সারাদেশ

এবারের কোরবানির ঈদে গরু বিক্রি করতে আসা একমাত্র নারী সালমা

  প্রতিনিধি ১৪ জুন ২০২৪ , ৪:১৩:১৪ প্রিন্ট সংস্করণ

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি।।হাট ভর্তি মানুষ।একপক্ষ গরু দেখছেন,দরাদরি করছেন।আরেক পক্ষ গরুর পরিচর্যায় ব্যস্ত। ব্যাপারীদের কেউ কেউ আবার দুপুরের খাবার রান্নায় মশগুল। এত ব্যস্ত বাজারে চোখ চলে গেল এক নারীর দিকে।তিনিও গরু বিক্রেতা।পরম মমতায় লালন-পালন করা গরুগুলোকে কখনো খাওয়াচ্ছিলেন,কখনো গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন।

বলছিলাম সালমা খাতুনের কথা।আজ শুক্রবার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের বিবিরহাট বাজারে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হলো। চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ৫৭০ কিলোমিটার দূরের চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রামে সালমা খাতুনের বাড়ি।

বাড়ির পাশেই তাঁর ছোট্ট খামার।গত বুধবার ১৪টি গরু নিয়ে তিনি বাড়ি থেকে দূরের বন্দরনগরে এসেছেন ৩৪ বছর বয়সী এ নারী।এবারের কোরবানির ঈদে গরু নিয়ে আসা একমাত্র নারী বিক্রেতা তিনি।তাই তাঁকে ঘিরে ইতিমধ্যেই আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।

কথায় কথায় সালমা খাতুন তাঁর জীবনের গল্প শোনালেন এ প্রতিবেদককে।নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ঘটনাগুলো উঠে এল তাঁর কথায়। জানালেন,চাঁপাইনবাবগঞ্জ কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতক করেছেন।এরপর ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে।সেখান থেকে ২০১৬ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন।পড়াশোনার পাট চুকিয়ে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি নেন।তবে করোনাকালে এসে চাকরিটা বাঁচানো গেল না।চাকরিটা ছাড়তে হয়।

চাকরি ছেড়ে খামার:-
সালমা বলেন,চাকরি হারিয়ে হতাশ হয়ে ঘরে বসে থাকার মানুষ আমি ছিলাম না। কীভাবে কী করা যায়,কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়,এ ভাবনা নিয়েই ঘুরতাম।এর মধ্যে গবাদিপশুর খামার করার চিন্তা মাথায় আসে।জমানো টাকায় একটি গাভি কিনি।শুরুর দিকে দুধ বিক্রি করতাম।এরপর গাভি থেকে আরও দুটি গরু প্রস্তুত হয়।এভাবে খামার বড় করার চিন্তা আসে।’

খামার বড় করার বিষয়টি বিশদভাবে তুলে ধরলেন সালমা। বলেন,সোনালী ব্যাংক স্থানীয় শাখা থেকে ১০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে খামারে ১০টি গরু তুলেছিলেন।দুই বছরের মাথায় সব মিলিয়ে ২০টি গরু ও বাছুর দাঁড়াল।পরে ২০২২ সালের ঈদে ১০টি গরু নিয়ে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামের বিবিরহাটে আসেন।ঈদের আগের দিন সব কটি বিক্রি হয়ে যায়।

ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে ২০২৩ সালে খামারে তেমন সময় দিতে পারেননি সালমা খাতুন।এ জন্য গরুর পরিচর্যাও ঠিকঠাক হয়নি।স্থানীয়ভাবেই গরু বিক্রি করেছিলেন। প্রথমবারের মতো লোকসানের মুখোমুখি হন তিনি।তবে হাল ছাড়েননি।সালমা বলেন,বেসরকারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক চাঁপাইনবাবগঞ্জ শাখা থেকে ৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে আবার শুরু করেন গরু লালন-পালন।এ বছর ঈদ উপলক্ষে প্রস্তুত করেছেন ১৪টি গরু।

এত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামে এসে গরু বিক্রি করার বিষয়ে প্রশ্ন ছিল সালমা খাতুনের কাছে।জবাবে বললেন, ছোট-মাঝারি গরুর চাহিদা চট্টগ্রামে বেশি।এ ধরনের গরু নিয়ে তাঁদের এলাকার অনেক ব্যাপারীই প্রতিবছর চট্টগ্রামে আসেন।এ ছাড়া ২০২২ সালে তিনি সব কটি গরু ভালো দামে বিক্রি করতে পেরেছিলেন। তাই এবারও চট্টগ্রামের বিবিরহাট পশুর বাজার বেছে নিলেন।

এত দূরে গরু নিয়ে আসতে মনের কোণে কোনো ভয় ছিল কি না,জানতে চাইলে সালমা খাতুন বলেন,মনে সব সময় সাহস রাখি।কোনো কিছুরেই ভয় পাই না।সাহস হারাই না কখনো।তাই এত দূরের পথও দূরে মনে হয় নাই।’

ব্যক্তিগত জীবনে ঘটনা টেনে এনে সালমা খাতুন বলেন, ২০১৩ সালের দিকে যখন তাঁর একমাত্র মেয়ের জন্ম হলো, তার পরপরই স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যায়।কিন্তু বাবার বাড়িতে থেকে পারিবারিক জমিতেই তিনি খামার করেছেন। জমি বন্ধক রেখে স্বল্প সুদে ঋণ নিয়েছেন।এখন গরু বিক্রির টাকায় ধীরে ধীরে ঋণ পরিশোধ করছেন।মেয়েও বড় হয়ে যাচ্ছে।সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সে।ফলে সব মিলিয়ে ভালোই আছেন তিনি।

লালন-পালন করতে করতে গরুগুলোর প্রতি ভীষণ মায়া জন্মে গিয়েছে বলে জানালেন সালমা খাতুন। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন,জীবনে যতবারই হতাশা এসেছে,ততবারই ঘুরে দাঁড়িয়েছি।এ খামারে গরুর লালন-পালন করতে করতে হতাশা ভুলে থাকি। এখন আর কোনো কিছুই ভালো লাগে না।’

বাজারের অন্য ব্যাপারীরাও সালমাকে সহযোগিতা করছেন। রাত দুইটা পর্যন্ত সালমা হাটে থাকেন।এরপর বাজারের পাশের একটি বাসায় থাকছেন।আবার সকাল বেলায় হাটে এসে গরুর খাবার তৈরি করেন।চট্টগ্রামের গরু ব্যাপারী মোহাম্মদ ইলিয়াছ প্রথম আলোকে বলেন,চট্টগ্রাম নগরের আর কোনো হাটে নারী বিক্রেতা আছেন বলে শোনা যায়নি।এবারের হাটে তিনিই একমাত্র নারী ব্যাপারী।

আরও খবর

Sponsered content