জাতীয়

অবৈধ ‘ভাগ’ চেয়ে বসেন সচিব

  প্রতিনিধি ৫ জানুয়ারি ২০২৩ , ৯:৪৬:২৪ প্রিন্ট সংস্করণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।।পরিপত্র অনুযায়ী বৈধ উপায়ে প্রকল্পের সম্মানী নেন কর্মকর্তারা।তবে সে টাকায় অবৈধ ‘ভাগ’ চেয়ে বসেন সচিব।দাবি করা ভাগের টাকা কৌশলে কর্মকর্তাদের পকেট থেকে আদায়ও করেছেন তিনি।এভাবে অধীনস্থদের বৈধ আয়ে অবৈধ থাবা বসিয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাস্তবায়ন,পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান।

১ জানুয়ারি আইএমইডি থেকে বদলি হয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে যোগ দিয়েছেন তিনি।আইএমইডির একশর বেশি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা তাঁদের বৈধ আয় সচিবকে দিতে বাধ্য হয়েছেন।রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী সরকারের রাজস্ব বাজেটের জন্য নেওয়া চলমান বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন এবং সমাপ্ত প্রকল্প পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করা আইএমইডির কাজ।সমাপ্ত প্রকল্পের কিছু গুরুত্বপূর্ণ চূড়ান্ত প্রতিবেদন আইএমইডিতে জমার পর সেটি সম্পাদনার দায়িত্ব পান সংশ্নিষ্ট সেক্টরের তিন কর্মকর্তা।

আইএমইডি থেকে ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর জারি করা পরিপত্র অনুযায়ী সংশ্নিষ্ট সেক্টরপ্রধান (মহাপরিচালক) সম্পাদনা প্যানেলের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন।সদস্য হিসেবে থাকেন এক পরিচালক ও এক ডেস্ক অফিসার। প্রতিটি প্রকল্পে এ সম্পাদনা প্যানেলের জন্য ৭১ হাজার টাকা করে বরাদ্দ থাকে।এর মধ্যে আহ্বায়ক পান ১৪ হাজার, পরিচালক ১৭ হাজার এবং ডেস্ক অফিসার ৪০ হাজার টাকা।

সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন,সম্পাদনার মূল কাজটি ডেস্ক অফিসারই করেন,তাই তাঁর সম্মানী বেশি।এ ছাড়া প্রতিটি সেক্টরে মহাপরিচালক ও পরিচালকরা চার-পাঁচটি করে প্রকল্পের সম্পাদনা প্যানেলে থাকতে পারেন।তবে ডেস্ক অফিসাররা এক-দুটির বেশি প্যানেলে থাকতে পারেন না।এদিক বিবেচনায়ও ডেস্ক অফিসারদের সম্মানী বেশি দেওয়ার রেওয়াজ প্রচলিত।

আর এই জায়গাতেই বড় ধরনের ‘ছুরি’ চালিয়েছেন সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান।তাঁর বিশ্বস্ত উপসচিব মাহমুদ হাসানকে (পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন সেক্টর-২) দিয়ে সম্পাদনা প্যানেলের বরাতে টাকা তোলার দায়িত্ব দেন।উপসচিব মাহমুদ হাসান আইএমইডির হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আশরাফুল আলমকে ‘ফলাফলভিত্তিক পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন পদ্ধতির কার্যকর ব্যবহারে আইএমইডির সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রকল্পের কাজে দুর্বলতার অভিযোগে ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে বণ্টন হওয়া টাকা সবার কাছ থেকে তুলে দিতে চাপ দেন।সচিবের জন্য প্রতি প্রকল্প থেকে ২১ হাজার টাকা করে আশরাফুলকে তুলে দিতে বলেন উপসচিব মাহমুদ।

প্রকল্পপ্রতি ৭১ হাজার টাকার মধ্যে সচিবের জন্য ২১ হাজার, মহাপরিচালকের ২০ হাজার,পরিচালকের ১৭ হাজার ও ডেস্ক অফিসারের জন্য ১৩ হাজার টাকার বিভাজন দেখিয়ে একটি কাগজের টোকা ধরিয়ে দেন আশরাফুল আলমকে।টাকা তোলার বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে উপসচিব মাহমুদ হাসান প্রথমে অস্বীকার করেন।পরে তাঁর হাতে লেখা টোকা সংগ্রহে রয়েছে জানালে তিনি সচিবের (আবু হেনা মোরশেদ জামান) সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

সম্পাদনা প্যানেলের পরিপত্রবহির্ভূত উল্লেখিত হিসাব অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ডেস্ক অফিসাররা।তাঁরা প্রতি প্রকল্পের জন্য যেখানে ৪০ হাজার টাকা পেতেন,সেখানে সম্মানী ধরা হয়েছে ১৩ হাজার টাকা,অর্থাৎ ডেস্ক অফিসারের সম্মানী ২৭ হাজার টাকা করে কমে যায়।

