প্রতিনিধি ৬ নভেম্বর ২০২৫ , ৫:৫৬:৪৯ প্রিন্ট সংস্করণ
চট্টগ্রাম ব্যুরো অফিস।।দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম বন্দরে উপ-সংরক্ষক পদে কর্মরত ছিলেন ক্যাপ্টেন ফরিদুল আলম।তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম বন্দরে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়া, দায়িত্বে অবহেলা,অনৈতিক কাজ ও বাইরের ব্যক্তি দিয়ে কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টিসহ নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।

অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে এই কর্মকর্তাকে কয়েক মাস আগে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পায়রা বন্দরে বদলি করে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়।
৪ কোটি টাকার বিল তুলে নেওয়ার ঘটনার চেষ্টায় নতুন করে আবার তার দুর্নীতি বিষয়টি সামনে এসেছে।
এ ছাড়া,অভিযোগ রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে আবার ফেরত আসার জন্য তদবির চালানোরও।
চট্টগ্রাম থেকে বদলি হয়ে পায়রায় গেলেও এখনো চট্টগ্রাম বন্দরে নানান প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন জনকে সুবিধা আদায় করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ক্যাপ্টেন ফরিদের বিরুদ্ধে।
এই কর্মকর্তাকে নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম বন্দরের দুই দফা চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে তাকে গত ২৯ এপ্রিল পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরে বদলি করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।চিঠিতে বলা হয়েছে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত ক্যাপ্টেন ফরিদুল আলমকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পায়রা বন্দরে সংযুক্ত করা হলো।তার বদলির পর তার সঙ্গে থাকা ঘনিষ্ঠজনদের অন্য বিভাগে আন্তঃবদলি করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বর্তমানে পায়রা বন্দরে তিনি পরিচালক (ট্রাফিক) হিসেবে কর্মরত আছেন।
ক্যাপ্টেন ফরিদুল আলমের বিরুদ্ধে বন্দর থেকে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো একটি বিশেষ চিঠি আমাদের কাছে এসেছে।প্রথম চিঠি গত ১৮ মার্চ ও দ্বিতীয় চিঠি ২৭ এপ্রিল মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
গোপনীয় চিঠিগুলো পরিপ্রেক্ষিতে তাকে বন্দরে থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম বন্দরের একাধিক কর্মকর্তারা।গত ১৮ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক এই চিঠি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠান।
বন্দরের কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে,চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের টাগবোট এমটি কাণ্ডারি-৮-এর ডকিংরত হাল পাইপিং,আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ক,পেইন্টিংসহ প্রপেলার, প্রপেলার শ্যাফট মেরামত ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করার জন্য টেন্ডার আহ্বান করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।কিন্তু কৌশলে সর্বনিম্ন দরদাতার সঙ্গে চুক্তি না করে অন্য ঠিকাদার দিয়ে কাজ করিয়ে নেন ক্যাপ্টেন ফরিদ।
চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর প্রাণ হরিদাস রোডের মেসার্স মাহি এন্টারপ্রাইজকে কাজ দেন ক্যাপ্টেন ফরিদ।তিনি পরিদর্শন কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন।
নথি অনুযায়ী,২০২৪ সালের ২২ ডিসেম্বর মাহি এন্টারপ্রাইজকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়।কিন্তু আট দিনের মধ্যে জাহাজের বিশাল কাজগুলো সম্পন্ন হয়েছে মর্মে পরিদর্শন প্রতিবেদন দিয়ে কাজের বিল বাবদ ৪ কোটি ৮১ লাখ ৩ হাজার ৭২৮ টাকা পরিশোধ করতে তাগাদা দিতে থাকেন।
যন্ত্রপাতি মেরামত ও আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করার কাজ সন্তোষজনকভাবে শেষ হয়েছে জানিয়ে ২০২৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর পরিদর্শন কমিটির মালামাল গ্রহণের সুপারিশ করছে বলে চেয়ারম্যান বরাবর প্রতিবেদন দেন তিনি। পরিদর্শন কমিটির বাকি তিন সদস্যও সেখানে সই করেন।
কয়েক কোটি টাকার এই বিল চেয়ারম্যানের বরাবর অনুমোদনের জন্য গেলে কীভাবে কার্যাদেশ দেওয়ার ৮ দিনের মধ্যে এত কাজ শেষ হলো সেই প্রশ্ন তুলে বিল আটকে দেন বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান।
এরপর তদন্ত করতেই বের হয়ে আসে অনিয়মের চিত্র।
মূলত নতুন করে এই দুর্নীতির ঘটনায় গত ২৭ এপ্রিল তদন্ত প্রতিবেদন সংযুক্ত করে ক্যাপ্টেন ফরিদকে নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ অন্য কোথাও বদলির জন্য মতামত দেওয়া হয় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে।
