বিনোদন

চলচ্চিত্রের নোংরা রাজনীতির শিকার হয়েছিলেন সুনেত্রা

  প্রতিনিধি ১৪ জুন ২০২৪ , ৬:২১:১৭ প্রিন্ট সংস্করণ

অনলাইন ডেস্ক।।আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে এফডিসিতে শুটিংয়ের ফাঁকে অঞ্জনা ও সুনেত্রার পরিচয়।চলচ্চিত্র পরিচালক দারাশিকো ছিলেন পরিচয়ের মাধ্যম।প্রথম দিনের সেই পরিচয়ে সুনেত্রা প্রসঙ্গে দারাশিকো বলেছিলেন,অঞ্জনা, একজন নায়িকা এসেছে,দেখো তো কেমন লাগে?তোমার মতোই বড় বড় চোখ।’

প্রথম দেখায় সুনেত্রাকে আমি পছন্দ করা শুরু করলাম। বয়সে বড় অঞ্জনার সঙ্গে সুনেত্রার বন্ধুত্ব হতেও সময় লাগেনি বেশি দিন।মনের কথাও শেয়ার করতেন।আসা-যাওয়া ছিল বাসাবাড়িতেও।হতো আড্ডা।চলচ্চিত্র সূত্রে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব টানা এক দশকের বেশি সময় অব্যাহত ছিল।এরপর আড়ালে চলে যান সুনেত্রা।১৫ বছর আগে একবার ফোনে কথা হয়েছিল, এরপর আর দুজনের সঙ্গে কোনো কথা হয়নি।মৃত্যুর খবর শুনে সুনেত্রা প্রসঙ্গে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী অঞ্জনা।

সোহেল রানা প্রযোজিত ‘দস্যু বনহুর’ দিয়ে অঞ্জনার চলচ্চিত্রে অভিষেক।শামসুদ্দীন টগর পরিচালিত এই চলচ্চিত্রে অঞ্জনা অভিনয় করেছিলেন সোহেল রানার বিপরীতে।১৯৭৬ সালে নির্মিত চলচ্চিত্রটি সেই বছরের পবিত্র ঈদুল ফিতরে মুক্তি পায়।অন্যদিকে সুনেত্রা ছিলেন ওপার বাংলার অভিনেত্রী। ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বহু সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি।থিয়েটারের মাধ্যমেই অভিনয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল জনপ্রিয় এই অভিনেত্রীর।সুনেত্রাকে ঢাকাই সিনেমায় নিয়ে আসেন বাংলাদেশি পরিচালক মমতাজ আলী। প্রথম দেখা যায় সে সময়ের হার্টথ্রব নায়ক জাফর ইকবালের বিপরীতে ১৯৮৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘উসিলা’ সিনেমাতে।

চিত্রনায়িকা সুনেত্রা।আশি-নব্বইয়ের দশকে বড় পর্দার সাড়া জাগানো অভিনেত্রী সুনেত্রার মৃত্যুর খবরে খুব কষ্ট পেয়েছেন অঞ্জনা।মনের কষ্ট থেকে বলেছেন,চলচ্চিত্রের নোংরা রাজনীতির শিকার হয়েছিলেন সুনেত্রা।

ফেসবুক পোস্টে অঞ্জনা উল্লেখ করেছেন,সুনেত্রা আমাদের মাঝে আর বেঁচে নেই শুনে এতটা কষ্ট পেলাম,যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।অশ্রুসিক্ত নয়নে বারবার সেই মায়ামাখা মিষ্টি হাসির অপরূপ চেহারাটা চোখে ভাসছে।আশির দশকে আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রের অসংখ্য সুপারহিট ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের গুণী চিত্রনায়িকা সুনেত্রা।কিংবদন্তি চিত্রনায়কদের সাথে সে অনেক ভালো মানের,মনে রাখার মতো চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছে।নায়করাজ রাজ্জাক,আলমগীর,সোহেল রানা, ফারুক,জাফর ইকবাল,জসীম,ইলিয়াস কাঞ্চন,উজ্জ্বল, ওয়াসিম,মাহমুদ কলি,জাভেদ,রুবেল ও মান্নার সাথে রয়েছে তার অভিনীত অনেক চলচ্চিত্র।কিন্তু তারপরও একরাশ কষ্ট নিয়ে সে এক সময় কলকাতায় পাড়ি জমায়।সেখানেও সে কিছুসংখ্যক চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পর একসময় লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়।আর কখনোই কারও সামনে আসেনি।’

অঞ্জনা তাঁর লেখায় মনে করছেন,অনেক কষ্ট নিয়ে মারা গেছেন সুনেত্রা।আর এই কষ্ট অনেক না পাওয়া থেকে।