অন্যদিকে,মহাপরিচালক ও পরিচালক পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যাতে মনঃক্ষুণ্ণ না হন,সে জন্য তাঁদের সম্মানী কিছুটা বাড়িয়ে বা অপরিবর্তিত রাখা হয়।এ হিসাবে গত অর্থবছরে ৭২ প্রকল্পের প্রতিটি থেকে ২১ হাজার টাকা করে সচিবকে মোট ১৫ লাখ টাকার বেশি দেওয়া হয়েছে।প্রথম দফায় প্রায় সাড়ে ১২ লাখ টাকা তোলা হয়।আইএমইডির ১২ নম্বর ব্লকের নিচতলার হিসাব শাখার পেছনের কক্ষের টেবিলে টাকা জড়ো করা হয়।

এ-সংক্রান্ত ছবি হাতে রয়েছে।আইএমইডির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান,পরিপত্র অনুযায়ী সম্পাদনা প্যানেলে সচিবের নাম নেই।তাই আইএমইডির কোনো সচিবই এ বিষয়ে নাক গলাননি।তবে আবু হেনা মোরশেদ জামান আইএমইডির সচিবের দায়িত্ব নেওয়ার পরই সম্পাদনা প্যানেলে অবৈধভাবে ভাগ বসান।বিষয়টি নিয়ে ডেস্ক অফিসাররা ক্ষোভে ফুঁসছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আশরাফুল আলম বলেন, ‘আমি ছোট চাকরি করি।এইসব নিয়ে কথা বলতে চাই না।অফিসারদের জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন।’আইএমইডির সহকারী পরিচালক আজগর আলী বলেন,’আইএমইডির ইতিহাসে এমন নজির নেই।এটা একটা কালো অধ্যায়।সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা এমন করতে পারেন,তা আমাদের ধারণার বাইরে।’

সচিব-কীর্তি এখানেই শেষ নয়।প্রকল্পপ্রতি স্টেশনারি বাবদ বরাদ্দ ২২ হাজার টাকায়ও সচিবের চোখ পড়েছে বলে জানিয়েছেন আইএমইডির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।৭২ প্রকল্পের প্রতিটিতে ২২ হাজার টাকা হিসাবে এ টাকার পরিমাণ প্রায় ১৬ লাখ টাকা।ব্যয় সংকোচন নীতির আওতায় এ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার কথা বলেছিলেন সচিব।

তবে সেটা কোষাগারে জমা হয়নি বলে জানিয়েছেন হিসাব-সংশ্নিষ্টরা।

আইএমইডির দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা জানান,কর্মচারীদের পকেট থেকে টাকা উঠিয়েই থামেননি মোরশেদ জামান।যেখান থেকে যেভাবে পারা যায় সেভাবেই টাকা তুলেছেন।উদাহরণ দিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান,ডিজিটাইজেশন,ইমপ্লিমেন্টেশন,মনিটরিং অ্যান্ড পাবলিক প্রকিউরমেন্ট প্রজেক্টের (ডিআইএমএপিপিপি) আওতায় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দোহাটেক নিউ মিডিয়ার সঙ্গে হওয়া পাঁচ দিনব্যাপী পিই (প্রকিউরমেন্ট এনটিটি) ট্রেনিংয়ে প্রধান অতিথি হিসেবে আবু হেনা মোরশেদ জামান সম্মানী বাবদ নিয়েছেন ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা।

সংশ্নিষ্টরা জানান, ট্রেনিংয়ে উপস্থিত না থেকেই সচিব এত টাকা নেন।

আইএমইডির এক মহাপরিচালক জানান,গত অর্থবছরে ৭২ প্রকল্প থেকে বেতনের বাইরে সচিব বৈধভাবে প্রায় ৬ লাখ টাকার সম্মানী পেয়েছেন।এ ছাড়া আরও সুযোগ-সুবিধা তো আছেই।এর পরও ডেস্ক অফিসারদের সম্মানীতে অবৈধভাবে ভাগ বসিয়ে বাজে কাজ করেছেন।

সম্পাদনা প্যানেল-সংক্রান্ত পরিপত্রটি আইএমইডির সাবেক সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তীর সইয়ে জারি হয়।তিনি বলেন, ‘পরিপত্রে যা আছে,তা অনুসরণ করতে হবে।পরিপত্রের বাইরে কোনো সুবিধা অন্য কেউ নেওয়ার সুযোগ নেই। তেমনটা হয়ে থাকলে সেটা খতিয়ে দেখা উচিত।’

