সারাদেশ

কথিত বিয়ের আড়ালে আন্তর্জাতিক মানব পাচারঃব্রাহ্মণবাড়িয়ার তরুণী সুরমা আক্তারকে পাচারের আশঙ্কা

  প্রতিনিধি ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ , ৫:৩৩:৩৯ প্রিন্ট সংস্করণ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি।।বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে বিয়ের নামে প্রতারণা ও মানব পাচারের আশঙ্কাজনক এক ঘটনায় চরম উদ্বেগে পড়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার একটি পরিবার।কথিত চীনা নাগরিক ওয়াং তাও–এর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তরুণী সুরমা আক্তার–এর।কিন্তু বিয়ের মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় ওই ব্যক্তি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে উধাও হয়ে যাওয়ায় বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলছে।

পরিবারের অভিযোগ,এটি কোনো পারিবারিক বা দাম্পত্য বিরোধ নয়; বরং পরিকল্পিতভাবে বিয়েকে ব্যবহার করে নারী পাচারের একটি সুসংগঠিত কৌশল।

ঘটনার পটভূমি: বিয়ের প্রলোভন,তারপর উধাও

পরিবার সূত্রে জানা যায়,কয়েক মাস আগে একাধিক দালালের মাধ্যমে ওয়াং তাওয়ের সঙ্গে সুরমার পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।বিদেশি নাগরিক হওয়ায় উন্নত জীবন,স্থায়ী সংসার ও আর্থিক নিরাপত্তার স্বপ্ন দেখানো হয়।স্থানীয়ভাবে সামাজিক আচার মেনে বিয়ে সম্পন্ন হলেও বিয়ের পরপরই সন্দেহজনক আচরণ শুরু করেন ওয়াং তাও।

বিয়ের এক সপ্তাহের মাথায় তিনি হঠাৎ করে বাসা ছাড়েন। এরপর থেকে তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর বন্ধ, দেওয়া ঠিকানা ভুয়া এবং পরিচয়পত্রের সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। একই সঙ্গে সুরমার অবস্থান ও নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ বাড়ছে।

আইনজীবীর মতামত: “এটি স্পষ্ট মানব পাচারের আলামত”

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ এ বিষয়ে বলেন,“বিয়ের আশ্বাস দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে কোনো নারীকে শোষণের ঝুঁকিতে ফেলা হলে তা সরাসরি মানব পাচার দমন ও প্রতিরোধ আইন,২০১২–এর আওতায় পড়ে। এখানে বিদেশি নাগরিকের পরিচয় গোপন,ভুয়া ঠিকানা ও দালাল সংশ্লিষ্টতা থাকায় এটি স্পষ্টতই মানব পাচারের আলামত।”

তিনি আরও বলেন, “এই ঘটনায় শুধু ওয়াং তাও নয়, যেসব দালাল বা মধ্যস্থতাকারী বিয়ের ব্যবস্থা করেছে,তারাও সমান অপরাধী।আইন অনুযায়ী তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে।”

প্রযোজ্য আইন ও শাস্তির বিধান

🔹 মানব পাচার দমন ও প্রতিরোধ আইন,২০১২

ধারা ৩: প্রতারণা,বিয়ের প্রলোভন বা বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে শোষণের উদ্দেশ্যে কাউকে স্থানান্তর বা হস্তান্তর মানব পাচার।

ধারা ৬: সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ন্যূনতম ৫ লাখ টাকা জরিমানা।

ধারা ৭: পাচারে সহায়তাকারীরাও মূল অপরাধীর সমান শাস্তির মুখোমুখি হবে।

আইনজীবীদের মতে,এ ঘটনায় মানব পাচারের পাশাপাশি প্রতারণা,জালিয়াতি ও আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র–এর ধারাও যুক্ত হতে পারে।

রাষ্ট্রীয় দায়: নজরদারির ঘাটতি কেন?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন,বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে বিয়ের ক্ষেত্রে—

পাসপোর্ট ও ভিসা যাচাই

দূতাবাস/হাইকমিশনের ছাড়পত্র

স্থানীয় প্রশাসনের অবহিতকরণ

অবশ্যক হলেও বাস্তবে এসব প্রক্রিয়া প্রায়ই উপেক্ষিত হয়।

একজন মানবাধিকার বিশ্লেষক বলেন, “এ ধরনের বিয়ের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নজরদারি কার্যত নেই।প্রশাসনের এই শৈথিল্যই মানব পাচারকারীদের সুযোগ করে দিচ্ছে।”

প্রশাসনিক ব্যর্থতা: আগে কেন শনাক্ত হয়নি চক্রটি?

প্রশ্ন উঠেছে—

বিদেশি নাগরিক হয়েও ওয়াং তাও কীভাবে যাচাই ছাড়াই এলাকায় অবস্থান করলেন?

বিয়ের সময় দালালদের ভূমিকা কেন নজরে এলো না?

স্থানীয় প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যভিত্তিক নজরদারি কোথায় ছিল?
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে,এটি কেবল ব্যক্তিগত অপরাধ নয়; বরং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতিফলন।
ভুক্তভোগীর অধিকার ও করণীয়

আইন অনুযায়ী সুরমা আক্তার—

রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা

উদ্ধার ও পুনর্বাসন

বিনা খরচে আইনি সহায়তা
পাওয়ার অধিকার রাখেন।প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য ইন্টারপোল ও সংশ্লিষ্ট দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নেওয়ার বাধ্যবাধকতাও রাষ্ট্রের রয়েছে।

উপসংহার
এই ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন প্রতারণা নয়;এটি বিদেশি বিয়ের আড়ালে চলমান মানব পাচার চক্রের একটি ভয়ংকর চিত্র। দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্ত,দালাল চক্র ভাঙা এবং প্রশাসনিক জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে ভবিষ্যতে আরও বহু নারী একই ফাঁদে পড়বে—এমন আশঙ্কাই এখন সবচেয়ে বড় উদ্বেগ।

আরও খবর

Sponsered content