চিঠিতে বলা হয়েছে,ক্যাপ্টেন ফরিদ চবক উপ-সংরক্ষক পদে পদোন্নতি হওয়ার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।সম্প্রতি তিনি চবক-এর টাগবোট কাণ্ডারি-০৮ এর পাইপিং আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্ক পেইন্টিংসহ সর্বনিম্ন দরদাতার সঙ্গে চুক্তি না করে অন্য ঠিকাদার দিয়ে কাজ করিয়ে প্রচলিত পদ্ধতির ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন।তাই তাকে আর চবক-এ রাখা সমীচীন নয়।
চিঠির সঙ্গে ৪ পাতার একটি তদন্ত প্রতিবেদন সংযুক্ত করা হয়।
এ ছাড়া,তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অনিয়ম ও অতীত দুর্নীতিসহ অনুরূপ সব দুর্নীতির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিসহ যৌথ তদন্ত কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয় চিঠিতে।
এর আগে গত ১৮ এপ্রিলে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে,ক্যাপ্টেন ফরিদ নানারকম অনৈতিক কাজ ও অবৈধ সুবিধার জন্য বাইরের লোকজন দিয়ে কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন।সম্প্রতি তিনি তাকে সদস্য (অর্থ) হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য নানা মহল থেকে কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন।তার এই ধরেন কর্মকাণ্ডের ফলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাধারণ কার্যক্রমে মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়,তিনি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিয়োজিত একজন কর্মকর্তা ও পেশাদার নাবিক।তিনি বন্দরের বিধি-বিধান ও সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী তার বিভাগের সর্বোচ্চ পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে,২০১৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ইন্দোনেশিয়ান জাহাজ এমভি গ্লেডিসকে জ্যেষ্ঠ পাইলটদের সুপারিশ উপেক্ষা করে ক্যাপ্টেন ফরিদ একক সিদ্ধান্তে বহিঃনোঙ্গর থেকে বন্দরে ভিড়ানোর চেষ্টা করেন।এতে জাহাজটি গ্রাউন্ডেড (ডুবে যায়) হয়।এই ঘটনায় তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব সদস্য (এএন্ডপি) নজরুল ইসলামকে সভাপতি করেন একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়।সেই তদন্ত কমিটি ফরিদুল আলমকে দায়ী করে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে।
তদন্ত কমিটি প্রমাণ পায়,২০১১ সালে ভিটিএমএস (ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) প্রকল্পে মন্ত্রণালয় কর্তৃক ডিপিপি সংশোধন ছাড়া এবং নিজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার না হয়েও ২ কোটি ৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকার প্রাক্কলন তৈরি করেন এবং কাজ শেষ হওয়ার তিন মাস আগেই বিল পরিশোধ করেন দেন।তার এই আচরণের জন্য তাকে স্বেচ্ছাচারী কর্মকর্তা আখ্যা দিয়ে ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়। কমিটি তাকে দুর্নীতিবাজ ও খামখেয়ালিপূর্ণ কর্মকর্তা হিসেবে বন্দরে রাখা সমীচীন হবে না বলে দ্রুত অপসারণের সুপারিশ করেন।
তদন্ত কমিটির সুপারিশের মাথায় তাকে সেই সময় এক বছর সাময়িক বরখাস্ত রাখা হয়।সেই সময় তিনি হারবার মাস্টার হিসেবে বন্দরে ছিলেন।
এত অভিযোগের পরও তিনি বহাল তবিয়তে আছেন কীভাবে?—সেই প্রশ্ন বন্দরের কর্মকর্তাদের মুখে মুখে।
চিঠি ও প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে সরাসরি জবাব না দিয়ে বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন,তাকে পদোন্নতি দিবে মন্ত্রণালয়।তিনি আইন অনুযায়ী যা পাওয়ার পেয়ে গেছেন। এখন মন্ত্রণালয় থেকেই আইনে যদি কভার করে,তাহলে পদোন্নতি দিতে পারে।আমাদের কাছে চেষ্টা করে লাভ নেই। আর ওনার বদলিও মন্ত্রণালয় করেছেন।’
তিনি বলেন,টাগবোটের বিষয়টি কর্তৃপক্ষের আদেশ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হয়েছে।এখানে যা হয়েছে সেই অনুযায়ী বলা হয়েছে।’
দুর্নীতির বিষয়ে বিস্তারিত তিনি আর কথা বলতে চাননি।
৪ কোটি টাকার অনিয়ম প্রসঙ্গে ক্যাপ্টেন ফরিদ বলেন, ‘যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই তাদের কাজ দেওয়া হয়েছে। এখানে আমার একক সিদ্ধান্তে কিছু হয়নি।’
তাহলে কীভাবে ৮ দিনের মধ্যে কাজ শেষ হলো?—জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন,চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ৯০ শতাংশ কাজ এভাবে হয়।এই কাজটি আড়াই মাস আগে শুরু হয়েছে। তদন্ত কমিটি আমার বিরুদ্ধে কিছুই পায়নি।’
তাহলে কেন তদন্তে প্রতিবেদনের পর বদলি হলো?এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,মন্ত্রণালয়কে আমি আমার জবাব দিয়েছি। আমাকে কেন জড়াচ্ছে আমি জানি না।আমাকে দোষ দেওয়া দরকার তাই দিয়েছে।’
একপর্যায়ে বলেন,আমি প্রমোশন চাইতেই পারি।এটা আমার অপরাধ না।আমার আগের ৭ জন এই পদ থেকে পদন্নোতি পেয়েছেন।’
তবে বাইরের ব্যক্তি দিয়ে বন্দরে চাপ দেওয়া কিংবা প্রভাব খাটানোর বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।

















