প্রতিনিধি ৫ আগস্ট ২০২৩ , ৫:১৩:০৫ প্রিন্ট সংস্করণ
মাজহারুল ইসলাম।।টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ।চতুর্থ বারের মতো বিজয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে ইতিমধ্যেই নৌকার জনপ্রিয় প্রার্থী বাছাইয়ে মাঠ জরিপের কাজ শুরু করেছে দলটি।আর এ গোপন মাঠ জরিপের কাজ স্বয়ং মনিটরিং করছেন দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিতর্কিত,স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে বিদ্রোহী প্রার্থীদের মদতদাতা,দ্বন্দ্ব-কোন্দলে জড়িত এবং বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী মতাদর্শীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া এমপি-মন্ত্রীদের লাগাম টানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাইকমান্ড।

দলীয় সভানেত্রীর নিজস্ব জরিপ টিম ও বিভিন্ন সংস্থা দিয়ে প্রতি তিন মাস পরপর জরিপ রিপোর্ট আপডেট করা হচ্ছে। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের শতাধিক মন্ত্রী-এমপির কপাল পুড়তে পারে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে আওয়ামী লীগ।বিএনপি সরকারকে চাপে রেখে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে না আসার কথা মুখে বললেও শেষ পর্যন্ত দলের অস্তিত্ব রক্ষায় তারা নির্বাচনে অংশ নেবে বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ।জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং দেশ-বিদেশে সবার কাছে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হোক, সেটাও প্রত্যাশা দলটির হাইকমান্ডের।
আর সেই কারণে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোনো রকম ঝুঁকি নেবে না আওয়ামী লীগ।রাজপথের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা ও ব্যক্তি ইমেজ দিয়ে পরাজিত করতে পারে,এমন যোগ্য ও পরীক্ষিত নেতাদের হাতেই এবার নৌকা প্রতীক তুলে দিতে চায় দলটি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সরা দেশের সব সংসদ সদস্যের আমলনামা এখন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার হাতে।গত টানা তিন মেয়াদে মন্ত্রী-এমপিরা নির্বাচনি এলাকায় কতটা জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পেরেছেন,যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে দলের ভেতর উপদল সৃষ্টি-মাইম্যান তৈরি করেছেন, বিতর্কিত-জনবিচ্ছিন্ন কিংবা দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নৌকার প্রার্থীকে পরাজিত করে বিদ্রোহী প্রার্থীদের মদত দিয়েছেন এবং প্রভাব খাটিয়ে ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে পারিবারিক বলয় তৈরি করা,নিজ দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে নির্যাতন এবং অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত মন্ত্রী-এমপিদের সার্বিক কর্মকাণ্ডের পুরো আমলনামা রয়েছে দলীয় প্রধানের হাতে।এসব বিতর্কিতকে বাদ দিয়ে জনপ্রিয়-ত্যাগী এবং বিজয়ী হওয়ার মতো প্রার্থীদের এবার দলীয় প্রতীক নৌকা তুলে দেবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