আইএমইডির শীর্ষ একাধিক কর্মকর্তা বলেন,মোরশেদ জামান তাঁর নিজস্ব সার্কেলের তিন-চারজন জুনিয়র অফিসারের মাধ্যমে তৈরি করেছিলেন একটি বলয়।এসব অফিসার অবৈধভাবে আইএমইডির অনেক সুবিধা নিয়েছেন।প্রকল্প পরিদর্শনের জন্য আইএমইডির ভাড়া করা ছয়টি গাড়ির মধ্যে চারটিই সচিবের আশীর্বাদপুষ্টরা ব্যবহার করতেন।প্রতি গাড়ির জন্য মাসে ২ লাখ টাকার ওপরে ভাড়া দেওয়া হয়।

এসব গাড়ি ব্যক্তিগতভাবে দেদার ব্যবহার হয়েছে। অবৈধভাবে গাড়ি সুবিধা নেওয়াদের অন্যতম উপসচিব মাহমুদ হাসান (পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন সেক্টর-২)।উপসচিব হিসেবে তিনি সরকার থেকে গাড়ি পেয়েছেন,প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা করে গাড়ির খরচ নিচ্ছেন।তার পরও প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহার করছেন ইচ্ছা মতো।মাহমুদ হাসানের অবৈধভাবে গাড়ি ব্যবহার-সংক্রান্ত লগ বইয়ের তথ্য সমকালের সংগ্রহে রয়েছে। এ ছাড়া সচিবও অবৈধভাবে প্রকল্পের গাড়ি পারিবারিক কাজে ব্যবহার করেছেন।

এ ব্যাপারে উপসচিব মাহমুদ হাসান বলেন,কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া আমি কোনো সুবিধা নিইনি।’গাড়ি ব্যবহারে অনিয়মের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দিতে রাজি নন বলে ফোন কেটে দেন।

সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানকে সোমবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অন্তত ১০ বার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি।তাঁর দপ্তরের টেলিফোনে যোগাযোগ করলেও সচিব ব্যস্ত আছেন বলে জানানো হয়।বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে পরিচয় দিয়ে মেসেজ পাঠালেও মোরশেদ জামানের তরফ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

গত মঙ্গলবার সচিবের দপ্তরে গেলে তাঁর সাক্ষাৎ মেলে। সম্পাদনা প্যানেলের সম্মানী-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,’সচিব,সিনিয়র সচিব পর্যায়ে নিষ্পত্তি হওয়া বিষয় অধস্তন কর্মকর্তাদের সম্পাদনার সুযোগ নেই।আমি সম্পাদনা প্যানেল বাদ দিয়ে নতুন পরিপত্র করেছি,তাই অনেকে ক্ষুব্ধ। আমি বিধিবহির্ভূতভাবে কোনো সম্মানী নিইনি।যদি নিয়ে থাকি তাহলে যারা অভিযোগ করছে তারা কাগজপত্র দেখাক।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে মোরশেদ জামান বলেন,’যদি কোনো উপসচিব আমার নামে টাকা তোলার নির্দেশ দিয়ে থাকে,তাহলে অভিযোগকারীরা তখন আমাকে কেন বলেনি? এখন আমি দপ্তর ছেড়ে চলে এসেছি,দু’জনকে বদলি করেছি,এখন ওরা হয়তো অভিযোগ করছে।’সচিব আরও বলেন,’স্টেশনারি-সংক্রান্ত টাকা সংশ্নিষ্ট ফার্মকে বা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলেছিলাম।

কিন্তু সেটা জমা দেওয়া না যাওয়ায় ওই টাকা অপেক্ষাগারের ফার্নিচার ও বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙানোর কাজে লাগানো হয়েছে।’ এটা বিধিসম্মত হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন,’এটা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করেছে,তাদের জিজ্ঞেস করেন।’তবে সচিবের বরাত দিয়ে উপসচিব মাহমুদ হাসান সম্পাদনা প্যানেলের যে ১৫ লক্ষাধিক টাকা উপসচিবের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন,এ অভিযোগের কোনো সদুত্তর সচিবের কাছ থেকে মেলেনি। অন্যদিকে সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা জানান,সচিব যদি নিজে টাকা না নিয়ে পরিপত্র করতেন,তাহলে প্রশ্ন উঠত না।তিনি অবৈধভাবে টাকার ভাগ নিলেন,আর যাওয়ার আগে আমাদের বৈধ আয় বন্ধ করে গেলেন,এটা কেমন নৈতিকতা?

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলমের কাছে আইএমইডির সম্পাদনা সম্মানীর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে গত সোমবার বলেন,সম্মানীর ক্ষেত্রে এমনটা হয়ে থাকলে সেটা বৈধ হয় কীভাবে?পরিপত্র পরিপন্থি হয়েছে।এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে

আরও খবর

Sponsered content