অঞ্জনা বললেন, ‘একবুক কষ্ট নিয়ে,অনেক পাওয়া-না পাওয়ার বেদনায় জর্জরিত হয়ে বড্ড অভিমান করে সে পরপারে পাড়ি দিয়েছে।তোমার অন্তিমযাত্রা শান্তির হোক বোন। আমাদের ক্ষমা করে দিয়ো,আমরা তোমার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারিনি।অনেক ভালো রুচিসম্মত চলচ্চিত্র তুমি আমাদের উপহার দেওয়ার পরও তোমাকে দিতে পারিনি জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মান।গুণীরা এভাবেই অনেক চাপা অভিমান নিয়ে চলে যায় না ফেরার দেশে।আমরা ব্যর্থ তোমার মতো অনেক গুণী শিল্পীকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার আমরা সঠিক সময়ে দিতে পারিনি বলে,মেধার মূল্যায়ন করতে পারিনি বলে। চলচ্চিত্রের নোংরা রাজনীতির শিকার হয়েছিল সুনেত্রা।এই নোংরা রাজনীতির কারণে আশির দশকে সুনেত্রার মতো অনেক গুণী শিল্পী জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন।তখনকার সময় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরিবোর্ডে থেকেও যাঁরা সুনেত্রার মতো এমন প্রতিভাময়ী গুণী শিল্পীদের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করেছেন,সকলের প্রতি আমি ধিক্কার জানাই।’

প্রথম আলোকে অঞ্জনা আজ শুক্রবার দুপুরে এ-ও বললেন, ‘ও যখন চলচ্চিত্রে আসে, তখন আমি বাংলাদেশ আর যৌথ প্রযোজনার ছবির নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।সুনেত্রাও যৌথ প্রযোজনার ছবিতে অভিনয় করেছে।ও তো দারাশিকো ভাইয়ের ছবিতে বেশি কাজ করেছে।আমিও করেছি।আমরা একসঙ্গে দুটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছি।কী যে ভালো মনের একটা মেয়ে ছিল,বলে বোঝাতে পারব না।অভিনয়শিল্পী কেমন ছিল তা তো বাংলা সিনেমার দর্শকেরাই তাকে মূল্যায়ন করেছে।’

খুব বেশি ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় না হলেও অঞ্জনার গুলশানের বাড়িতে সুনেত্রাসহ চলচ্চিত্রের আরও অনেকের আড্ডা হতো বলে জানালেন এই অভিনয়শিল্পী।সে রকমই একটি আড্ডার স্থিরচিত্র অঞ্জনা তাঁর ফেসবুকে পোস্টও করেছেন।সেখানে দেখা যাচ্ছে,চিত্রনায়িকা নুতন,অঞ্জনা, শবনম ও সুনেত্রাকে।ছবিটির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অঞ্জনা বললেন, ‘আমার গুলশানের বাড়িতে,বিয়ের পরপর। ১৯৯২ সালের দিকে হবে।বিয়ের পর আমাদের বাড়িতে একটা পার্টি ছিল।তখন তো চলচ্চিত্রের মানুষেরা মিলে কিছুদিন পরপর পার্টি হতো।সুনেত্রার সঙ্গে সম্পর্কটা যেহেতু বন্ধু, বোনের মতো ছিল—আমার বাড়ির সব আয়োজনে সে থাকত। আমরা অনেকটা কাছাকাছি বয়সের ছিলামও।’


যে সুনেত্রার সঙ্গে সম্পর্কটা বন্ধুত্বের ছিল,বোনের মতো ছিল, তা নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে আর দেখা যায়নি।সুনেত্রা নিজেকে অন্তরালে নিয়ে যান।একাকী থাকার সিদ্ধান্ত থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন বলে জানালেন অঞ্জনা।তাই আড়ালে থাকার সেই সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে নিজে থেকে ১৯৯৫ সালের পর আর যোগাযোগ করেননি বলেও জানালেন এই অভিনয়শিল্পী।তবে অঞ্জনা বললেন,‘১৫ বছর আগে একবার আমাকে ফোন করেছিল।নম্বর জোগাড় করেছিল। কী খবর, কেমন আছি, এ ধরনের কুশলাদি।এরপর আর যোগাযোগ হয়নি!’

ফেসবুকে অঞ্জনা লিখেছেন,সুনেত্রা,তুমি বেঁচে থাকবে তোমার অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী,লাখো কোটি সিনেমাপ্রেমী দর্শকের হৃদয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল আকাশে এক জ্যোতির্ময় নক্ষত্র হয়ে। “শিমুল পারুল”, “পালকী”, “সর্পরানী”, “ভাই বন্ধু”, “ভাই আমার ভাই”, “বন্ধু আমার”, “বোনের মতো বোন”, “লায়লা আমার লায়লা”, “আসমানি”, “রাজা জনি”, “আগুন পানি”, “নীল দরিয়া”, “উসিলা”, “সাধনা”, “বিধান”, “উচিৎ শিক্ষা”, “অগ্নিপুরুষ”, “বিক্রম”, “বাদশা ভাই”, “দুঃখিনী মা”, “কুঁচ বরন কন্যা মেঘ বরন কেশ”, “ভাবীর সংসার”-এর মতো বহু কালজয়ী চলচ্চিত্রের মাধ্যমে।

আরও খবর

Sponsered content