তারই অংশ হিসাবে ব্যর্থ ৯২ জন সংসদ সদস্য যাদের মধ্যে এমপি, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন তাদের একটি তালিকা শেখ হাসিনার টেবিলে জমা দেয়া হয়েছে।গণভবনের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানিয়েছে,নিজ এলাকায় জনবিচ্ছিন্ন,গ্রুপিং,দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে চিকিৎসা করিয়েও সুস্থ হতে পারিনি, সন্তানরা মাদক কারবার ও দুর্নীতিতে জড়িত এবং বয়সের কারণে নিষ্ক্রিয়) এমন ১০৮ জন এমপি মন্ত্রীর কপাল আগামী সংসদ নির্বাচনে পুড়তে পারে। তাদের বিষয়ে আরো অধিকতর খোঁজখবর নেয়া হবে বলেও জানা গেছে।
তালিকায় থাকা এমপিদের মধ্যে ঠাকুরগাঁও এ ১ জন, দিনাজপুরে ২ জন, নীলফামারিতে ১ জন, কুড়িগ্রামে ১ জন, গাইবান্ধাতে ২ জন, বগুরাতে ১ জন, নওগাঁতে ২ জন, রাজশাহীতে ২ জন, নাটোরে ১ জন, সিরাজগঞ্জে ২ জন, পাবনাতে ২ জন, কুষ্টিয়াতে ১ জন, চুয়াডাঙ্গাতে ১ জন, ঝিনাইদহে ২ জন তালিকায় রয়েছেন।
এছাড়া ব্যর্থ এমপি মন্ত্রীদের তালিকায় রয়েছেন,
ময়মনসিংহে ৫ জন, যশোর থেকে ৩ জন, নড়াইলে ১ জন, বাগেরহাটে ১ জন, খুলনায় ১ জন, সাতক্ষীরাতে ২ জন, বরগুনাতে ১ জন, পটুয়াখালীতে ২ জন, ভোলাতে ২ জন, বরিশালে ৩ জন, ঝালকাঠিতে ১ জন, টাঙ্গাইলে ৪ জন, জামালপুরে ২ জন, নেত্রকোনাতে ৩ জন, কিশোরগঞ্জে ২ জন, মানিকগঞ্জে ২ জন, মুন্সিগঞ্জে ২ জন, ঢাকায় ১১ জন, গাজীপুরে ১ জন, নরসিংদীতে ৩ জন, নায়ায়ণগঞ্জে ১ জন, রাজবাড়ী ২ জন, ফরিদপুরে ২ জন, মাদারীপুরে ১ জন, সুনামগঞ্জে ২ জন, সিলেটে ১ জন, মৌলভীবাজারে ১ জন, হবিগঞ্জে ২ জন, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়াতে ১ জন, কুমিল্লাতে ৪ জন, চাঁদপুরে ২ জন, ফেনীতে ১ জন, নোয়াখীলীতে ২ জন, লক্ষীপুরে ১ জন, চট্টগ্রামে ৬ জন, কক্সবাজারে ২ জন।
সূত্র আরো জানিয়েছে, এই ১০৮ এমপির মধ্যে ১৭ জন সংসদ সদস্য বয়সের কারণে নিজ এলাকায় সময় দিতে পারছেন না। বাকিরা বিভিন্ন দুর্নীতি,পরিবারের সদস্যরা মাদক কারবারে জড়িত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পুলিশে চাকরীর নিয়োগ বাণিজ্য, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নামে – বেনামে শত শত কোটি টাকা ঋণ নেওয়া,দুবাই, সৌদি আরব ও কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শত শত কোটি টাকা পাচার, অনেকের বিরুদ্ধে দুদকে অনুসন্ধান চলছে এমন বিভিন্ন অভিযোগের অভিযুক্ত।
গত ৭ মে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সভাপতির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন,সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন হবে চ্যালেঞ্জিং। সেই কারণে দলের প্রার্থী বাছাইয়ে সারা দেশে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।জনপ্রিয় ও ত্যাগী নেতারাই আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাবেন।
তথ্যানুসন্ধান চলছে,বির্তকিত এমপিদের নিয়ে চলছে একাধিক মাঠ জরিপ।তবে এই সমস্ত তথ্য উপাত্তের পাশাপাশি এরকম কয়েকজন নেতা আছেন যারা নিশ্চিতভাবে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন না।কারণ,তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর ব্যাপারে ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ সভাপতি সুস্পষ্ট মনোভাব ব্যক্ত করেছেন এবং আগামী নির্বাচনে যে তারা মনোনয়ন পাবেন না এই সম্পর্কে তাদেরকে বার্তাটা পরোক্ষভাবে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।এরকম তালিকায় যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন-
