সারাদেশ

ঘুষ বাণিজ্য,ক্ষমতার অপব্যবহার ও সরকারি চাকরি বিধিমালা লঙ্ঘনের পূর্ণাঙ্গ আইনি বিশ্লেষণ

  প্রতিনিধি ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ , ১:৫১:৫৩ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।।বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) মেকানিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে চাকরিতে যোগদানের মধ্য দিয়ে সরকারি কর্মজীবন শুরু করেছিলেন সৌরভ কুমার সাহা।নোয়াখালী অফিসে প্রথম পোস্টিং হলেও অভিযোগ রয়েছে,চাকরির শুরুতেই তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়।মাত্র ১১ বছরের ব্যবধানে নামে-বেনামে তিনি অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে একাধিক অনুসন্ধানী সূত্রে জানা গেছে।

রাজনৈতিক প্রভাব ও নিয়োগ প্রসঙ্গ

সূত্রমতে,ফরিদপুর সদর উপজেলার বাসিন্দা সৌরভের বাবা বিজয় কৃষ্ণ সাহা ছিলেন একজন পত্রিকার হকার।সীমিত আয়ের পরিবার থেকে উঠে আসা সৌরভ আওয়ামী পরিবারের সদস্য হওয়ার সুবাদে এবং ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেয়াই সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সুপারিশে ২০১৪ সালে বিআরটিএতে চাকরি পান বলে অভিযোগ রয়েছে।

অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি পদোন্নতি পেয়ে মেকানিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে পরিদর্শক হন এবং উত্তরা,গোপালগঞ্জ, চাঁদপুর,মাদারীপুর হয়ে সর্বশেষ বরিশাল বিআরটিএ অফিসে দায়িত্ব পালন করেন।

লাইসেন্স,রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস ঘুষ বাণিজ্য

অনুসন্ধানে জানা গেছে,ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে সৌরভ একটি সুসংগঠিত দালালচক্র পরিচালনা করতেন। প্রতি বোর্ডে শত শত পরীক্ষার্থীর মধ্যে অধিকাংশকে ফেল করিয়ে পরে দালালদের মাধ্যমে পাস করানো হতো।

সূত্র অনুযায়ী—

প্রতি লাইসেন্সে ঘুষ: ৩–৪ হাজার টাকা

সৌরভের অংশ: প্রায় ২,৫০০ টাকা

প্রতি বোর্ড থেকে আয়: ৫–৬ লাখ টাকা

মাসিক অবৈধ আয়: প্রায় ৩০ লাখ টাকা

এ কাজে তার ব্যক্তিগত ড্রাইভার রিয়াজ খানসহ ২০–২৫ জন দালাল সক্রিয় ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস বাণিজ্যে—

সিএনজি রেজিস্ট্রেশন: ফাইলপ্রতি ৪০–৫০ হাজার টাকা

ট্রাক: ৫–১০ হাজার টাকা

মোটরসাইকেল: ১–১.৫ হাজার টাকা

ফিটনেস: সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা

বিশেষভাবে গুরুতর অভিযোগ হলো,প্রধান কার্যালয়ের টাইপ অনুমোদন ছাড়াই ১৯১টি সিএনজি রেজিস্ট্রেশন,যেখানে প্রতিটি থেকে ৫০ হাজার টাকা করে ঘুষ নেওয়ার কথা মামলায় উল্লেখ করা হয়।

দুদকের মামলা ও জামিন বিতর্ক

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বরিশালের দুদক কর্মকর্তা রাজকুমার সাহা বাদী হয়ে সৌরভ কুমার সাহাকে প্রধান আসামি করে মামলা দায়ের করেন।মামলায় বিআরটিএর সহকারী পরিচালক রোকনুজ্জামান এবং রানার অটোর এমডি নজরুল ইসলামকেও আসামি করা হয়।মামলায় ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রতারণার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষতির অভিযোগ আনা হয়।সৌরভ গ্রেপ্তার হলেও রহস্যজনকভাবে তিনি জামিনে মুক্তি পান।

সরকারি চাকরি বিধিমালা ও আইন লঙ্ঘনের বিশ্লেষণ

১. সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮

বিধি ৩(খ),৩(গ),৩(ঘ) অনুযায়ী সততা,নিষ্ঠা ও ক্ষমতার অপব্যবহার নিষিদ্ধ।লাইসেন্স ও রেজিস্ট্রেশন ঘুষ বাণিজ্য এসব বিধির সরাসরি লঙ্ঘন।

সম্ভাব্য শাস্তি (বিধি ৪): চাকরিচ্যুতি,বাধ্যতামূলক অবসর ও ভবিষ্যতে সরকারি চাকরিতে অযোগ্যতা।

২. সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা,১৯৭৯

বিধি ৩ ও ১৩ অনুযায়ী সরকারি দায়িত্ব পালনে ঘুষ বা সুবিধা গ্রহণ নিষিদ্ধ। অভিযোগকৃত কর্মকাণ্ডে এই বিধিমালা ভঙ্গ হয়েছে।

৩. দুর্নীতি দমন আইন,২০০৪

ধারা ২৬ ও ২৭ অনুযায়ী আয়ের উৎসের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ অর্জন ও ঘুষ গ্রহণ গুরুতর অপরাধ।

৪. মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন,২০১২

আত্মীয়স্বজন ও দালালের নামে বাস,গাড়ি ও সম্পদ ক্রয় অবৈধ অর্থ বৈধ করার প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

৫. দণ্ডবিধি,১৮৬০

ধারা ১৬১,১৬৫ ও ৪২০ অনুযায়ী ঘুষ গ্রহণ,ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রতারণার অভিযোগ প্রযোজ্য।

৬. বিআরটিএ আইন ও প্রশাসনিক নির্দেশনা

টাইপ অনুমোদন ছাড়া যানবাহন রেজিস্ট্রেশন এবং ম্যাজিস্ট্রেটের অনুপস্থিতিতে লাইসেন্স বোর্ড পরিচালনা গুরুতর প্রশাসনিক অপরাধ।

৭. সংবিধানিক দৃষ্টিকোণ

বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২০(২) অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় পদে সততা ও নৈতিকতা বাধ্যতামূলক—যা অভিযোগ অনুযায়ী লঙ্ঘিত হয়েছে।

উপসংহার

বিআরটিএর মতো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমন বিস্তৃত দুর্নীতির অভিযোগ প্রশাসনিক ও ফৌজদারি—উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই গুরুতর। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে,নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার হলে চাকরিচ্যুতি,সম্পদ বাজেয়াপ্ত এবং একাধিক ধারায় দণ্ডের সম্ভাবনা রয়েছে।এখন দেখার বিষয়—দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ এসব অভিযোগের বিষয়ে কতটা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

আরও খবর

Sponsered content