সম্পাদকীয়

গণমাধ্যমে হামলা: আইন,নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় দায়ের প্রতিফলন

  প্রতিনিধি ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ , ৩:০০:১৯ প্রিন্ট সংস্করণ

মাজহারুল ইসলাম।।রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে দেশের শীর্ষ দুই গণমাধ্যম—দৈনিক প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা এক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, আইনের শাসন এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত।১৮ ডিসেম্বর রাত ৯:৩০ মিনিটে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর শাহবাগ মোড়ে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়।রাত সোয়া ১১টা থেকে দিবাগত রাত ২টা-আড়াইটা পর্যন্ত প্রথমে প্রথম আলো,পরে ডেইলি স্টার কার্যালয়ে ভাঙচুর,অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালানো হয়।ফায়ার সার্ভিসকে বাধা দেওয়া হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার এস এন নজরুল ইসলাম জানান,ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অন্তত ৩১ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে; ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারদের মধ্যে নগদ টাকা ও ভাঙচুরের সরঞ্জাম উদ্ধার হয়েছে।পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী,বিপুল জনসমাগমের কারণে সংযম দেখানো হয়েছে।তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—কেন আগে থেকে গোয়েন্দা সতর্কতা কার্যকর হয়নি?কেন গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম স্থাপনায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ছিল না?

আইনি বিশ্লেষণ: রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ

এই হামলা সাধারণ রাজনৈতিক প্রতিবাদের মধ্যে পড়ে না। এটি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ,যা দণ্ডবিধি ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় আসে:

দণ্ডবিধি ১২৪এ/১২১: রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও নাশকতা

দণ্ডবিধি ৪৩৫/৪৩৬: অগ্নিসংযোগ

দণ্ডবিধি ৩৯৫/৩৯৭: ডাকাতি ও লুটপাট

সন্ত্রাসবিরোধী আইন,২০০৯: জনমনে ভীতি সৃষ্টি ও পরিকল্পিত সহিংসতা

ডিজিটাল নিরাপত্তা/আইসিটি আইন: উসকানি ও গুজব ছড়ানো

আইনজ্ঞদের মতে,এটি সংগঠিত সহিংসতা,যা প্রয়োজনে জঙ্গি-সন্ত্রাসী কার্যক্রম হিসেবেও বিচারযোগ্য।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সংবিধান

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ মতপ্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে।গণমাধ্যমে হামলা মানে:

স্বাধীন মতপ্রকাশ দমন

জনগণের জানার অধিকার কেড়ে নেওয়া

রাষ্ট্রকে ভয়ভীতির সংস্কৃতির দিকে ঠেলে দেওয়া

এটি ফ্যাসিবাদী ও উগ্র মতাদর্শের ক্লাসিক কৌশল—প্রথমে সংবাদপত্র,পরে বিচারব্যবস্থা,শেষে রাষ্ট্র।

মব জাস্টিস ও রাষ্ট্রহীনতার বিপদ

হাজার হাজার মানুষের সহিংস উপস্থিতি,আইন নিজের হাতে নেওয়া এবং “ক্ষোভের” আড়ালে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো স্পষ্ট মব জাস্টিসের লক্ষণ।ইতিহাস প্রমাণ করেছে—যেখানে মব শক্তিশালী হয়,সেখানে আইন দুর্বল হয়,আর সেখানেই জন্ম নেয় চরমপন্থা ও জঙ্গিবাদ।

সামাজিক দায়বদ্ধতা

এই হামলা কেবল পুলিশ বা সরকারের সমস্যা নয়। রাজনৈতিক দল,সুশীল সমাজ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরাও দায়ী।উসকানি,গুজব এবং “শেয়ার দিলেই দায় শেষ” মানসিকতা থেকেই সহিংসতা জন্ম নেয়।

করণীয়: কঠোর পদক্ষেপের প্রয়োজন

১. দৃষ্টান্তমূলক বিচার: দ্রুত চার্জশিট ও ফাস্ট ট্র্যাক ট্রায়াল
২. মব নেতৃত্ব শনাক্ত: অর্থদাতা ও উসকানিদাতাদের গ্রেপ্তার
৩. গণমাধ্যম স্থাপনার নিরাপত্তা জোন: বিশেষ প্রটেকশন
৪. ডিজিটাল উসকানির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স
৫. জঙ্গি ও উগ্র নেটওয়ার্ক ম্যাপিং
৬. রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে কঠোর আইন প্রয়োগ

শেষ কথা: গণমাধ্যম বাঁচলে রাষ্ট্র বাঁচবে

গণমাধ্যমে হামলা মানে শুধু ভবন পোড়ানো নয়,এটি রাষ্ট্রের বিবেক পোড়ানো।আজ যদি কঠোরভাবে এই অপরাধ দমন না করা হয়,আগামী দিনে বাংলাদেশ আইনের রাষ্ট্র থেকে মবের রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।

আরও খবর

Sponsered content