হাবিবে মিল্লাত: হাবিবে মিল্লাত সিরাজগঞ্জ ১ আসন থেকে নির্বাচিত এমপি। তিনি তার এলাকায় বিভক্তির সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ করেছেন।তার এলাকায় প্রায় বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগ এবং অঙ্গ সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভক্তি হচ্ছে।আওয়ামী লীগের বাইরে গিয়ে তিনি নতুন একটি গ্রুপ তৈরি করেছেন, এমন অভিযোগও উঠেছে। এই কারণেই তাকে সিরাজগঞ্জ আওয়ামী লীগের পদ থেকেও সরিয়ে দেয়া হয়েছিল।হাবিবে মিল্লাত ইতোমধ্যেই লাল কার্ড পেয়েছেন বলে আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
পঙ্কজ দেবনাথ:বরিশাল-৪ আসন থেকে নির্বাচিত পঙ্কজ দেবনাথকে সাম্প্রতিক সময়ে দলের সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। যদিও এ অব্যাহতি মানে এই নয় যে তিনি আর সংসদ সদস্য পদে থাকতে পারবেন না। এখন তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে বহাল রয়েছেন। তবে আগামী নির্বাচনে তিনি যে বরিশাল-৪ থেকে মনোনয়ন পাচ্ছেন না এটা মোটামুটি নিশ্চিত।
মুরাদ হাসান:জামালপুর-৪ আসন থেকে নির্বাচিত মুরাদ হাসান তথ্য প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তারপর তার বিভিন্ন রকম অসংলগ্ন কথাবার্তার জন্য তাকে পদত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর তিনি পদত্যাগ করেন। তার পদত্যাগের পরই তার এলাকার বিভিন্ন কমিটি থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়। বর্তমানে পর্দার আড়ালে আছেন মুরাদ হাসান। কিন্তু আগামী নির্বাচনে তিনিও মনোনয়ন পাবেন না বলেই নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে। ওই নির্বাচনী এলাকায় একাধিক ব্যক্তি এখন নির্বাচন প্রচারণার কাজে ব্যস্ত রয়েছেন।
হাজী সেলিম: ঢাকা-৭ থেকে নির্বাচিত হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে একটি দুর্নীতির মামলার রায় হয়েছে এবং ওই মামলায় তিনি দণ্ডিত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়নি।এ নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। তবে সংসদ সদস্য বাতিল হোক না হোক,সর্বোচ্চ আদালতের রায় যদি শেষ পর্যন্ত বহাল থাকে তবে আগামী নির্বাচনে হাজী সেলিমকে দেখা যাবে না।
খন্দকার মোশাররফ হোসেন: ফরিদপুর-৩ থেকে নির্বাচিত দুইবারের এমপি খন্দকার মোশাররফ হোসেন আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাচ্ছেন না, এটি মোটামুটি নিশ্চিত। ফরিদপুরে তার ঘনিষ্ঠ লোকজনের ব্যাপক অর্থপাচার, লুটপাট, দুর্নীতির অভিযোগ গণমাধ্যমে বছর জুড়েই চাউর হয়েছে এবং এই সমস্ত অভিযোগে তার সহকারী একান্ত সচিব এবং তার ঘনিষ্ঠ কর্মীদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে।
বর্তমানে রাজনীতিতে তিনি এক ধরনের মৌনব্রত অবলম্বন করছেন এবং সবকিছু থেকেই তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। আগামী নির্বাচনে যে ফরিদপুর-৩ আসন থেকে তিনি নির্বাচন করছেন না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত।
এরকম আরও অন্তত ৩০ জন রয়েছেন,যারা ইতোমধ্যেই মাঠ ছেড়ে দিয়েছেন।তাদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযোগগুলো রয়েছে সেই সমস্ত অভিযোগগুলোর কারণে তারা আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন না বলে বার্তা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কতজন নতুন প্রার্থীকে সামনে আনবে সেটি চূড়ান্ত হবে আরও পরে।











