প্রতিনিধি ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ , ১:৩৪:৪৩ প্রিন্ট সংস্করণ
টেকনাফ(কক্সবাজার)প্রতিনিধি।।কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন রুটে প্রতিদিন চারটা জাহাজ চলাচল করে।জাহাজগুলো একই সময়ে ঘাট ছাড়ে।সেন্ট মার্টিনের জেটি থেকে তারই একটিতে আমরা উঠেছি।ভেতরে ঢুকে দেখি, যাত্রীসংখ্যা খুব বেশি নয়।ছুটির দিনে হলে হয়তো গাদাগাদি করে যেতে হতো।আজ অনায়াসেই নির্ধারিত সিটে বসতে পারলাম।সিটে বসেই মুঠোফোনে সংগ্রহ করা দুই দিনের ছবিগুলো দেখছিলাম।দেখতে দেখতে ভাবছিলাম,বউ আর ছেলেটার কথা।ওরা সঙ্গে থাকলে কী ভালোই না হতো। আমার স্ত্রীর সমুদ্র ভীষণ পছন্দ।ছেলেটাকেও একবার সমুদ্রের বিশালতা অনুভব করানো দরকার।পরিকল্পনাও হয়েছিল বেড়াতে আসব।এর মধ্যেই অফিস থেকে এই ট্যুর।তবে অফিস ট্যুর হলে কী হবে,সহকর্মীদের আন্তরিকতায় এটা যেন হয়ে উঠেছিল অনেকটাই পারিবারিক ভ্রমণ।ছয়জনে মিলে হাসি-আনন্দে,গল্পে,গানে,আড্ডায় সময় কেটেছে বেশ।

দুপুরের খাবার খেয়ে জাহাজে উঠেছি।আমার মতো অনেকেরই দেখলাম ঘুম ঘুম ভাব।আমাদের পাশেই বেশ বড় একটা দল, কথায়বার্তায় বোঝা গেল,পারিবারিক ভ্রমণে এসেছেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে কয়েকটি শিশুও আছে।শিশুদের চেঁচামেচিতে আমার ঘুম হলো না।সহকর্মীদের কেউ বসে আছেন,কেউ ঝিমাচ্ছেন,কেউ মুঠোফোনের ক্যামেরায় মুহূর্তকে বন্দী করতে ব্যস্ত।
জাহাজ ছাড়ার ২০-২৫ মিনিট হয়ে গেছে।আমরা এখন মাঝদরিয়ায়।কিছুক্ষণ পর মনে হলো,জাহাজটা একটু বেশি দুলছে।এই দোলাটা যাওয়ার সময়কার কিংবা এর আগে যে একবার সেন্ট মার্টিনে এসেছিলাম,তখনকার চেয়ে অনেক বেশি।ভাবলাম,আমার সিট জাহাজের সামনের দিকে হওয়ায় ঝাঁকিটা বেশি অনুভূত হচ্ছে।পেছনের দিকে যাওয়ার চিন্তা করে উঠে দাঁড়াতেই দেখি,জাহাজের সামনের ডেকে যাঁরা ছিলেন,তাঁরা কেউ নেই।সবাই ভেতরে,চিন্তিত।বাইরে তাকিয়ে ঢেউয়ের উচ্চতা দেখে গলা শুকিয়ে গেল।
জাহাজ দুলছে অবিরত।একেকটা ঢেউ এক-দেড় তলা বিল্ডিংয়ের সমান হবে।যাত্রীরা সবাই তটস্থ।বাচ্চারা চিৎকার–চেঁচামেচি করছে,নারীদের কেউ বমি করছেন,কেউ মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন।আমাদের জাহাজের পাশে অপেক্ষাকৃত ছোট আরও দুটি জাহাজ আছে।পাশাপাশিই যাচ্ছিল।তাকিয়ে দেখি, সেগুলোর অবস্থা আরও সঙিন।সবচেয়ে ছোট জাহাজটির সব যাত্রীকে লাইফ জ্যাকেট পরানো হয়েছে।ওই জাহাজের তীব্র চিৎকার-চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে।ঢেউয়ের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে জাহাজটির দিক মাঝেমধ্যে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।মনে হচ্ছে, ডুবে যাওয়া যেন সময়ের ব্যাপারমাত্র।এই দৃশ্য দেখতেও ভয়ংকর।আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসছে।আমাদের জাহাজ থেকে অতি উৎসাহী দু-একজন দেখি সেই দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণ করছেন।একজন নারীকে দেখলাম বমি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গেছেন।তাঁর স্বামী মলিন মুখে,শুকনা গলায় কিছু বলে তাঁকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন।বাচ্চাগুলো চিৎকার-চেঁচামেচি করছে,মা-বাবারা তাদের অভয় দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
আমাদের জাহাজ থেকে মাইক দিয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে পাশের ছোট জাহাজটিকে।আমার কেমন যেন অসাড় লাগছে।মানুষের জীবন এত ঠুনকো,যেকোনো সময় নিভে যেতে পারে প্রদীপ।প্রকৃতির কাছে মানুষ কত অসহায়।হঠাৎ মনে হলো আমার বাচ্চাটার কথা।প্রত্যেক মন্দেরই কিছু না কিছু ভালো থাকে।এই বিপদে বউ আর বাচ্চাটাকে আনিনি, খুব ভালো হয়েছে।কীভাবে ওদের সান্ত্বনা দিতাম, কীভাবে তাকাতাম বাচ্চাটার মুখের দিকে,যখন নিজের জীবনই বিপন্নপ্রায়।একা বিপদে পড়েছি,এটা কিছুটা মন্দের ভালো। আমার বরং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাঁচার চেষ্টা করা উচিত।
জাহাজের লোকেদের খুঁজতে শুরু করলাম,পেলামও একজনকে।জানতে চাইলাম,আমাদের কেন লাইফ জ্যাকেট দেওয়া হচ্ছে না।তিনি জানালেন,পর্যাপ্ত পরিমাণ লাইফ জ্যাকেট আছে,কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিলে দেওয়া হবে।তবে কর্তৃপক্ষের ধারণা কিছু হবে না।আমি বললাম,কিছু না হলে ভালো,কিন্তু যদি কিছু হয়,তখন তো লাইফ জ্যাকেট খুঁজতে খুঁজতেই সব শেষ হয়ে যাবে।অন্তত লোকেশনটা বলে দেওয়া উচিত সবাইকে।তাঁরা আমাদের লোকেশন দেখালেন।ততক্ষণে ঢেউয়ের তোড় কিছুটা কমে এসেছে।যাত্রীরাও স্বাভাবিক হতে শুরু করেছেন।
নাফ নদীতে ঢোকার পর মনে হলো,এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম।










