সারাদেশ

দেড় বছর চলে গেছে-এখনো একটি ওয়ার্ডের মহাপরিকল্পনাও চূড়ান্ত হয়নি!

  প্রতিনিধি ৫ জানুয়ারি ২০২৩ , ৯:৩১:৩৮ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।যানজট নিরসনে একটি ওয়ার্ডের যোগাযোগব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত,জলাবদ্ধতা কীভাবে দূর হবে,কতটি খেলার মাঠ,পার্ক,কমিউনিটি সেন্টার দরকার—এসব ঠিক করতে দেড় বছর আগ ইন্টিগ্রেটেড সিটি মাস্টারপ্ল্যান তথা সমন্বিত নগর মহাপরিকল্পনা তৈরির কাজ শুরু করেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।দক্ষিণ সিটির ৭৫টি ওয়ার্ড ঘিরে এ পরিকল্পনার কাজ এক বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল।তারপর অর্থের জোগান ঠিক করে মাঠপর্যায়ে শুরু হবে।বাস্তবতা হচ্ছে দেড় বছর চলে গেছে। এখনো একটি ওয়ার্ডের মহাপরিকল্পনাও চূড়ান্ত হয়নি।

বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের মেয়াদের প্রায় অর্ধেক সময় শেষ।বাকি আড়াই বছর সময়ে এ মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করে মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করা সম্ভব হবে কি না,এ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

নগরবিদেরা বলছেন,এখন বেশির ভাগ উন্নয়ন কাজ হচ্ছে উল্টো প্রক্রিয়ায়।আগে কাজ হয়ে যাচ্ছে।পরে পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে।এভাবে উন্নয়নকাজ বাস্তবায়ন করা হলে সরকারি অর্থের অপচয় হয়।যেমন জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি আপত্কালীন কিছু কাজ করছে।এসব কাজ করতে গিয়ে গত দুই অর্থবছরে দেড়শ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে।পরে দেখা গেল,ওয়ার্ডভিত্তিক মহাপরিকল্পনা তৈরির পর এখনকার বাস্তবায়নাধীন জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ ঠিক হয়নি।তখন এ কাজে খরচ করা অর্থ অনেকটা অপচয়েরই শামিল হবে।

অনেক কাজ তাঁরা করেছেন।কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে। পরিকল্পনায় আরও কিছু নতুন বিষয় যুক্ত হচ্ছে।ভালো কোনো জিনিস করতে হলে অনেক সময় তা আদায় করে নিতে হয়, কিছুটা সময়ও লাগে।মেয়র দ্রুত কাজ শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছেন।‌

ঢাকা দক্ষিণ সিটির পরিকল্পনা বিভাগ সূত্র বলছে,৩০ বছর মেয়াদি এ মহাপরিকল্পনা তৈরির জন্য ২০২১ সালের জুনে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিজাইন ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট লিমিটেড ও সাতত্ত্ব আর্কিটেক্টের সঙ্গে চুক্তি করে সিটি করপোরেশন।মহাপরিকল্পনা তৈরি করতে এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে ১২ মাস সময় দেওয়া হয়।

এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৮ কোটি টাকা।কিন্তু প্রতিষ্ঠান দুটি সময়মতো পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেনি।এ জন্য তাদের আরও ছয় মাস সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়।সেই বর্ধিত সময় শেষ হয়ে গেছে গত বছরের ডিসেম্বরে।তবে বর্ধিত সময়ের মধ্যেও মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ শেষ হয়নি।নতুন করে সময় বাড়ানোর আলোচনা চলছে।

নগর–পরিকল্পনা বিভাগও নিশ্চিত করেছে,দ্বিতীয় দফায় বাড়ানো সময়ের মেয়াদ ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে।নতুন করে সময় বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন,অনেক কাজ তাঁরা করেছেন।কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে।পরিকল্পনায় আরও কিছু নতুন বিষয় যুক্ত হচ্ছে।ভালো কোনো জিনিস করতে হলে অনেক সময় তা আদায় করে নিতে হয়,কিছুটা সময়ও লাগে।মেয়র দ্রুত কাজ শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছেন।‌

মহাপরিকল্পনা তৈরির জন্য এভাবে বসে থাকলে নাগরিকেরা সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন।বর্তমান মেয়রের মেয়াদ আছে আর মাত্র আড়াই বছর।এই সময়ের মধ্যে ওয়ার্ডভিত্তিক ছোট ছোট সুবিধা নিশ্চিত করতে করপোরেশনের কাজ শুরু করা উচিত।
মোহাম্মদ ফজলে রেজা,বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি

মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজের অগ্রগতি কত দূর হয়েছে, বিষয়টি জানতে সম্প্রতি যোগাযোগ করা হয় সাতত্ত্ব আর্কিটেক্টের স্থপতি রফিক আজমের সঙ্গে।তিনি বলেন, ওয়ার্ডভিত্তিক পরিকল্পনা তৈরির পাশাপাশি অগ্রাধিকার হিসেবে আরও চারটি বিষয় নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন।এগুলো হচ্ছে প্রথমত,কামরাঙ্গীরচরে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি এবং ওই এলাকায় একটি ৫০ তলা ভবন নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই;দ্বিতীয়ত,খিলগাঁওয়ের ফকিরখালীতে একটি স্মার্ট ইকো সিটি পার্ক তৈরি;তৃতীয়ত,পুরান ঢাকার দর্শনীয় স্থানগুলো সংরক্ষণ ও সেসব স্থাপনায় নির্বিঘ্নে যাতায়াতের পরিকল্পনা এবং চতুর্থত,রাজধানীর মতিঝিলকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলতে পরিকল্পনা তৈরির কাজ।

রফিক আজম বলেন,এই চারটি কাজের পরিকল্পনা এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি কয়েকটি ওয়ার্ডের পরিকল্পনার খসড়া ইতিমধ্যে তৈরি করা হয়েছে।

তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটির পরিকল্পনা বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছেন ভিন্ন কথা।তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী,পরিকল্পনা তৈরির কাজ কীভাবে শুরু হবে আর কীভাবে শেষ হবে,এখন পর্যন্ত কেবল সেই প্রতিবেদন (ইন্সপেকশন রিপোর্ট) পাওয়া গেছে। এর বাইরে গত এক বছরে ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে।তবে এ কাজ করপোরেশনের কাছে মনঃপূত হয়নি।

অবশ্য নগরবিদেরা বলছেন,সিটি করপোরেশন যাঁদের দিয়ে মহাপরিকল্পনার কাজ করছে,তাঁদের আগে কোনো অভিজ্ঞতা নেই।করপোরেশনের পক্ষে এ কাজের দেখভাল করছেন তথা প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন সংস্থার প্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদের দায়িত্বে থাকা সিরাজুল ইসলাম।এই কর্মকর্তা আর্কিটেকচার (স্থাপত্যবিদ্যা) নিয়ে পড়ালেখা করেছেন।নগর-পরিকল্পনা নিয়ে তাঁরও আগের কোনো অভিজ্ঞতা নেই।আবার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান থেকে কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থপতি রফিক আজম।তাঁরও মহাপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই।কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় তাঁরা কাজের ক্রমধারা ঠিক করতে পারছেন না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন,পরিকল্পিত কাজ করতে হলে ওয়ার্ডভিত্তিক মহাপরিকল্পনা খুবই জরুরি। তবে বর্তমান মেয়রের ক্ষমতার মেয়াদের অর্ধেক সময় চলে গেছে।বাকি সময়ের মধ্যে কাজ শুরু করা যাবে কি না,সেটা এখনই ভাবতে হবে।পাশাপাশি দীর্ঘ সময় নিয়ে তৈরি মহাপরিকল্পনা নিয়ে একটি চ্যালেঞ্জও রয়েছে।পরের মেয়ররা এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে না চাইলে এত আয়োজন কোনো কাজেই আসবে না।তাই দ্রুত ওয়ার্ডভিত্তিক উন্নয়নকাজ শুরু করা উচিত।

ওয়ার্ডভিত্তিক পরিকল্পনার অর্থের জোগানের বিষয় তো আছেই।পাশাপাশি আরও চারটি বড় পরিকল্পনা তৈরির কাজে হাত দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি।এসব বাস্তবায়নেও হাজার হাজার কোটি টাকা লাগবে।যেমন নাগরিক সেবায় পিছিয়ে থাকা কামরাঙ্গীরচর এলাকায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে বলে জানিয়েছেন সমন্বিত মহাপরিকল্পনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা।অথচ এসব টাকার জোগান কোথা থেকে আসবে,তা নিয়ে এখনো আলোচনাই হয়নি।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন,তাঁরা অর্থের জোগান নিয়ে এখনই ভাবছেন না।মহাপরিকল্পনা তৈরি হলে অর্থায়ন পেতে সমস্যা হবে না।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা বলেন,মহাপরিকল্পনা তৈরির জন্য এভাবে বসে থাকলে নাগরিকেরা সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন। বর্তমান মেয়রের মেয়াদ আছে আর মাত্র আড়াই বছর।এই সময়ের মধ্যে ওয়ার্ডভিত্তিক ছোট ছোট সুবিধা নিশ্চিত করতে করপোরেশনের কাজ শুরু করা উচিত।

যেমন সরকারের খাসজমি উদ্ধার করে সেখানে খেলার মাঠ ও পার্ক তৈরি করা যেতে পারে।পরিকল্পিত কাঁচাবাজার, স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ,ম্যাটার্নিটি সেন্টার,গ্রন্থাগার,ব্যায়ামাগার তৈরি ইত্যাদি কাজ দ্রুত শুরু করলে নাগরিকেরা সুবিধা পাবেন। নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে এসব করার নির্দেশনা আইনেই সিটি করপোরেশনকে দেওয়া আছে।

আরও খবর

Sponsered content