনেকেই আছেন।অনেক জায়গা থেকে এমনভাবে ফিরিয়ে দিয়েছে,কষ্ট পেয়েছি,কিন্তু ভেঙে পড়িনি। হতাশ হইনি,দিনরাত কষ্ট করে যতটুকু পেরেছি,দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছি। যতটুকু আয় হচ্ছে, তা দিয়ে পরিবার চলছে।’

আরও খবর

Sponsered content